ফুটবল বন্ধ করে দিয়েছিল দুই ভাইয়ের মুখ দেখাদেখি

দুই ভাই মনোয়ার হোসেন নান্নু ও শামসুল আলম মঞ্জুর সেই ঐতিহাসিক করমর্দন। ছবি সংগৃহীত
দুই ভাই মনোয়ার হোসেন নান্নু ও শামসুল আলম মঞ্জুর সেই ঐতিহাসিক করমর্দন। ছবি সংগৃহীত
৪০ বছরের বেশি সময় আগে বাংলাদেশের ফুটবল কাঁপিয়েছিলেন দুই সহোদর মনোয়ার হোসেন নান্নু ও শামসুল আলম মঞ্জু। দুই ভাইয়ের দ্বৈরথ চিরকালীন গল্প হয়ে আছে এ দেশের ফুটবলে


রূপকথার মতোই গল্পটা। দুই ভাইয়ের গল্প। একই বাড়িতে বেড়ে ওঠা দুই ভাইই একসময় হয়ে উঠলেন ফুটবলে দেশের দুই সেরা ক্লাবের অধিনায়ক। অথচ চারিত্রিকভাবে দুজন কখনোই এক ছিলেন না। বড় ভাই ছিলেন বেশ শান্ত মেজাজের। ছোটটার মেজাজ বেশ তিরিক্ষি।

খেলার মাঠে দুজন মুখোমুখি হলে ওই ছোটটির জন্যই বেশি চিন্তায় থাকতেন মা-এই বুঝি কোনো অনাসৃষ্টি ঘটল। দুই ছেলের খেলা আছে শুনলেই বসে যেতেন জায়নামাজে-সব যেন ঠিক থাকে। দুজনই যেন বাড়ি ফেরে হাসিমুখে। আজ থেকে ৪০ বছরেরও বেশি সময় আগে বাংলাদেশের ফুটবলে এই দুই ভাইয়ের গল্প আকর্ষণ ছড়াত ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে। আবাহনী-মোহামেডান, দেশের ফুটবলের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াই মানেই যেন সেটি হয়ে উঠত দুই ভাইয়ের লড়াইয়ে। মাঠে দুই ভাইয়ের হাত মেলানোর আপাত স্বাভাবিক ঘটনাটিও হয়ে উঠত সংবাদমাধ্যমের কাছে অনেক বড় কিছু। মায়ের কায়োমনপ্রার্থনা থাকত-ম্যাচটা যেন ড্র হয়!

সত্তরের দশকে বাংলাদেশের ফুটবলের দুই বড় তারকা ছিলেন দুই ভাই-মনোয়ার হোসেন নান্নু আর শামসুল আলম মঞ্জু। পাঁচ বছরের ছোট-বড়। দুজনই বেছে নিয়েছিলেন ফুটবলকে। দুজনই হয়েছিলেন দেশের ফুটবলের বড় তারকা। প্রথমজন আবাহনীর, দ্বিতীয়জন মোহামেডানের। বাড়িতে একে অন্যের হরিহর আত্মা। নান্নু, মঞ্জুই মাঠে হয়ে উঠতেন একে অপরের ‘শত্রু’। এ নিয়ে দর্শকদের কৌতূহল ছিল এন্তার। আবাহনী-মোহামেডানের খেলা শেষ করে তাঁরা কি এক সঙ্গে বাড়ি ফিরতেন? ম্যাচের আগে দিয়ে তাঁরা দুই ভাই কী করতেন! ম্যাচের পর বাড়ি ফিরে তাঁদের দুজনের আচরণই–বা কেমন হতো! আজকের পাঠকদের কাছে রূপকথার মতো মনে হতে পারে, কিন্তু নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথটা ছিল এমন চেহারারই। দুই দলের সমর্থকেরা যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দিতেন মুখোমুখি লড়াইয়ের আগে-পরে। যে রেশ থেকে যেত ম্যাচ শেষ হওয়ার পরেও বেশ কয়েকদিন। স্বাধীনতার পর দেশের মানুষের কাছে যে রেষারেষিটা হয়ে উঠেছিল জীবনের এক অনাবিল উৎসব, দুই ভাই তাতে দিয়েছিলেন ভিন্ন এক মাত্রা। যে অনুষঙ্গগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে আবাহনী আর মোহামেডান পরিণত হয়েছিল দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীতে। মনোয়ার আর শামসুল ছিলেন সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গগুলোর একটি। দুই ভাইয়ের মুখোমুখি লড়াই, এই দ্বৈরথকে করে তুলেছিল মুখরোচক, আরও রোমাঞ্চকর।

আবাহনী-মোহামেডানের এই দ্বৈরথ দুই ভাইয়ের মধ্যে কি কোনো প্রভাব ফেলেনি? সেটি পড়াই স্বাভাবিক, কারণ তাঁরাও তো মানুষ। সত্তরের দশকের শেষ দিকে, ১৯৭৮ সালই হবে—দুই ভাইয়ের মধ্যে কথা বলাবলিও নাকি প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আবাহনী-মোহামেডানের লড়াইয়ের ঝাঁঝ ছিল এতটাই। এ সময়ে দুই সেরা দলের অধিনায়ক দুজন। ফুটবলীয় প্রতিপত্তিতে দুই ভাই তখন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী নিজেদের মধ্যেই। এমনিতেই নিজেদের ব্যক্তিগত আবেগকে তাঁরা একদিকে সরিয়ে রেখে প্রাধান্য দিতেন নিজ নিজ ক্লাবকেই। সব কিছুর আগে দল—এটাই ছিল দুজনের মূলমন্ত্র। তাতে যদি কোনো কারণে নিজেদের মধ্যে সম্পর্কটাও নষ্ট হয়ে যায়, তবে তা-ই হোক!

তাঁরা পত্রিকায় একে অন্যের বিপক্ষে বলেন। ‘মাইন্ড গেম’ বলে যাকে! মজার ব্যাপার হচ্ছে নান্নু-মঞ্জু অধিনায়ক হিসেবে যে তিনটি ম্যাচ একে অন্যের বিপক্ষে খেলেছেন, তিনটিই ড্র হয়েছে। অধিনায়কত্ব তাদের কাউকে একে অন্যের কাছে পরাজিত হতে দেয়নি। মা চাইতেন, ঠিক এমনটিই। ফুটবল বিধাতা নান্নু-মঞ্জুর মাকে বিমুখ করেননি।

দুজনের মিল-অমিল
আগেই বলা হয়েছে বড় ভাই মনোয়ার হোসেন নান্নু ছিলেন শামসুল আলম মঞ্জুর চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। দুজনের স্বাভাব ছিল পুরোপুরিই উল্টো। নান্নু শান্ত। মঞ্জু কিছুটা মেজাজি। মিল ছিল এক জায়গাতেই, দুজনেই ফুটবলার হয়েছিলেন। বড় ভাই দাপিয়ে বেরিয়েছেন মধ্য মাঠ, রক্ষণে। দেশের ফুটবল ইতিহাসের সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারই বলা হয় তাঁকে। ছোটভাই সব সময়ই খেলেছেন লেফটব্যাক পজিশনে।

সেই করমর্দন
১৯৭৮ সালের আবাহনী-মোহামেডানের লড়াই। এ সময় কোনো কারণে দুজনের মধ্যে কথা বলাবলি বন্ধ। দুজন দুই দলের অধিনায়ক। ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন দুই দলের কর্মকর্তারা। মাঠে দুই অধিনায়কের হাত মেলানোর রেওয়াজ। সেটি হচ্ছে কিনা, তার দিকে চেয়ে থাকবে গোটা দেশ। দুই ভাই যদি নিজেদের মধ্যে ঝগড়ার ব্যাপারটি মাঠেও টেনে আনেন, তাতে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাবে। দুই ভাই সেটি বুঝেছিলেন। মাঠে প্রথমে নান্নু হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, এরপর মঞ্জু। দেশের ফুটবলে আজও তা এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য হয়ে আছে।

দেশের ফুটবলের এ দুই ভাইয়ের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে ক্যানসার। ২০০৮ সালে প্রায় দশ বছর ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে অন্যলোকে পাড়ি জমিয়েছেন মনোয়ার হোসেন নান্নু। শামসুল আলম মঞ্জু অবশ্য আগেই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হয়েছেন। সেখানেই কাটছে তাঁর দিনমান। দুই ভাইয়ের এই গল্প বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের রোমাঞ্চ হয়েই থাকবে চিরকাল।