যেদিন স্বপ্নলোকের চাবি পেয়েছিল বাংলাদেশ

খালেদ মাসুদের ৭০ রানের ইনিংসই বড় ভূমিকা রেখেছিল বাংলাদেশকে বিশ্বকাপে তুলতে। ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়ে পুরস্কার নিচ্ছেন তিনি। ছবিটি কুয়ালালামপুরের কিলাত ক্লাব মাঠে উপস্থিত থেকে তুলেছিলেন আলোকচিত্রী শামসুল হক
খালেদ মাসুদের ৭০ রানের ইনিংসই বড় ভূমিকা রেখেছিল বাংলাদেশকে বিশ্বকাপে তুলতে। ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়ে পুরস্কার নিচ্ছেন তিনি। ছবিটি কুয়ালালামপুরের কিলাত ক্লাব মাঠে উপস্থিত থেকে তুলেছিলেন আলোকচিত্রী শামসুল হক

৯ এপ্রিল, ১৯৯৭। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের যে কটি দিন সোনার হরফে লেখা, এই দিনটি তার একটি। এই দিনে যে বাংলাদেশ হাতে পেয়েছিল স্বপ্নলোকের চাবি । ২৩ বছর আগের এ দিনেই পূরণ হয়েছিল বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নপূরণের আনন্দে, উচ্ছ্বাসে ভেসেছিল গোটা দেশ।

১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি যত শেষ দিকে আসছিল, ততই আনন্দের বড় বড় উপলক্ষ্য তৈরি হচ্ছিল। ৪ এপ্রিল হল্যান্ডের বিপক্ষে আকরাম খানের অপরাজিত ৬৮ রানের অনবদ্য ইনিংসটা বাংলাদেশকে তুলে দিয়েছিল সেমিফাইনালে। তবে তখনো নিশ্চিত হয়নি বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ নিশ্চিত করতে হলে সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডকে হারাতে হবে, সমীকরণটা ছিল সরল।

টস জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিং করতে পাঠায় স্কটল্যান্ড। আতহার আলী খান-নাঈমুর রহমানের উদ্বোধনী জুটি অবশ্য ভালো শুরু এনে দিতে পারেনি। ১২ রানেই ভাঙে ওপেনিং জুটি। এই ম্যাচে সবচেয়ে বড় 'ট্যাকটিকাল মুভ'টা ছিল খালেদ মাসুদকে তিন নম্বরে নামানো। প্রায় টুর্নামেন্টজুড়েই মাসুদ ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেছেন। হল্যান্ডের বিপক্ষে নেমেছিলেন আটে। সেই মাসুদকে সেমিফাইনালের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে পদোন্নতি দিয়ে নামানো হলো তিনে। গর্ডন গ্রিনিজ, গাজী আশরাফ হোসেন ও আকরাম খানের সমন্বয়ে গড়া বাংলাদেশ দলের ‘থিংক ট্যাঙ্কে’র ফাটকটা দারুণভাবে কাজে লেগে যায়।

খালেদ মাসুদ তিনে নেমে খেলেন ৭০ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। আমিনুল ইসলামকে নিয়ে তৃতীয় উইকেটে গড়েন ১১৫ রানের গুরুত্বপূর্ণ এক জুটি। আমিনুলের ব্যাট থেকে আসে ৫৭। সাতে নানা মিনহাজুল আবেদীনের ৩১ বলে ৩৯ আর মোহাম্মদ রফিকের ৭ বলে ১৬ রানের ঝড়ে বাংলাদেশ পেয়ে যায় ৭ উইকেটে ২৪৩ রানের ভালো স্কোর। ম্যাচটি এক দিনের হলেও বৃষ্টিবাধায় সেটি গড়ায় দ্বিতীয় দিনে। প্রথম দিনের খেলা শেষেই বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মুখ দেখেই নাকি বোঝা যাচ্ছিল, সেমিফাইনাল তাঁরা জিততেই যাচ্ছেন। কেন সবাই আত্মবিশ্বাসী, সেটির কারণ খুঁজে পাওয়া যায় ওই সময় মালয়েশিয়াতে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলা দলের ম্যানেজার গাজী আশরাফের কথায়, ‘ইনিংস শুরু করার সময় জিজ্ঞেস করলে বলতাম ২৩০ রান করতে পারলেই খুশি। এই উইকেটে এই মন্থর আউটফিল্ডে ২৪৩ রান আশাই করিনি।’

প্রথম ইনিংসের পর তাই ‘ভোরের কাগজে’র হয়ে ম্যাচ কাভার করতে যাওয়া উৎপল শুভ্র লেখেন, ‘শুধু আবেগের কাছে আত্মসমার্পণ করে নয়, ক্রিকেটীয় বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করার পরও বলে ফেলা যায়, বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে।’ ক্রিকেটে ভবিষ্যৎদ্বাণী করা বিপজ্জনক জেনেও তিনি সেটি করেছিলেন পরিসংখ্যানের ওপর আস্থা রেখেই। টুর্নামেন্টে এর আগের ৮০টি ম্যাচে ২৪০ রানের বেশি তাড়া করে জেতেনি কোনো দল। সেবার বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বোচ্চ রানই হয়েছে ১৭১।

তবে ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা বলেই একটা রাত ভীষণ উৎকণ্ঠায় কাটে দেশবাসীর। সেমিফাইনালের প্রথম দিনে বাংলাদেশের কাব্যিক এক জয়ের আশায় মালেয়েশিয়ার কিলাত ক্লাব মাঠে আসেন ৩ হাজার বাংলাদেশি দর্শক। বাংলাদেশ যদি ফাইনালে ওঠে আরও একদিন ছুটি নিতে হবে অফিস থেকে, এ কারণে দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ ৯ এপ্রিল বেশিরভাগ দর্শকই আসেননি মাঠে। অনেকটা দর্শকশূন্য মাঠে আকরাম খানের দল উপহার দেয় কাব্যিক সেই জয়। বাংলাদেশের স্পিন বিষে নীল হয়ে স্কটিশরা ৪৪.৫ ওভারে অলআউট হয় ১৭১ রান তুলে। মোহাম্মদ রফিক নেন ৪ উইকেট; এনামুল হক ২টি আর নাঈমুর ১টি।

স্কটল্যান্ডকে ৭২ রানে হারিয়ে শুধু ফাইনালেই নয়, বাংলাদেশ পেয়ে যায় বিশ্বকাপের টিকিট। যে টিকিট পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৮টি বছর। ১৮ বছরের অপেক্ষা শেষের সেই গল্পটার ২৩ বছর পূর্তি আজ। বছর, যুগ, কালের পরিক্রমায় যতই এগোতে থাক বাংলাদেশ ক্রিকেট, এসব স্মৃতি ধূসর হবে না কখনোই। বাংলাদেশ ক্রিকেটের মানচিত্র বদলে দেওয়া এই গল্পগুলো ধূসর হওয়ারও নয়।