খেলার সেই মুহূর্তগুলো কাঁদিয়েছিল বাংলাদেশকে

খেলা অনেকবারই কাঁদিয়েছে বাংলাদেশকে। ছবি: প্রথম আলো
খেলা অনেকবারই কাঁদিয়েছে বাংলাদেশকে। ছবি: প্রথম আলো
>ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত কাঁদিয়েছিল বাংলাদেশের খেলাপ্রেমীদের। খেলাটা তখন নিছক খেলা হয়ে দেখা দেয়নি তাদের কাছে। দেখে নিন সে মুহূর্তগুলো

আচ্ছা, ২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭ গোল হজম করার পর ব্রাজিলের মানুষের মনের অবস্থা কেমন ছিল!

তাঁরা যে সেদিন কতটা হতাশ ছিলেন, সেটি আমরা সবাই জানি। গ্যালারিতেই তো খেলা চলার মধ্যেই পড়ে গিয়েছিল কান্নার রোল। এই ব্রাজিলীয়রাই ১৯৫০ বিশ্বকাপের ফাইনালে উরুগুয়ের কাছে অপ্রত্যাশিত হারের পর কী করেছিলেন! সেদিন রিও ডি জেনিরোর মারাকানা স্টেডিয়ামের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করার দুঃখজনক কাহিনিও আমরা পড়েছি, জেনেছি বছরের পর বছর। আজও নাকি সেই ব্যর্থতা বিষাদে ছেয়ে দেয় ব্রাজিলীয়দের মন–প্রাণ।

২০১৬ কোপা আমেরিকার ফাইনালে টাইব্রেকারে লিওনেল মেসির সেই মিসের ঘটনাও নিশ্চয়ই আর্জেন্টিনার মানুষকে শোকে মূহ্যমান করেছিল। ক্রিকেটের কথাই ধরুন, ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ল্যান্স ক্লুজনার আর অ্যালান ডোনাল্ড মিলে ওই একটি রান নিতে গিয়েই যখন ব্যর্থ হলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল!

খেলার হার–জিৎ থাকলেও অনেক সময় খেলাই যখন জাতীয় আশা–আকাঙ্খা আর গৌরবের প্রতীক হয়ে ওঠে, তখন কোনো জাতির জীবনে এমন হতাশা আর বিষাদের মুহূর্ত আসতেও পারে। ক্রীড়াক্ষেত্রে দেশ হিসেবে খুব বেশি অর্জন বাংলাদেশের নেই। কিন্তু অনেক সময় খেলার দুনিয়ায় ছোটখাট অর্জনই এ দেশের মানুষকে আনন্দের সাগরে ভাসিয়েছে। আবার এই খেলাই এদেশের মানুষের হৃদয় ভেঙেছে অনেকবার। পেছনে ফিরে সে হতাশা আর বিষাদের মুহূর্তগুলো দেখে নিলে কেমন হয়?

সাফ গেমস ফুটবল ফাইনাল, ১৯৮৫
সেবার বাংলাদেশে ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন ইমতিয়াজ সুলতান জনি। শ্বাসরূদ্ধকর ফাইনালে ভারতের কাছে টাইব্রেকারে হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ইমতিয়াজ সুলতান একবার বর্ণনা করেছিলেন হারের সেই মুহূর্তটি, ‘আমরা টাইব্রেকারে শট মিস করেছি। খুব সম্ভবত ইউসুফ ভাই শটটা বারের ওপর দিয়ে মেরেছেন। আমি মাঝমাঠে দলের অন্য খেলোয়াড়দের দিকে বসা। একবার গ্যালারির দিকে চাইলাম। দেখি ঢাকা স্টেডিয়ামের পুরো গ্যালারি স্তব্ধ। সেদিন টিম বাসে করে হোটেলে ফেরার সময় নিস্তব্ধ এক ঢাকা দেখেছিলাম। তেমনটা আগে কখনো দেখিনি।’

জনি নিজেও কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। কোচ সালাউদ্দিনের কাঁধে মাথা রেখে জনি কাঁদছেন—এমন একটা ছবি সে সময় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সাফ গেমসে অনেকবারই ফাইনালে উঠে বাংলাদেশ হেরেছে, কিন্তু পঁচাশির সাফের মতো আর কখনোই মানুষকে ভেঙে পড়তে দেখা যায়নি। হতে পারে সেটি ঘরের মাঠে আয়োজন ছিল বলে। মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল ফুটবল দলের সাফল্যের জন্য। বিশ্লেষকদের অনেকেরই ধারণা, পঁচাশির সাফে ভারতকে হারিয়ে ফুটবলে সোনা জিতলে এ দেশের ফুটবলের ইতিহাসটা অন্যভাবেই লেখা হতো।

ম্যাচে সেদিন প্রথমে শিশির ঘোষের আচমকা গোলে ভারত এগিয়ে গিয়েছিল। এরপর ভারতকে চেপে ধরে বাংলাদেশ। শেখ আসলাম বক্সের মাথা থেকে তীব্র শটে ভারতীয় গোলরক্ষক অতনু ভট্টাচার্যকে পরাস্ত করেন। ম্যাচের ৯০ আর অতিরিক্ত ৩০ মিনিট দুর্দান্ত খেলা বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরাই টাইব্রেকারে একের পর এক মিস করেন। সেদিন শট মিস করেছিলেন আসলাম, ইউসুফদের মতো তারকারা।

ফুটবলে অভাবনীয় ব্যর্থতা, ১৯৯৩ সাফ গেমস
সেবারও ঘরের মাঠে সাফ গেমস। ফুটবল নিয়ে বিরাট প্রত্যাশা। সাফ গেমস এখন রঙ হারালেও আশি–নব্বইয়ের দশকে এটিই ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ক্রীড়াযজ্ঞ। আর ফুটবলে সোনা জেতার স্বপ্নটা তো বাংলাদেশের ছিল প্রথম আয়োজন থেকেই। ১৯৯৩ সালে ঘরের মাঠে ষষ্ঠ সাফ গেমসে খুব ভালো প্রস্তুতি ছিল বাংলাদেশের। সুইস কোচ ওল্ডরিখ সোয়াবের অধীনে সে সময়ের প্রেক্ষাপটে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করেই হয়েছিল প্রস্তুতি। দলটাও ছিল খুবই শক্তিশালী।

কিন্তু মূল প্রতিযোগিতা শুরুর প্রথম দিনই মিরপুর স্টেডিয়ামে মালদ্বীপের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে বসে বাংলাদেশ। সে সময় মালদ্বীপের সঙ্গে বাংলাদেশের ফুটবলে মানের পার্থক্য ছিল বিশাল। ওই ড্রটা দেশের ফুটবলপ্রেমীদের এক বড় ধাক্কাই দিয়েছিল। দুদিন পর ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে নেপালের কাছে ১–০ গোলে হেরে সাফ গেমসের ফুটবল থেকে বিদায় নেয় বাংলাদেশ। সোনার প্রত্যাশার পর শূন্য হাতে বিদায় হতাশাগ্রস্ত করেছিল দেশের ফুটবলপ্রেমীদের।

১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে নেপালের কাছে হারের সেই সন্ধ্যাটা উঠে এসেছে জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখাতেও। তাঁর ‘সকল কাঁটা ধন্য করে’বইয়ের ‘খেলা’ নামের নিবন্ধে নেপালের বিপক্ষে সেই হারের পরের সময়ের বর্ণনা হুমায়ুন দিয়েছেন এভাবে, ‘…পরাজয়ের দুঃখে রিকশাওয়ালা কাতর। শুধু রিকশাওয়ালা নয়, পুরো জাতি আজ বিষন্ন। এই বিষন্নতা কি আমাদের লাখ টাকা দামী খেলোয়াড়দের স্পর্শ করেছে? আজ তাঁরা কেমন আছেন সোনার গাঁ হোটেলে? তাঁরা কি সত্যিই জানেন বাতাসভরা ছোট একটি চামড়ার বল নিয়ে ছোটাছুটির এই খেলার সঙ্গে গোটা জাতির আত্মা মিশে যেতে পারে?’


বিশ্বকাপ স্বপ্ন হলো না পূরণ, আইসিসি ট্রফি ১৯৯৪
আইসিসি ট্রফিতে শীর্ষ তিনে থাকতে পারলেই স্বপ্নের বিশ্বকাপ—১৯৯২ সালে আইসিসির এই ঘোষণার পরপরই নড়েচড়ে বসেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (সে সময় অবশ্য নাম ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড)। বিশ্বকাপে খেলতে হবে! ভারত থেকে আনায় হয় হাইপ্রোফাইল কোচ মহিন্দর অমরনাথকে। কেনিয়ায় ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিটি অনেক বড় অর্জনের হাতছানি দিয়েছিল বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে।

শীর্ষ তিনের মধ্যে থাকাটা বিশাল কোনো প্রত্যাশাও ছিল না। আগেরবার অর্থাৎ ১৯৯০ সালে হল্যান্ডে আইসিসি ট্রফিতে সেমিফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। সে সময়ের শক্ত প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়েকে চেপেও ধরেছিল। মাত্র ২৪৭ রান তাড়া করতে না পারার ব্যর্থতায় ফাইনালে ওঠা হয়নি।

’৯৪-তে কেনিয়াতে পথের কাঁটা জিম্বাবুয়েও ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশ পারেনি। গ্রুপ পর্বে আমিরাতের কাছে হারার পর দ্বিতীয় রাউন্ডে হল্যান্ডের ২০৬ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে পারেননি আকরাম, মিনহাজুল, আমিনুল, ফারুকরা। দ্বিতীয়র রাউন্ডের দ্বিতীয় ম্যাচটি ছিল কেনিয়ার বিপক্ষে। সে ম্যাচে প্রথমে ব্যাটিং করে বাংলাদেশের বাজে বোলিংয়ের পুরো সুযোগ নিয়ে কেনিয়া ৫০ ওভারে তুলে ফেলে ২৯৫ রান। আজ থেকে ২৬ বছর আগের ক্রিকেটে ২৯৫ রান তাড়া করার খুব বেশি উদাহরণ ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাটিং বীরত্বে জয়ের খুব কাছেই চলে গিয়েছিল সে ম্যাচে। মাত্র ১৩ রানে হেরে আইসিসি ট্রফি থেকে সেদিন বিদায় নিতে হয় বাংলাদেশকে। ম্যাচটা জিতলে সেবার বিশ্বকাপ স্বপ্নটা টিকে থাকত বাংলাদেশের। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সেই সন্ধ্যাটা আজও বিষাদের স্মৃতি হয়ে আছে বাংলাদেশের খেলাপ্রেমী মানুষের কাছে।


শিরোপা থেকে ২ রান দূরে, এশিয়া কাপ ক্রিকেট ২০১২
২০১২ সালের এশিয়া কাপ ফাইনাল। সাম্প্রতিক সময়ে এটাই কি দেশের খেলাধুলার সবচেয়ে বিষাদময় অধ্যায় হয়ে আছে? ইতিহাস গড়ে ফাইনালে উঠে সাকিব, তামিম, মাশরাফিরা যখন নতুন ইতিহাস গড়ার স্বপ্নে বিভোর, স্বপ্নের খুব কাছাকাছি পৌছেও সেটি ছোঁয়া হয়নি তাঁদের। পাকিস্তানের কাছে মাত্র ২ রানে হেরে সেদিন কেঁদেছিলেন ক্রিকেটাররা। সেই রাতে কেঁদেছিল গোটা বাংলাদেশই।

ভারত আর শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠা বাংলাদেশ সেদিন পাকিস্তানকেও আটকে দিয়েছিল ২৩৬ রানে। সহজ লক্ষ্যে ব্যাটিংটাও মন্দ হয়নি। সাকিব খেলেছিলেন দারুণ এক ইনিংস। কিন্তু শেষটা বিজয়োল্লাসে হয়নি। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে সাকিব–মুশফিকদের কান্নার সেই ছবি এখনো অলক্ষ্যে কাঁদায় বাংলাদেশের খেলাপ্রেমী মানুষকে।

বেঙ্গালুরুর ভুতুড়ে রাত, টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৬
একটি ম্যাচ যে জাতীয় ট্র্যাজেডি হয়ে উঠতে পারে, সেটি দেখিয়েছিল ২০১৬ সালের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ–ভারত ম্যাচ। জয়ের খুব কাছে গিয়ে সেদিন ১ রানে হেরেছিল বাংলাদেশ। হারটা বড় কথা নয়, যে ধরনের ভুতুড়ে কারবার সেদিন বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে হয়েছিল, সেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা নেই। শেষ ওভারে ৩ বলে ২ রান নিতে পারেননি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। শেষ ৩ বলে ৩ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ ১ রানে হেরে যায় ম্যাচটি।

সেই রাত ছিল বিষাদময়। ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখে ছিল কান্না। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ হয়তো অনেক ম্যাচ জিতবে, অনেক গৌরবের সাক্ষী হবে ক্রিকেট, কিন্তু বেঙ্গালুরুর সেই রাতটি কোনো দিন ভুলতে পারবেন না বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। সেটি হয়তো চিরদিনের কান্নাই হয়ে রইবে।