বাংলাদেশের ফুটবলে সেই সব সোনালি গোল

১৯৮২ দিল্লি এশিয়ান গেমসে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে জয়সূচক গোলের পর বাদল রায়ের উল্লাস। এই গোলেই এশিয়াডে প্রথম জয় দেখেছিল বাংলাদেশ (২–১)।  ফাইল ছবি
১৯৮২ দিল্লি এশিয়ান গেমসে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে জয়সূচক গোলের পর বাদল রায়ের উল্লাস। এই গোলেই এশিয়াডে প্রথম জয় দেখেছিল বাংলাদেশ (২–১)। ফাইল ছবি
আন্তর্জাতিক ফুটবলে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত অনেক গোলই পেয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় দল। কিন্তু মনে রাখার মতো গোল কোনগুলো? কোন গোলগুলোই–বা প্রভাব ফেলেছে দেশের ফুটবলের বাঁকবদলে? ফিরে দেখুন স্মৃতির আয়নায়—


স্মৃতিটা এখনো তাজা। গত অক্টোবরে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ভারতের বিপক্ষে সাদ উদ্দিন করলেন আলোড়নতোলা এক গোল। জামাল ভূঁইয়ার ফ্রি–কিকে সাদের হেড জালে যেতেই স্তব্ধ ৬০ হাজার দর্শকে ঠাসা কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। শেষ পর্যন্ত ফল ১-১ হলেও সাদের গোল হার মানায় ভারত–জুজুকে। বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য সেই গোল হয়ে যায় দারুণ এক বিজ্ঞাপন।

২০১৮ জাকার্তা এশিয়ান গেমসে জামাল ভূঁইয়ার ঐতিহাসিক গোলটি তো অবিস্মরণীয়ই। শক্তিশালী কাতারের বিপক্ষে অন্তিম সময়ে পাল্টা আক্রমণে ফাঁকায় বল পেয়ে গড়ানো শটে জামালের লক্ষ্যভেদ। এই গোল প্রথমবার বাংলাদেশকে তুলে নেয় এশিয়ান গেমস ফুটবলের দ্বিতীয় রাউন্ডে। তবে সেটি জাতীয় দল ছিল না, ছিল অনূর্ধ্ব-২৩। কিন্তু একসময় এশিয়ান গেমসে খেলত জাতীয় দলই। তা ছাড়া জামালের এই গোল বাংলাদেশের ফুটবলকে নতুন পথ দেখায়।

২০১৪ ইনচন এশিয়ান গেমসে মামুনুল ইসলামের গোলটিও আসতে পারে এ তালিকায়। আফগানিন্তানের বিপক্ষে তাঁর দূরপাল্লার শটে এশিয়াডে ২৮ বছরের জয়খরা কাটে লাল–সবুজের। তার আগে সর্বশেষ জয় ছিল ১৯৮৬ সিউল এশিয়াডে। শেখ আসলামের গোলে নেপালকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। এশিয়াডে তখন জাতীয় দল খেলত। এ গেমসে বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচ জেতে ১৯৮২ সালে দিল্লিতে। গোলদাতা আশীষ ভদ্র ও বাদল রায়। আশীষ স্মৃতিচারণায় বলছিলেন, ‘দ্বিতীয় গোলটি আমার মাইনাসে বাদলদা করেন। কখনো ভোলার নয় সেই গোল।’

১৯৮৯ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ঢাকায় থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-১ জয়ে সৈয়দ রুম্মন বিন ওয়ালী সাব্বির দারুণ এক গোল করেছিলেন। থাইল্যান্ডের বিপক্ষে এরপর আর জয় নেই বাংলাদেশের। ২০১১ সালে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে লেবাননকে হারানো এমিলি ও মিঠুনের গোল দুটিও স্মরণীয় এবং জাতীয় দলের জন্য বিশেষ কিছু। ১৯৮৯ ইসলামাবাদ সাফ গেমসে নুরুল হক মানিক ভারতের বিপক্ষে দূরপাল্লার গোল করেন। তাতে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত ম্যাচ ড্র হয় ১-১ গোলে।

১৯৮০ সালে এশিয়া কাপে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে আশরাফ উদ্দিন চুন্নুর গোল আছে। বক্সের মাথায় বল রিসিভ করে শরীরের দোলায় ঘুরে ডান পায়ে দুর্দান্ত সেই গোলটি করেছিলেন। ১৯৮৫ সালের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে ঢাকায় সেই চুন্নুই ফ্রি–কিকে গোল করেন। একই বছর ঢাকা সাফ গেমসের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দূরপাল্লার গোলটিকে নিজের সেরা গোল বলে মনে করেন শেখ আসলাম, ‘এ গোলটি আমার জীবনে আলাদা হয়ে থাকবে। গোলটির পর কলকাতায় ভারতীয় দলের গোলকিপার অতনু ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা দেখা হলে বলে, “দাদা, তুমি তো আমার ক্যারিয়ার শেষ করে দিলে!”’ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভাগ্যর শিকে ছেঁড়েনি। হারতে হয় টাইব্রেকারে।

২০০৩ ঢাকা সাফে ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ৯০ মিনিট পর্যন্ত ১-১। ৯৮ মিনিট মাঝমাঠের একটু সামনে বাঁ পাশে একজনকে কাটিয়ে মুন্নার দূরপাল্লার শটে ‘গোল্ডেন’ গোল। ভারতকে হতভম্ব করে ফাইনালে ওঠা বাংলাদেশ জিতে নেয় প্রথম সাফ শিরোপাও। এর আগে ১৯৯৯ কাঠমান্ডু সাফ গেমসে জেতে প্রথম সোনা। ফাইনালে নেপালের বিপক্ষে মতিউর মুন্নার কর্নার, জটলায় আলফাজ আহমেদের টোকায় ইতিহাস। দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান। একই গেমসে সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষ সুপার সাব টিপুর গোল কখনো ভোলার নয়।

১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে চার জাতি ট্রফি জয়টা তো বাংলাদেশর ফুটবলে সোনার অক্ষরেই লেখা আছে। ফাইনালে স্বাগতিকদের ২-১ গোলে হারায় মোনেম মুন্নার বাংলাদেশ। প্রথম গোলটি করা কানাডাপ্রবাসী মামুন জোয়ার্দার কদিন আগেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘ওই গোলটিই আমার জীবনের স্মরণীয়।’ আন্তর্জাতিক ফুটবলে দেশের বাইরে বাংলাদেশের প্রথম কোনো ট্রফি জয় সেটি। ফাইনালে জয়সূচক গোল করেন ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব। তাঁর স্মৃতিচারণা, ‘বাঁ দিক থেকে আসা ক্রসে হেডে গোলটি করেছিলাম।’

১৯৭৩ সালের মারদেকায় তৎকালীন বার্মার কাছে ৩ গোল খেয়ে বাংলাদেশের হয়ে এক গোল শোধ দেন কাজী সালাউদ্দিন। রাইট উইং দিয়ে ঢুকে দূর থেকে লক্ষ্যভেদ। ১৯৭৫ সালের মারদেকায় হংকংয়ের কাছে বাংলাদেশ ৯-১ গোলে উড়ে যায়। সেই ম্যাচেও বাংলাদেশের একমাত্র গোলটি সালাউদ্দিনের। ৯ গোলে হারা ম্যাচে এক গোলের কী আর মূল্য থাকে! কিন্তু ওই এক গোলেই সালাউদ্দিনের জীবন ঘুরে যায়। হংকংয়ে পেশাদার ফুটবল খেলার আমন্ত্রণ পান তখনই। সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমি এই দুটি গোলই বেশি মনে রেখেছি।’

১৯৭৩ সালের মারদেকায় থাইল্যান্ডের বিপক্ষে গোল করে ইতিহাসে নাম লেখান এনায়েতুর রহমান খান। এটিই বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক গোল। গোলটি তৈরি করে দেওয়া কক্সবাজারের ফুটবলার সুনীল দে কয়েক বছর আগে চট্টগ্রাম এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার চিপ থেকে এনায়েত ভাই গোল করেন। তিনি বলতেন, “সুনীল তোমার চিপ থেকে গোল করেছি। এটা কিন্তু সবাইকে বলবে।”’