ম্যারাডোনা যাকে তাঁর চেয়েও সেরা বলতেন

বার্সেলোনা তাঁদের একসঙ্গে খেলার স্বাদ পূরণ করেনি। অবসরের পর সে স্বাদ মিটেছে তাদের। সংগৃহীত ছবি
বার্সেলোনা তাঁদের একসঙ্গে খেলার স্বাদ পূরণ করেনি। অবসরের পর সে স্বাদ মিটেছে তাদের। সংগৃহীত ছবি

'জন্মই আমার আজন্মের পাপ।'

চরণটি কবি দাউদ হায়দারের। স্থান-কাল এমনকি সময় বিচারেও কবির এ কথা সত্য মনে হয় অনেকের। হোর্হে আলবার্তো গঞ্জালেস তো আর বাংলা জানতেন না। ভাষাটা জানলে কিংবা কবির এ লাইনটি তাঁকে বুঝিয়ে বললে হয়তো এক গাল হেসে বলতেন, সে তো বটেই! সে তো বটেই!

ডিয়েগো ম্যারাডোনা একবার গঞ্জালেস সম্পর্কে বলেছিলেন 'কোনো সন্দেহ নেই আমার দেখা সর্বকালের সেরা দশ ফুটবলারের একজন সে।' মজাটা হলো, ম্যারাডোনার সেরা দশ ফুটবলারের মধ্যে এই গঞ্জালেস অনেকের কাছেই অপরিচিত। নাহ, কিলি গঞ্জালেস নন।

তিনি হোর্হে আলবার্তো গঞ্জালেস ব্রেইলাস। জন্মেছিলেন মধ্য আমেরিকার পুঁচকে দেশ এল সালভাদরে। তাঁর সময়ে এমনকি পরে জন্মনো অনেকেই মনে করেন গঞ্জালেস ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায় জন্মালে থাকতেন পেলে-ম্যারাডোনার কাতারে। সেদিক থেকে গঞ্জালেসের পোড়া কপালই।

ফুটবল মানচিত্রে সালভাদরের সবেধন নীলমণি পরিচিতি শুধু 'ফুটবল যুদ্ধ'-এর জন্য। প্রতিবেশী হুন্ডুরাসের সঙ্গে ১৯৬৯ সাল থেকে শুরু হওয়া রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের রেশ গড়িয়েছিল ১৯৭০ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে। এর বাইরে সালভাদর নিয়ে ফুটবলে লেখার মতো তেমন কিছু থাকত না, যদি 'এল ম্যাজিকো'র জন্ম না হতো।

হ্যাঁ, হোর্হে গঞ্জালেসকে আড়ালে-আবডালে কিংবা তাঁর সামনেই 'জাদুকর' বলত লোকে।খ্যাপাটেও বলত কি? অমিত প্রতিভারা যেমন হয়ে থাকে আর কি। যে ফুটবল তাঁকে তুলেছে কিংবদন্তিদের কাতারে, সে খেলার প্রতিই কখনো কখনো বৈরাগ্য-দশায় ভুগেছেন গঞ্জালেস। নিয়ম-শৃঙ্খলা ভাঙার চূড়ান্ত করে ছেড়েছেন। ভীষন গভীর প্রেম বোধ হয় এমনই হয়!

১৯৮২ স্পেন বিশ্বকাপে সালভাদরের প্রত্যাশা বলে কিছু ছিল না। গঞ্জালেস তার আগেই দেশের লোকের চোখে তারকা। ২৪ বছরের সেই দুরন্ত বয়সে বিশ্বমঞ্চে নিজের সামর্থ্যের সীল-ছাপ্পর মারার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দলের অবস্থা ছিল 'নুন আনতে পান্তা' ফুরোনোর মতো। খরচ বাঁচাতে সে বিশ্বকাপে ২০ জনের দল পাঠায় দেশটি। হাঙ্গেরির বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের তারা অনুশীলন পর্যন্ত করতে পারেনি। ফিফার বরাদ্দ দেওয়া বল চুরি গিয়েছিল!

হাঙ্গেরি ফুটবল ততদিনে সেরা সময় পেরিয়ে এলেও লাজলো কিস-তোরসোকদের নিয়ে তখনো নির্মম দল। সালভাদরকে গুণে গুণে ১০ গোল দিয়েছিল হাঙ্গেরি। বিশ্বকাপ ফুটবলে এটাই সবচেয়ে (১০-১) বড় স্কোরলাইন। বেলজিয়াম ও আর্জেন্টিনার কাছে পরের দুই ম্যাচে তিন গোল খেয়ে পথে ফিরেছিল সালভাদর। কিন্তু এই তিন ম্যাচে লোকে সালভাদরকে দেখেনি। দেখেছে তাদের ফরোয়ার্ড গঞ্জালেসকে। তাঁর আলো-আঁধারির মতো রহস্যময় ড্রিবলিং আর বলের ওপর অসমান্য নিয়ন্ত্রণকে।

অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ও পিএসজি লোভে পড়ে গিয়েছিল। গঞ্জালেসকে তাদের চাই-ই চাই। আগ্রহীদের মধ্যে আরও ছিল সঙ্গীতশিল্পী এলটন জনের মালিকানাভুক্ত উত্তর আমেরিকার দল লস অ্যাঞ্জেলস অ্যাজটেকস। পেলের নিউইয়র্ক কসমসের সঙ্গে তখন পাল্লা দিত অ্যাজটেকস।

কাদিজের কিংবদন্তি হয়েই ক্যারিয়ার পার করে দিয়েছেন গঞ্জালেস। ফাইল ছবি
কাদিজের কিংবদন্তি হয়েই ক্যারিয়ার পার করে দিয়েছেন গঞ্জালেস। ফাইল ছবি

বিশ্বকাপের আগে এক প্রীতি ম্যাচে প্রথমবারের মতো গঞ্জালেসের প্রেমে পড়েছিল পিএসজি। বিশাল অঙ্কের টাকার প্রস্তাবও দিয়েছিল ফরাসি ক্লাবটি। কিন্তু গঞ্জালেস সই করার জন্য সময়মতো হাজির হতে পারেননি। না, ভুল পড়েননি!
ফরাসি সৌরভ রেখে গঞ্জালেস শেষ পর্যন্ত পাড়ি জমান স্পেনে। যোগ দেন সেখানকার দ্বিতীয় বিভাগের দল কাদিজে। শুরু হলো প্রায় এক দশকব্যাপী দারুণ এক প্রেমের আখ্যান--যেখানে ১৫ গোল করে দলকে প্রথম বিভাগে তুলে মন কাড়ার কাজটা সেরে রাখেন গঞ্জালেস। ফলাফল, রাতারাতি তিনি কাদিজ-ভক্তদের চোখের মণি।

সে মণির নিজস্ব আলো ছিল, যার নাম ‌'কিউলেবৃতা মাচেদেয়াতা।' বুঝলেন না? প্রায় সব সৃষ্টিশীল ফুটবলারের নিজস্ব কিছু 'মুভ' থাকে। জিনেদিন জিদানের যেমন 'লা রুলেত' অনেকে বলে 'মার্শেই টার্ন'। ইয়োহান ক্রুয়েফের 'ক্রুয়েফ টার্ন'। রোনালদিনহোর 'ইলাস্টিকো' যদিও রিভেলিনোদের সময়ই এই মুভ ছিল। বলা হয় রোনালদিনহোর কারুকাজময় ইলাস্টিকোর পূর্ব-পুরুষ এই 'কিউলেবৃতা মাচেদেয়াতা'। অর্থ, সর্পিলভাবে বের হয়ে যাওয়া। ইলাস্টিকো এবং গঞ্জালেসের মুভের মধ্যে মোটা দাগে তেমন পার্থক্য নেই বললেই চলে।

ম্যারাডোনা বার্সায় যোগ দেন ১৯৮২ সালে। এর দুই বছর পর গঞ্জালেসকে উড়িয়ে আনার চেষ্টা করেছিল বার্সা। আর্জেন্টাইনের সঙ্গে সালভাদর তারকার জুটি গড়তে চেয়েছিল কাতালান ক্লাব। কিন্তু তা আলোর মুখ না দেখার কারণ গঞ্জালেস নিজেই।

গঞ্জালেসকে পরখ করে দেখতে যুক্তরাস্ট্রে প্রাক মৌসুম সফরে তাঁকে ডেকেছিল বার্সা। তিনি কোন ধাতুতে গড়া মানুষ তা সেখানেই বার্সাকে বুঝিয়ে দেন গঞ্জালেস। হোটেলে এক নারীর সঙ্গে ব্যস্ত ছিলেন। ম্যারাডোনাও কম যান না। গঞ্জালেসের মধুকুঞ্জ ভাঙতে হোটেলর ‌'ফায়ার আল্যার্ম' বাজিয়ে দেন ম্যারাডোনা। আগুনের ভয়ে হোটেলের সবাই কামরা ছাড়লেও গঞ্জালেসকে স্বেচ্ছায় কেউ তাঁর কামরা থেকে বের করতে পারেনি।

স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম ‌‌'এল পেইস'-এর কাছে সে ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন গঞ্জালেস, 'ওটা যে মজা ছিল তা শুনেছিলাম। তাই নিজের কামরা ছাড়তে চাইনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা আমাকে জোর করে বের করে। ওখানকার নিরাপত্তাব্যবস্থা খুব কড়া ছিল। বলেছিলাম যে লোকটা আমি নই। কাজ হয়নি।'

ম্যারাডোনা নিজে গঞ্জালেসের কতটা ভক্ত ছিলেন তা জানিয়েছেন খ্যাতিমান সংবাদকর্মী ব্রুনো প্যাসারেল্লি। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের পর নাপোলির অনুশীলনে একদিন ম্যারাডোনার সঙ্গে ছিলেন প্যাসারেল্লি। ইতালিয়ান ক্লাবটির সমর্থকেরা সে অনুশীলনে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তিকে উদ্দেশ করে বলছিল,‌ 'পেলের চেয়ে ম্যারাডোনা ভালো।'

প্যাসারেল্লি ম্যারাডোনাকে জিজ্ঞেস করেন, 'শুনছ, ওদের কথা?' ম্যারাডোনার জবাব,‌ 'ওরা অসাধারণ ভক্ত। কিন্তু ‌ওরা জানে না পেলে-ম্যারাডোনার চেয়েও ভালো ফুটবলার আছে। সে হোর্হে গঞ্জালেস, এল ম্যাজিকো, এখনো কাদিজে খেলছে---অসাধারণ ফুটবলার।'

প্যাসারেল্লি নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করতে দেরি করেননি। গঞ্জালেসকে তিনি তখন চিনতেন না। ম্যারাডোনাকে তা জানাতেই '৮৬ বিশ্বকাপজয়ী যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, 'তাহলে যাও, তাকে খুঁজে বের করো, মূর্খ!'

১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত কাদিজের সহকারি ও মূল দলের কোচ ছিলেন ডেভিড ভিদাল। তাঁর ভাষায়, 'কৌশলের কথা উঠলে সে (গঞ্জালেস) ম্যারাডোনার চেয়ে ভালো ছিল।' কিন্তু সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়। গঞ্জালেস পেশাদার ফুটবলে নিয়ম-নীতির ধার ধারতেন না। খেলাটা তাঁর কাছে সত্যিকার অর্থেই খেলা ছিল। ফুটবলকে কখনোই পেশা হিসেবে নেওয়ার সাধ জাগেনি তাঁর। কাদিজ তাঁকে পেশাদার ফুটবলের জগতেও আনন্দ নিয়ে খেলতে দিয়েছে, তাই ছোট এক ক্লাবের কিংবদন্তি হয়েই ক্যারিয়ার শেষ করতেও বিন্দুমাত্র আপত্তি হয়নি তাঁর।