বাংলাদেশকে লড়তে শিখিয়েছিল যে ১০ ইনিংস

>ইনিংসগুলো ম্যাচ জেতাতে হয়তো সাহায্য করেনি। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের চলার পথে সেগুলোই হয়ে আছে নিজেদের প্রমাণের এক একটি মাইলফলক।
১৯৯০ সালে আজহার হোসেনের ব্যাট থেকে এল প্রথম ফিফটি। তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন জাহিদ রাজ্জাক মাসুম। ছবি: সংগৃহীত
১৯৯০ সালে আজহার হোসেনের ব্যাট থেকে এল প্রথম ফিফটি। তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন জাহিদ রাজ্জাক মাসুম। ছবি: সংগৃহীত

সেই সময়টা বদলে দিয়েছেন সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহরা। যখন বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারের একটা ফিফটি বা যেকোনো একটা চল্লিশোর্ধ ইনিংসই আমাদের আনন্দিত করত। সেই সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমরা লড়েছি পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করতে। ২০০০ সালে পাওয়া টেস্ট স্ট্যাটাস, অবস্থার পরিবর্তন এনেছে। খিদে বাড়িয়ে দিয়েছে ক্রিকেটপ্রেমীদের। এখন ফিফটি তো দূরের কথা মাঝেমধ্যে তিন অঙ্কের ইনিংসও ক্রিকেটপ্রেমীদের মানসিকভাবে তৃপ্ত করে না। তবে টেস্ট পূর্ব যুগে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের এমন কিছু ইনিংস আছে, যেগুলো এই বদলে রেখেছিল বড় ভূমিকা। যে ইনিংসগুলো ক্রিকেটজাতি হিসেবে আমাদের পথচলাকে করেছিল দৃঢ়তর। নস্টালজিয়া নয়, সেই ইনিংসগুলোর মধ্য থেকে ১০টিকে বাছাই করে সংগ্রামমুখর সেই দিনগুলোতে ফিরে তাকালে কেমন হয়!

মেহরাব হোসেন, ১০১ প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে, ঢাকা ১৯৯৯
একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে করা মেহরাবের সে সেঞ্চুরিটি দেখার জন্য খুব বেশি দর্শক সেদিন উপস্থিত ছিলেন না। কারণ মেরিল কাপের আগেই ম্যাচেই কেনিয়ার কাছে হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার, এডো ব্রান্ডেজ, হিথ স্ট্রিকদের শক্তিশালী জিম্বাবুয়ে সেদিন রীতিমতো ভড়কে গিয়েছিল মেহরাবের অসাধারণ সব স্ট্রোক প্লেতে। ওপেনিংয়ে শাহরিয়ার হোসেনের সঙ্গে তাঁর ১৭০ রানের জুটিটি দীর্ঘ ২১ বছর ছিল ওয়ানডে ওপেনিংয়ে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ। মেহরাব তাঁর ১০১ রানের ইনিংসটি খেলেন ১১৬ বলে। তাতে ছিল ৯টি চার ও ২টি ছক্কা। ৫০ ওভারে ২৫৭ রান তুলেও ম্যাচটা ৩ উইকেটে হেরেছিল বাংলাদেশ।

আতহার আলী খান, ৭৮* প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা, কলকাতা, ১৯৯০
১৯৯০ সালের এশিয়া কাপ। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সে ম্যাচটি স্মরণীয় বাংলাদেশের ক্রিকেটে। এ ম্যাচেই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ওয়ানডেতে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন আতহার আলী খান। তাঁর ৯৫ বলে অপরাজিত ৭৮ রানের ইনিংসের জন্য। ম্যাচটি বাংলাদেশ ৭১ রানে হারলেও আতহারের লড়াই তাঁকে ম্যাচসেরার সম্মান এনে দিয়েছিল।৪৫ ওভারের ম্যাচে লঙ্কানদের ২৪৯ রানের জবাবে বাংলাদেশ সেদিন সাকল্যে করেছিল ১৭৮। মিনহাজুল আবেদীন করেছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৩।

মোহাম্মদ রফিক, ৭৭, প্রতিপক্ষ কেনিয়া, হায়দরাবাদ, ১৯৯৮

বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়ের সেই মুহূর্তটি রাঙিয়েছিলেন মোহাম্মদ রফিক তাঁর ৭৭ রানের ইনিংসটি দিয়ে। হায়দরাবাদের লাল বাহাদুর শাস্ত্রী স্টেডিয়ামে সেদিন জুয়া খেলেছিলেন বাংলাদেশের কোচ গর্ডন গ্রিনিজ। আতহার আলী খানের সঙ্গে ওপেনিংয়ে পাঠানো হয়েছিল রফিককে। প্রত্যাশা ছিল রফিক তাঁর মারকুটে ব্যাটে যদি কিছু বাড়তি রান এনে দিতে পারেন দ্রুত। রফিক সেদিন প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি কিছু করেছিলেন। ৮৭ বলে ৭৭ রানের ইনিংসটি ছিল ম্যাচজয়ীই। তাঁর ইনিংসে ছিল ১১টি চার ও একটি ছক্কা।

আমিনুল ইসলাম
, ৭০ প্রতিপক্ষ ভারত, মোহালি, ১৯৯৮

ভারতের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক ইনিংস। মোহালিতে দলের বাকি ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমিনুল ইসলাম নিজেকে চিনিয়েছিলেন ৭০ রানের লড়াকু এক ইনিংসে। ১২৬ বলে ৫ বাউন্ডারিতে গড়া তাঁর ইনিংসটি হয়তো খুব আক্রমণাত্মক ছিল না। কিন্তু তাতে ছিল দৃঢ়তার ছোঁয়া। সে ম্যাচে তাঁর ৭০ রানের ইনিংসের ওপর দাঁড়িয়েই বাংলাদেশ গড়েছিল ১৮৪ রানের ইনিংস। ভারত অবশ্য সহজে জিততে পারেনি। তাদের জয়টা ছিল ৫ উইকেটে, ৪৫.২ ওভারে এসে।

১৯৯৯ সা‌লের বিশ্বকা‌পে  স্কটল্যা‌ন্ডের বিপ‌ক্ষে স্মরণীয় এক ই‌নিংস খে‌লে‌ছি‌লেন মিনহাজুল অা‌বেদীন। ছ‌বি: এএফ‌পি
১৯৯৯ সা‌লের বিশ্বকা‌পে স্কটল্যা‌ন্ডের বিপ‌ক্ষে স্মরণীয় এক ই‌নিংস খে‌লে‌ছি‌লেন মিনহাজুল অা‌বেদীন। ছ‌বি: এএফ‌পি

মিনহাজুল আবেদীন ৬৮, প্রতিপক্ষ স্কটল্যান্ড, ১৯৯৯

স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় সেদিন ছিল হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে স্কটিশদের বিপক্ষে সেই ম্যাচটিতেই ছিল জয়ের জন্য বাংলাদেশের পাখির চোখ। কিন্তু টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নেমেই বিপর্যয়। ২৬ রানে পড়ে গেল ৫ উইকেট। সেই ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়েই মিনহাজুল খেললেন অসাধারণ এক ইনিংস। ভাবা যায়, টেস্টপূর্ব যুগে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যানের সেটিই ছিল প্রথম ওয়ানডে ফিফটি। সেটি ছিল মিনহাজুলের ২৫তম ওয়ানডে, বিশ্বকাপে প্রথম। অনেক নাটকের পর বিশ্বকাপের দলে আসা সেই ব্যাটসম্যান প্রথম ম্যাচে নেমেই খেললেন ম্যাচজয়ী ইনিংস। নাঈমুর রহমানের সঙ্গে ৬৯ রানের জুটি গড়লেন। তাঁর ১১৬ বলের ইনিংসটি সাজানো ছিল ৬ বাউন্ডারিতে। কনকনে বাতাস আর সুইংয়ের মধ্যে মিনহাজুলের সে ইনিংসটি বাংলাদেশের ক্রিকেট হল অব ফেমেরই অংশ।

মেহরাব হোসেন ৬৪, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ডাবলিন, ১৯৯৯

ডাবলিনের ঠান্ডা আর কোর্টনি ওয়ালশের নেতৃত্বে ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলারদের দাপট। এই দুইয়ের সঙ্গে সেদিন একাই লড়েছিলেন মেহরাব হোসেন। বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরিয়ান বিশ্বকাপে তাঁর ফর্ম ধরে রেখেছিলেন। ১২৯ বলে তাঁর সেই ৬৪ রানের ইনিংসটি ছিল মহামূল্যবান। বাংলাদেশের ১৮২ রানের ইনিংসে এর বাইরে বলার মতো রান পেয়েছিলেন শুধু নাঈমুর রহমান (৪৫)।

মিনহাজুল আবেদীন, ৫৩*, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, চেস্টার–লি–স্ট্রিট, ১৯৯৯

১৯৯৯ বিশ্বকাপেরই আরেক ম্যাচ। গ্লেন ম্যাকগ্রা, ডেমিয়েন ফ্লেমিং, শেন ওয়ার্ন, টম মুডিদের বোলিং, স্টিভ ওয়াহ, মার্ক ওয়াহ, রিকি পন্টিং, অ্যাডাম গিলক্রিস্টদের ব্যাটিং। শিশু বাংলাদেশের সামনে ভয়ংকর অস্ট্রেলিয়া। কঠিন ইংলিশ কন্ডিশনে বাংলাদেশ উড়ে যাবে কিনা, সবার দুশ্চিন্তা যখন এমন, তখন মিনহাজুল আবেদীনের ব্যাটেই আবার উতরে যায় বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বসেরা বোলিং থমকে গিয়েছিল মিনহাজুলের ব্যাটের সামনেই। ৯৯ বল খেললেও তাঁর ৬টি বাউন্ডারির প্রতিটিতে ছিল ম্যাকগ্রা,ওয়ার্নদের চোখে চোখ রাখা ঔদ্ধত্য।

আজহার হোসেন, ৫৪, প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, শারজা, ১৯৯০

ওয়ানডেতে এটি বাংলাদেশের প্রথম ফিফটি। আজহার হোসেন তাঁর অফ স্পিন বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংটাও ভালো করতেন। শারজায় ১৯৯০ অস্ট্রেলেশিয়া কাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল সম্মান রক্ষার। কিউইদের ৪ উইকেটে গড়া ৩৩৮ রানের জবাবে বাংলাদেশ সেদিন টিকে থাকার লড়াই করেছি। ড্যানি মরিসন, জোনাথন মিলমো, শেন টমসন, মার্টিন স্নেডেন, জন ব্রেসওয়েলদের বিপক্ষে বাংলাদেশ সেদিন গড়েছিল ৫ উইকেটে ১৭৭ রান। সেদিন পর্যন্ত এই স্কোরই ছিল ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। আজহার ওপেনিংয়ে নেমে ১২৬ বল টিকে থেকে ৫৪ করেছিলেন। তাঁর ইনিংসে ছিল ৪টি বাউন্ডারি।

ফারুক আহমেদ, ৫৭, প্রতিপক্ষ ভারত, চন্ডিগড়, ১৯৯০

১৯৯০ সালে চতুর্থ এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে সে ম্যাচে ফারুক আহমেদের ফিফটি লড়াইয়ের পুঁজি দিয়েছিল বাংলাদেশকে। চন্ডীগড়ের মাঠে সেদিন কপিল দেব, মনোজ প্রভাকর, অতুল ওয়াসন, ভেংকটাপতি রাজু, শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়দের বিপক্ষে বাংলাদেশ পুরো ৫০ ওভার খেলে ৬ উইকেটে করে ১৭০ রান। ফারুকের ৫৭ রানের ইনিংসটি ছিল ১২৬ বলে, ৩ বাউন্ডারিতে। ভারতের বিপক্ষে প্রথম ফিফটি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে সে ইনিংসটি।

আতহার আলী খান, ৮২, প্রতিপক্ষে পাকিস্তান, কলম্বো, ১৯৯৭

আইসিসি ট্রফি জিতে বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়া হয়ে গেছে ততোদিনে। ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে শ্রীলঙ্কায় এশিয়া কাপে বাংলাদেশ ওয়ানডে খেলতে নামে দুই বছর পর। পাকিস্তানের বিপক্ষে সে ম্যাচটি ছিল শেখার দারুণ মঞ্চ। পাকিস্তানের ৫ উইকেটে গড়া ৩১৯ রানের জবাবে বাংলাদেশ সেদিন প্রথমবারের মতো ওয়ানডেতে ২০০ রানের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। বাংলাদেশের ২১০ রানের ইনিংসে আতহার আলী খান করেন ৮২। ওপেনার আতহারের ১২৫ বলের ইনিংসে ছিল ৮টি চার ও ১টি ছক্কা।