শুভ জন্মদিন ২২ গজের 'বংশীবাদক'

আজ জন্মদিন শ্রীলঙ্কার স্পিন কিংবদন্তি মুত্তিয়া মুরালিধরনের। ফাইল ছবি
আজ জন্মদিন শ্রীলঙ্কার স্পিন কিংবদন্তি মুত্তিয়া মুরালিধরনের। ফাইল ছবি
>বিস্কুট প্রস্তুতকারক কোম্পানির মালিক সিনাসামি মুত্তিয়া আর লক্ষ্ণীর ঘর আলো করে আসা ছেলেটির নাম রাখেন তাঁর দাদা পেরিয়াসামি সিনাসামি। কী সেই নাম? পরিবারের মুত্তিয়া উপাধির সঙ্গে আসল নামটি মুরালিধরন

বেচারা পেরিয়াসামি সিনাসামি লোকটি বেশ বিচক্ষণই ছিলেন বলতে হবে। আর না হলে জন্মের সময়ই কীভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে একদিন ক্রিকেট দুনিয়ায় পূজনীয় হবে তাঁর নাতি! অথবা জাদুকরী বাঁশির সুরে মাঝের ২২ গজে খ্যামটা-নাচন নাচাবেন বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানকে! যেমনটা পূজনীয় ছিলেন দেবতা শ্রীকৃষ্ণ। আর নিজের বাঁশির সুরে তিনি যেমনটা পাগলিনি করেছিলেন রাধাকে!

এটাই যি না হবে তাহলে কি প্রিয় নাতির নাম বেচারা পেরিয়াসামি সিনাসামি মুরালিধরন রাখেন! হ্যাঁ, মুত্তিয়া মুরালিধরনের কথাই বলা হচ্ছে। ১৯৭২ সালের এই দিনে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন দক্ষিণ ভারত থেকে আসা শ্রীলঙ্কার এক তামিল পরিবারে। বিস্কুট প্রস্তুতকারক কোম্পানির মালিক সিনাসামি মুত্তিয়া আর লক্ষ্ণীর ঘর আলো করে আসা ছেলেটির নাম রাখেন তাঁর দাদা পেরিয়াসামি সিনাসামি। কী সেই নাম সে তো এতক্ষণে জেনেই গেছেন-পরিবারের মুত্তিয়া উপাধির সঙ্গে আসল নামটি মুরালিধরন।

মুরালি সংগীতাঙ্গনের একটি বাদ্যযন্ত্রের নাম, যার মানে বাঁশি। সোজা বাংলায় বাঁশের বাঁশি! গরু চরাতে গিয়ে মনের সুখে এই বাঁশি বাজাতেন রাখাল কৃষ্ণ। তাঁর বাঁশির সুরে পাগল হয়ে যেত অনেকেই। যেমনটা হয়েছিলেন রাধা। কৃষ্ণের অনেক নাম। বাঁশি বাজাতেন বলে তাঁর একটি নাম ছিল মুরালিধরন বা বংশীবাদক।

তা ক্রিকেটের কৃষ্ণ বা বংশীবাদকের জন্ম হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল। কী করেছিলেন ক্রিকেটের এই বংশীবাদক? মাঝের ২২ গজে তাঁর বাঁশিতে (ক্রিকেট বল) খ্যামটা-নাচন নাচেননি, এমন ব্যাটসম্যান নেই বললেই চলে। কী এক জাদুকরী ঘূণির্তে তিনি বশীভূত করে রেখেছিলেন পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে।

ক্রিকেট খেলতে মুরালিধরন শুরু করেছিলেন সেই স্কুল জীবন থেকে। তবে রাখাল কৃষ্ণ যেমন বালক বয়স থেকেই বাঁশের বাঁশি বাজাতেন, মুরালির বেলায় বিষয়টি তেমন নয়। সেন্ট অ্যান্থনি কলেজে ক্রিকেট জীবনের শুরুতে তিনি মিডিয়াম পেস বোলিং করতেন। কিন্তু তাঁর স্কুল কোচ একদিন পরামর্শ দেন-মুরালি তুমি স্পিনের জাদুটা শেখ, সেটাতেই ভালো করবে। দ্বিতীয় কথা না বলে মুরালিও বাজাতে শুরু করে দিলেন স্পিন বোলিংয়ের বাঁশি। সেই যে শুরু আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

স্কুল ক্রিকেটের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রেখেছেন মুরালি ১৯৯২ সালে। ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর আগে টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক হয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও তাঁর বেশি উইকেট নেই আর কারও। তবে মহান এই ক্রিকেটারের যাত্রা থেমে যেতে পারত অকালেই, মাত্র ৮০টি টেস্ট উইকেটে!

১৯৯৫-৯৮৬ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া সফরে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার মুরালিকে টানা ‘নো’ বল দিয়ে যান। হেয়ারের অভিযোগ ছিল, মুরালি ‘থ্রোয়িং’ করছেন, তাঁর ডেলিভারি বৈধ নয়। কিন্তু সেই ধাক্কা সামলে উঠে মুরালি শ্রীলঙ্কার মূল বোলার হয়েছেন। মাত্র ৮৭ টেস্টে ছুঁয়েছেন ৫০০ উইকেটের মাইলফলক। ২০০৪ সালে কোটর্নি ওয়ালশের ৫১৯ উইকেটের রেকর্ড ভেঙে হয়েছেন টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি।

তবে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ডটি নিয়ে সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার শেন ওয়ানের্র সঙ্গে মুরালির প্রতিযোগিতা চলে অনেক দিন। অস্ট্রেলিয়ান স্পিনার ওয়ানের্র অবসরের পর ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে মুরালি তাঁর ৭০৮ উইকেটের রেকর্ডটি ভেঙে স্থায়ীভাবে ইতিহাসে নাম লিখিয়ে নেন। ২০০৯ সালে ভেঙে দেন ওয়ানডেতে ওয়াসিম আকরামের সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড। পরের বছর টেস্ট ক্রিকেটে নিজের পথচলার ইতি টেনে দেন মুরালি। বিদায়ী টেস্টে গড়েন অমলিন এক কীর্তির। প্রথম বোলার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে স্পর্শ করেন ৮০০ উইকেটের মাইলফলক। গলেতে সেই ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছি তাঁর দল শ্রীলঙ্কা।

২০১১ সালের বিশ্বকাপে ২ এপ্রিল মুম্বাইয়ে ভারতের বিপক্ষেই খেলেন ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে তথা শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। সেই ম্যাচটি অবশ্য সুখকর ছিল না মুরালির জন্য, বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটি ভারতের কাছে ৬ উইকেটে হেরেছিল তাঁর দল। কিন্তু ওই এক ম্যাচের হারজিত তো আর তাঁর ক্রিকেটীয় কীর্তিকে ম্লান করতে পারবে না!

শুভ জন্মদিন ক্রিকেটের ‘লর্ড অব স্পিন’ মুরালিধরন, শুভ জন্মদিন ২২ গজের বংশীবাদক! আর ধন্যবাদ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ওপারে চলে যাওয়া পেরিয়াসামি সিনাসামি আপনাকে। প্রিয় নাতির যথার্থ একটি নামই যে আপনি রেখেছিলেন ১৯৭২ সালের এই দিনে!