ইতিহাসের '৯ এপ্রিল' ফিরে আসুক বারবার

৯ এপ্রিল, ১৯৯৭। বিশ্বকাপের স্বপ্ন পূরণ। উল্লাসে মেতেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটার ও ক্রিকেট কর্মকর্তারা। সেই মুহূর্তটিকে ক্যামেরায় ধরে রেখেছিলেন প্রথম আলোর বিশেষ আলোকচিত্রী শামসুল হক।
৯ এপ্রিল, ১৯৯৭। বিশ্বকাপের স্বপ্ন পূরণ। উল্লাসে মেতেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটার ও ক্রিকেট কর্মকর্তারা। সেই মুহূর্তটিকে ক্যামেরায় ধরে রেখেছিলেন প্রথম আলোর বিশেষ আলোকচিত্রী শামসুল হক।

ক্যালেন্ডারের একটা তারিখ—আর এ তারিখটার কী মাহাত্ম্য বাংলাদেশের ক্রিকেটে! ৯ এপ্রিল ১৯৯৭, বিশ্বকাপের স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল আমাদের। আর ঠিক ৯ বছর পর ২০০৬ সালের ৯ এপ্রিল ক্রিকেট ইতিহাসের মহাক্রমশালী এক দলের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো হেলায় এক শতক হাঁকিয়েছিলেন বাংলাদেশের এক তরুণ। এ তারিখ বাংলাদেশের ক্রিকেট মনে রাখবে যুগ যুগান্তর।

আজ থেকে ২৩ বছর আগে মালয়েশিয়ার কিলাত ক্লাব মাঠ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিটি শহর, পাড়া, মহল্লা ভেসে গিয়েছিল অনাবিল এক প্রাপ্তির এক আনন্দে। ক্রিকেটে আমরা বিশ্বকাপ খেলব—এমন স্বপ্ন আমরা দেখে আসছিলাম অনেক দিন আগে থেকে। সেই স্বপ্নটাই সত্যি হয়েছিল সেদিন। আইসিসি ট্রফিতে স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নপূরণের সে দিনটি এ দেশের মানুষ দেখেছিল অদ্ভুত এক ঐক্য। সব বিভেদ ভুলে রং খেলা আর বিজয় মিছিলে শামিল হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। অফিস-আদলতে রাশভারী বস সেদিন তাঁর সব অধীনস্তদের মিষ্টিমুখ করিয়েছিলেন। স্কুল-কলেজের রাগী শিক্ষকেরাও সেদিন মেনে নিয়েছিলেন ছাত্র-ছাত্রীদের বিশৃঙ্খলা। ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষের মুখে সেদিন একটাই কথা—আমরা বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছি। কী এক জাদুর কাঠি যেন সেদিন আমাদেরকে এনে দিয়েছিলেন ক্রিকেট খেলোয়াড়েরা। যে জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় নিমেষে সবাই ভুলে গিয়েছিল দ্বন্দ্ব, রেষারেষি, ঝগড়া—সবকিছু। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জীবিকার তাড়নায় থাকা শ্রমিক ভাই-বোনেরা সেদিন বাড়ি ফিরেছিল হাসি নিয়ে। চৈত্রের ঘামে সিক্ত ওই রিকশাওয়ালাটিও সেদিন আনন্দের আতিশয্যে কোনো কোনো যাত্রীকে বলে দিয়েছিলেন—যান ভাই ভাড়া লাগবে না! সেদিন বাড়ির বাইরে গিয়েছিলেন কিন্তু শরীর রঙে রাঙিয়ে ফেরেননি—এমন মানুষ ছিলেন বিরল। উচ্ছ্বাসের সাক্ষী কোনো মানুষের পক্ষে ১৯৯৭ সালের ৯ এপ্রিল তারিখটা ভুলে যাওয়া এক কথায় অসম্ভব।
এর ঠিক ৯ বছর পর দৃষ্টি ফেরান। ২০০৬ সালের ৯ এপ্রিল। এত দিনে বিশ্বকাপ খেলা হয়ে গেছে। পাওয়া হয়ে গেছে টেস্ট মর্যাদাও। ক্রিকেটের শীর্ষ দেশগুলোর বিপক্ষে দুই-একটা অবিস্মরণীয় জয়ও পাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ক্রিকেট দুনিয়ায় পদচারনাটা খুব স্বস্তির হচ্ছে না বাংলাদেশের। এই সময় শেন ওয়ার্ন, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, রিকি পন্টিংদের অস্ট্রেলিয়া দল এলে বাংলাদেশ সফরে। সে সময় অস্ট্রেলীয় দলটা কেমন ছিল, সেটা নতুন করে বলে দেওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীর প্রায় সব দলই তাদের কাছে হারছে। দলটাও যেন জিততে জিততে ক্লান্ত। ক্রিকেট দুনিয়ার যাবতীয় হিসেব তখন অস্ট্রেলীয় দলকে বাদ দিয়েই। এ সময় ক্রিকেটে ধুঁকতে থাকা, অনভিজ্ঞ বাংলাদেশ তাদের বিপক্ষে কী করবে! যদিও তার ঠিক এক বছর আগে কার্ডিফে দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে অস্ট্রেলিয়াকেই হারিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সেটি তো ৫০ ওভারের ক্রিকেটে, ক্রিকেটের আসল লড়াই পাঁচ দিনের টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টিকে থাকা কী সম্ভব?

২০০৬ সালের ৯ এপ্রিল। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দারুণ সেঞ্চুরি করলেন শাহরিয়ার নাফীস। ছবি: এএফপি
২০০৬ সালের ৯ এপ্রিল। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দারুণ সেঞ্চুরি করলেন শাহরিয়ার নাফীস। ছবি: এএফপি

অসম্ভব ভাবনার মধ্যেই ২০০৬ সালের ৯ এপ্রিলের সকালে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল বাংলাদেশ। টসে জিতে ব্যাটিং বেছে নিলেন বাংলাদেশের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। ব্রেট লি, স্টুয়ার্ট ক্লার্ক, জেসন গিলেস্পি, শেন ওয়ার্নদের বোলিং যেখানে সমীহ করছে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানরা, সেখানে বাংলাদেশের এক তরুণ এই মহীরূহদের বিপক্ষে কী অবলীলায় না ব্যাটিং করে গেলেন! ওয়ার্ন, লি, গিলেস্পিদের সঙ্গে কপাল কুঁচকালেন পন্টিং, গিলক্রিস্টরা। কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। তাঁরা যে কিছুতেই আউট করতে পারছিলেন না ২০ বছরের সেই তরুণকে। শাহরিয়ার নাফীস নামের সেই তরুণ সেদিন খেললেন ১৩৮ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। ১৮৯ বলে ২৭৪ মিনিট ব্যাটিং করে নাফীসের সেই ইনিংসে ১৯টি বাউন্ডারি যেন ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অবজ্ঞা আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের এক একটি দাঁতভাঙা জবাব।
নাফীসের সেই ইনিংসের সঙ্গে ছিল হাবিবুলের ৭৬ আর রাজিন সালেহর ৬৭। বাংলাদেশ গড়ল ৪২৭ রানের প্রথম ইনিংস। কিন্তু চমক তো আরও অপেক্ষা করছিল অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে। মোহাম্মদ রফিকের অসাধারণ বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়া গুটিয়ে গেল ২৬৯ রানেই। ৬২ রানে ৫ উইকেট নিলেন রফিক। বড় লিড নিয়েও সে টেস্টটা শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি বাংলাদেশ। পারেনি ড্র করতেও। দ্বিতীয় ইনিংসে ১৪৮ রানে গুটিয়ে গিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে ৩০৭ রানের লক্ষ্যমাত্রায় ব্যাটিং করিয়ে শেষ পর্যন্ত হার ছিল ৩ উইকেটে। রিকি পন্টিংয়ের অসাধারণ এক ইনিংস না হলে শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ফল কী হতো, সেটা অবশ্য না বললেও চলছে। তবে এটা ঠিক ২০০৬ সালের ৯ এপ্রিল শুরু হওয়া অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই টেস্টে বাংলাদেশের ক্রিকেট দিয়েছিলেন উঠে আসারই বার্তা। সামনে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলারই বজ্র কণ্ঠের ঘোষণা। টেস্টটা শেষ পর্যন্ত জিতে গেলে আজকের এই লেখাটা হয়তো অন্যরকমই হতো। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত নাফীসের সেই ইনিংস আর ফতুল্লার টেস্ট হয়ে আছে গর্ব করার মতো ঘটনা হয়েই।
২০২০ সালের ৯ এপ্রিল। করোনা-আক্রান্ত গোটা দুনিয়া। দেশে বাড়ছে আক্রান্তের হার। গোটা বিশ্বে মৃত্যুর মিছিল। একটা ছোট্ট ভাইরাস অচেনা শহরগুলোকে করে তুলেছে অচেনা, কেমন যেন ভুতুড়ে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা গেছে থমকে। গৃহবন্দী মানুষের সময় কাটছে করোনা-মুক্ত সময়ের স্মৃতিচারণে। এমন একটা দিনে, এমন একটা সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এ দুটি অর্জনের গল্প একটু হলেও বিষণ্ন মনটাকে চাঙা করে। লড়াই করতে সাহস জোগায়। করোনার এই সময় ক্রিকেট গৌণ এক বিষয় হলেও লড়াই আর অর্জনের গল্পটা সব সময়ই একইরকম।