আম্পায়ারদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা উচিত

তামিম ইকবাল। প্রথম আলো ফাইল ছবি
তামিম ইকবাল। প্রথম আলো ফাইল ছবি
>অন্ধকারের শেষেই থাকে আলো। কালরাত্রি পার করে আসা ভোরেও হাসে নতুন সূর্য। করোনায় আক্রান্ত দুঃসময়ও একদিন কেটে যাবে। মানুষ ফিরবে স্বাভাবিক জীবনে, মাঠে গড়াবে খেলা। কেমন হবে করোনাকালের পরের সেই সময়ের ক্রিকেট? বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের তিন সংস্করণের তিন অধিনায়কের কাছ থেকে সেটাই জানার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। আজ পড়ুন এ নিয়ে ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবালের সাক্ষাৎকার

প্রশ্ন: আপনি ওয়ানডে দলের অধিনায়ক হলেন আর সব খেলা বন্ধ হয়ে গেল! কারণটা অবশ্য করোনাভাইরাস। ওয়ানডে ম্যাচ যদিও কম ছিল এই সময়ে, তবু একটা পরিকল্পনা নিশ্চয়ই সাজিয়েছিলেন। অপ্রত্যাশিত বিরতিতে সেটি কতটা বিঘ্নিত হলো?

তামিম: আমি তাকিয়ে ছিলাম প্রিমিয়ার লিগের দিকে। লিগে ১৪-১৫টা ম্যাচে অধিনায়কত্ব করে নিজের অনেক চিন্তা কাজে লাগানোর চেষ্টা করতাম। মাঠে অধিনায়ক হিসেবে শক্তি-দুর্বলতার জায়গাগুলো আরও ভালো করে বুঝতাম। আমি খুব বেশি অধিনায়কত্ব করিনি এর আগে। যত বেশি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করব, তত পরিণত হব। যেকোনো কাজেই ভুল হয়। আমারও নিশ্চয়ই হবে। সেদিক দিয়ে আমার জন্য প্রিমিয়ার লিগই হতো উপযুক্ত শুরু।

প্রশ্ন: করোনাভাইরাসের পর যখন আবার সারা বিশ্বে খেলা শুরু হবে, শুরুতে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কোন দিকে বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত হবে?

তামিম: সবাই ফিটনেস নিয়ে খুব কথা বলছে। আমি মনে করি, আমাদের ফিটনেস নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। সমস্যা হবে দক্ষতার অংশে। এখন বাসায় সবাই প্রতিদিন কিছু না কিছু ফিটনেসের কাজ করলেও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কেউ কিছু করতে পারছে না। আমরা ব্যাট-বল নিয়ে মাঠে নামব অন্তত দুই-আড়াই মাস বিরতি দিয়ে। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিংয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় যেতে ১০-১৫টা সেশন লাগবেই।

প্রশ্ন: কিছু মানসিক সমস্যাও তো হওয়ার কথা। সবাই লম্বা একটা সময় আতঙ্কের মধ্য দিয়ে পার করছেন। সেখান থেকে বের হয়ে খেলতে নামা কতটা সহজ হবে?

তামিম: ভালো কথা বলেছেন। তবে আমরা এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। এখান থেকে বের হতে কিছু সময় তো লাগবেই। মানসিকভাবেও আগের জায়গায় যেতে একটু সময় লাগবে। করোনাভাইরাসে খেলোয়াড়দের একটা ভালো হয়েছে। আমরা এমনিতে পরিবারের সঙ্গে খুব বেশি সময় কাটাতে পারি না। এই একটা সুযোগ। মানসিক যে সমস্যাটার কথা বললেন, আমার মনে হয় না খেলোয়াড়দের মধ্যে সেটি বড় প্রভাব ফেলবে।

প্রশ্ন: করোনা-পরবর্তী ক্রিকেটের পরিবেশ কেমন হবে বলে মনে হয়?

তামিম: শুরুতে সবাই সবকিছুতে খুব দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকবে। তবে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। যখন ডেঙ্গু এল, মশা দেখলেই সবাই দৌড়ে পালাত। এখন দেখেন, মশা কামড় দিলেও আমরা অনেক সময় পাত্তা দিই না। কোনটা ডেঙ্গু মশা, কোনটা কী...এগুলো এখন আর খেয়াল করে না কেউ। হ্যাঁ, যত দিন করোনার ভ্যাকসিন বাজারে বের হচ্ছে না, তত দিন হয়তো সবাই একটু অন্য রকম আচরণ করবে। বেশি সাবধান থাকবে।

প্রশ্ন: করোনা ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়েও কিছু আলোচনা তুলে দিয়েছে। থুতু না লাগিয়ে অন্য কোনোভাবে বলের ঔজ্জ্বল্য বাড়ানো, দর্শকবিহীন মাঠে খেলা, এমনকি বোলারদের সুবিধা দিতে পিচের দৈর্ঘ্য কমিয়ে আনার প্রস্তাবও আছে। এসব নিয়ে কী বলবেন?

তামিম: টেস্ট ক্রিকেটে বলের ঔজ্জ্বল্য বাড়ানোটা গুরুত্বপূর্ণ। ওয়ানডেতে সাদা বলে ঔজ্জ্বল্য থাকেই-বা কয় ওভার! এটা খুব বড় সমস্যা নয়। আসল সমস্যা হবে অভ্যাসে। একজন বোলার বা ফিল্ডার বল হাতে পেলে অনেক সময় অবচেতনেই থুতু দিয়ে ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে চায়। এত বছর ধরে যে অভ্যাসটা তৈরি হয়েছে, আমার মনে হয়, সেটাকে ভুলে থাকাটাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রশ্ন: ধরুন ড্রেসিংরুমে ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিসপত্র ফেলে রাখা, অন্যের কিছু ব্যবহার করা, অনেক সময় খেলোয়াড়েরা একজনের বোতল থেকে আরেকজন পানি পান করে ফেলেন—এসব আচরণে তো নিশ্চয়ই পরিবর্তন আসবে...

তামিম: হ্যাঁ, এসবে অনেক বড় পরিবর্তনই আসবে। এখানেও অভ্যাস বদলানোটা গুরুত্বপূর্ণ হবে। তবে মনে হয় না এখন আর একজনের জিনিস আরেকজন ব্যবহার করতে চাইবে, একজনের মুখের পানি আরেকজন খেতে চাইবে। প্রিমিয়ার লিগ বন্ধ হওয়ার আগের এক-দুটি ম্যাচে কিন্তু সবাই কনুই দিয়ে হ্যান্ডশেক করেছে। একজনের পানি আরেকজন খাওয়া বা অন্যের জিনিস ব্যবহার—এসব এমনিতেই উচিত নয়। এখন সবাই আরও সতর্ক হবে। আগের মতো নিশ্চয়ই মাঠে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরবে না বা একেবারে কাছে এসে কথা বলবে না। যখন আমরা আত্মবিশ্বাসী হব যে এই রোগ আর ভয়ংকর কিছু নয়; এর ভ্যাকসিন, ওষুধ আছে, তখন আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আমার প্রস্তাব—যখন যে দেশে ঘরোয়া খেলা শুরু হবে, মাঠে আম্পায়ারদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকা চাই। উইকেট পড়লে উত্তেজনায় হাই ফাইভ করে ফেলতে পারে কেউ বা হ্যান্ডশেক করে ফেলল। সে জন্য যার যখন প্রয়োজন, হাতটা স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করে নেবে। তাতে কিছুটা হলেও নিরাপদ থাকা যাবে।

প্রশ্ন: দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে সত্যি সত্যি আন্তর্জাতিক ম্যাচ হলে কি খেলার মজাটা থাকবে?

তামিম: মাঠে দর্শক থাকবে না, এটা অদ্ভুত এক ব্যাপার হবে! তবে মানুষ তো ঘরে বসে টিভিতেও খেলা দেখে। আমরা খেলোয়াড়েরা মানুষকে বিনোদনও দিই। আমার তাই মনে হয়, অন্য অনেক কিছু শুরুর আগে খেলা শুরু হয়ে যাবে। কারণ, মানুষ তখন ঘরে বসেও বিনোদন পেতে পারবে।

প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন। করোনাভাইরাস মানুষের মনোজগতে বড় পরিবর্তন আনছে। মানবতাকে সবাই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। করোনাকালের পরের খেলাধুলায় এই পরিবর্তিত মানসিকতার কোনো প্রভাব পড়বে?

তামিম: খেলায় প্রভাব পড়বে কি না, বলা কঠিন। তবে মানুষ হিসেবে সবাই একটু হলেও বদলাবে। আমরা এখন আরও ভালো করে জানলাম, যত টাকা বা যত ক্ষমতাই থাকুক, জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। আমার কাছে যদি আজ শত শত কোটি টাকাও থাকত, আমি কি পারতাম আমার বাচ্চাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে? আমার কাছে যদি একটা প্রাইভেট জেট থাকত, তবু কি পারতাম বাচ্চাকে নিয়ে মালদ্বীপে ঘুরে আসতে? পারতাম না। করোনা আমাদের শিখিয়েছে, জীবনের চেয়ে বড় আর কিছু নেই।