শুভ জন্মদিন, ৩৭৫, ৪০০*, ৫০১*

ব্রায়ান লারা। চোখ জুড়োনো ব্যাটিংয়ের প্রতীক। ছবি: টুইটার
ব্রায়ান লারা। চোখ জুড়োনো ব্যাটিংয়ের প্রতীক। ছবি: টুইটার

'আমি ব্যাটিং উপভোগ করি। আরেকজনের ব্যাটিং দেখা উপভোগ করতাম না। ড্রেসিং রুমে না থেকে মাঠে থাকতে চাইতাম, ব্যাটিং করতে চাইতাম। যদি দলের পরিকল্পনা থাকে পাঁচ সেশন ব্যাট করার, তাহলে আমিই পাঁচ সেশন ব্যাট করব। যখন আমার অধিনায়ক ইনিংস ঘোষণা করবে, তখনই আমার মাঠ ছাড়ার কথা।'

কথা গুলো ব্রায়ান লারার। ৩৭৫, ৪০০*, ৫০১*-এর চূড়া তিনি গড়েছেন এই ৫ সেশন ব্যাটিং করে যাওয়ার মানসিকতা দিয়েই। আর টেস্ট ক্রিকেটে ৯টি ডাবল সেঞ্চুরি তো আছেই। ৩৪টি টেস্ট সেঞ্চুরির ১৯টিই ছিল ১৫০ এর বেশি স্কোর।

টেস্টে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি লারার। ছবি: টুইটার
টেস্টে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি লারার। ছবি: টুইটার

লারা সৌন্দর্যের ছটায় শাসন করতে ভালোবাসতেন। বাউন্ডারি বের করার অদ্ভুত দক্ষতা নিয়ে জন্মেছিলেন 'প্রিন্স অব ত্রিনিদাদ'। ব্যাটিং সৌন্দর্যে্ও বলতে গেলে শেষ কথা। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী গ্লেন ম্যাকগ্রা সে জন্যই হয়তো বলেছেন, 'পকেটের শেষ পয়সা দিয়ে কারও ব্যাটিং দেখতে হলে আমি ব্রায়ান লারার ব্যাটিং দেখব।'

৮০'র দশকে শেষ দিকে ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জে লাারার নাম ছড়িয়ে পড়ে। কার্টলি এমব্রোস তো প্রথমবার লারাকে বোলিং করেই বুঝে গিয়েছিলেন 'জিনিয়াস' কাকে বলে, 'ব্রায়ান ১৯৮৮ সালে আমাদের বিপক্ষে খেলেছিল। ৪৮ রান করেছিল সেদিন। স্পষ্ট মনে আছে, ওকে বোলিং করেই মনে হয়েছে বিশেষ কিছু আছে তাঁর মধ্যে।'

 তখন বারবাডোজ দলের ফাস্ট বোলার ছিলেন জোয়েল গার্নার, ম্যালকম মার্শাল। ১৮ বছর বয়সী লারা ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি পেসারদের বিপক্ষে ৯২ রান করেন। গার্নার-মার্শালদের বিপক্ষে লারার ব্যাটিং দেখে নাকি মাঠে উপস্থিত দর্শকরাও হাসি-ঠাট্টা শুরু করে দিয়েছিল। এক দর্শক নাকি গার্নারদের দিকে আঙ্গুল তুলে বলছিলেন, 'দুইজন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফাস্ট বোলার মিলে এই বাচ্চা ছেলেকে থামাতে পারলে না!'

 লারার গল্প ততদিনে ছড়িয়ে পড়ে ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জে। স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ডাক পেতেও বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে অভিষেক ক্যাপ পেতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁকে।

১৯৯০ সালের ইংল্যান্ড সফরের দলে থাকলেও খেলার সুযোগ হয়নি। অধিনায়ক ভিভ রিচার্ডস তাঁকে প্রস্তুতি ম্যাচে ২৫ ওভার বোলিং করিয়েছেন। পুরো সফর জুড়ে ভিভের গাড়ি চালিয়েছেন। ভিভের ড্রাইভার হয়ে ইংল্যান্ডের পথঘাট চেনা মুখস্থ হয়ে যায় লারার। আর ম্যাচের সময় পানি টানার কাজ তো আছেই।

একই দলের আরেক কিংবদন্তি ম্যালকম মার্শালের সন্দেহ ছিল লারার ব্যাটিং কৌশলে। এতো উঁচু ব্যাক লিফটের কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রানই নাকি পাওয়ার কথা না তাঁর!

 ভুল প্রমান করতে বেশি সময় নেননি লারা। ১৯৯৩ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে সিডনি টেস্টে লারা বিশ্বকে জানান তাঁর সামর্থ্য। ক্যারিয়ারের মাত্র নবম ইনিংসে আসে লারার প্রথম সেঞ্চুরি। সে সেঞ্চুরি পরিণত হয় ডাবল সেঞ্চুরিতে। ডাবল হতে যাচ্ছিল ট্রিপল সেঞ্চুরিতে। কিন্তু ২৭৭ রানের সময় কার্ল হুপারের ভুলে রান আউট না হলে স্যার গ্যারি সোবার্সের মতো ট্রিপল সেঞ্চুরিতে শুরু হতে পারত লারার টেস্ট ক্যারিয়ার।

লারার সে ইনিংসটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেল বলেছিলেন, 'ওই রান আউট না হলে অস্ট্রেলিয়ানরা লারাকে আউট করতে পারত না। সে যে আউট হতে পারে, একবারও মনে হয়নি। সেদিনই বুঝেছিলাম, এই ছেলে সহজেই ৩০০ রান করতে পারবে। তাঁর হাতে প্রচুর শট ছিল। কিন্তু শুরুর দিকে শট খেলত ফিল্ডারের হাতে। তবে ২৭৭ সালের ইনিংসে যেসব শট খেলেছে সব ফাঁকায়।'

 লারার পরের সেঞ্চুরি আসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৭ রানের ইনিংসটি ছিল বড় কিছু ইঙ্গিত। বড় কিছু আসে একই সিরিজের শেষের দিকে। ৩৭৫ রানের ম্যারাথন ইনিংস খেলে গ্যারি সোবার্সকে ছাড়িয়ে যান। গ্যারি তাঁর ১৭তম টেস্টেই ৩৬৫ রানের ইনিংস খেলে রেকর্ড গড়েন। লারা তাঁর ১৬তম টেস্টেই স্বদেশী কিংবদন্তিকে ছাড়িয়ে টেস্টে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের নতুন রেকর্ড গড়েন।

তখন রাহুল দ্রাবিড় সবে যাত্রা শুরু করেছেন। বিশ্ব ক্রিকেটে লারার উন্মাদনা তাঁকে মুগ্ধ করত। তাঁর পছন্দের ব্যাটসম্যান ছিল এ বাঁহাতি। শচীন টেন্ডুলকারের সতীর্থ হয়েও লারা ছিলেন রাহুলের পছন্দের ব্যাটসম্যান। বহু বছর পর তিনি বলেছিলেন, 'আমরা অবাক হয়ে দেখতাম, তারকাখ্যাতি কাকে বলে। লারা ৯০'র দশকের দিকে যা করেছে তা অবিশ্বাস্য। যে কোন ক্রিকেটারের স্বপ্ন থাকে এমন স্বপ্নীল সময়ের।'

রেকর্ডগড়া সে ইনিংসের কিছুদিন পরই ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে এক ম্যাচে উইকেটকিপার ইনিংসের শুরুতে লারার ক্যাচ ফেলেন। পেছন থেকে কেউ বিড়বিড় করে বলল, 'আহ, সে নিশ্চয়ই এখন ১০০ করে বসবে।' পরের গল্পটা মাইকেল আথারটন সুন্দর করে বলেন, 'এরপর লারা একটি একশ করে, এরপর আরও একটি, এরপর আরও একটি, এরপর আরও একটি।'তখন কে ভেবেছিল, কেউ একাই ৫০০ রান করে বসবেন! লারা করলেন ৫০১ রান, যা এখন পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ইতিহাসে সর্বোচ্চ স্কোর।

 ১৯৯৫ সালে ইংল্যান্ড সফরে এসে লারা মনে করিয়ে দেন ১৯৭৫ সালের ভিভ রিচার্ডসের কথা। এক সিরিজে তাঁর ব্যাট থেকে আসে ৭৬৫ রান। ১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে লারার অবিশ্বাস্য সেঞ্চুরি কার না মনে আছে! এখনও লারার সেই সেঞ্চুরি আড্ডায় ঝড় তোলে।

ওয়ানডেতেও সমান কার্যকর ছিলেন লারা। ছবি: টুইটার
ওয়ানডেতেও সমান কার্যকর ছিলেন লারা। ছবি: টুইটার

এরপর আসে ১৯৯৯ সালে টেস্টে সেই স্মরণীয় ইনিংস। ক্রিকেট যতদিন থাকবে  অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লারার ১৫৩* রানের ইনিংসটি লেখা থাকবে ইতিহাসে।

পোর্ট অব স্পেনে ২১৩ রানের দুর্দান্ত ইনিংসটি কেউ স্মরণ করে না, কারণ ব্রিজটাউনে পরের টেস্টে তিনি সেই ১৫৩* রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলেছিলেন। চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য ৩০৮ রান দরকার, লারা ব্যাট করছিলেন ওয়ালশের সঙ্গে।

অস্ট্রেলিয় বোলারদের ক্লাব বোলারের কাতারে নামিয়ে এনে ইতিহাস গড়েন লারা। ক্যারিবিয়ান তারকার ইনিংসটি মনে পড়লে এখনো নাকি গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে জেসন গিলেস্পির, 'গ্যাপ খুঁজে বের করার অবিশ্বাস্য উদাহরণ ছিল সেই ইনিংসটি। আমরা খুব যে খারাপ বল করেছিলাম তা কিন্ত না। কিন্তু মাঝে মধ্যে প্রতিপক্ষের কীর্তিতে টুপি খোলা অভিনন্দন জানাতে হয়। সেদিনটি ছিল এমনই একদিন।'

 ২০০১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের শ্রীলঙ্কা সফরের কথা কী ভুলে থাকা যায়! শ্রীলঙ্কানরা হয়তো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৩-০ ব্যবধানে হারানোর কথা মনে রেখেছে, কিন্তু পুরো বিশ্ব সিরিজটি মনে রেখেছে লারার আরেকটি অবিশ্বাস্য কীর্তির জন্য। মুত্তিয়া মুরলিধরন তখন ভয়ংকর বোলার। সঙ্গে শ্রীলঙ্কার স্পিন সহায়ক উইকেট তো আছেই। সেখানে তিন টেস্টে লারার ব্যাট থেকে ৬৮৮ রান!

 গলে প্রথম টেস্টে মুরালিকে হাত থেকে পড়তে পারছিলেন না লারা। বাকি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যানদের মতো কোনটা দুসরা কোনটা অফ স্পিন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি। লারার সতীর্থ রামনরেশ সারওয়ান লারাকে ডাকতেন 'বস' নামে। তিনি লারাকে জিজ্ঞেস করেন, 'বস, কী করা যায় বলুন তো?' লারা নাকি মৃদু হাসি দিয়ে বলেছিলেন, 'আমি বুঝতে পারছি না মুরলি কী করছে। তাই আজ শুধু সুইপ করে যাব। সিরিজ যতই গড়াবে, আমি মুরলির হাত থেকে কোনটা অফ স্পিন, কোনটা দুসরা, পড়তে শুরু করব। এরপর শেষ টেস্ট আসতে না আসতেই আমি ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে খেলা শুরু করব।'

 গল টেস্টে লারার ব্যাট থেকে আসে ১৭৮, কলোম্বোর শেষ টেস্টে প্রথম ইনিংসে ২২১ রান ও দ্বিতীয় ইনিংসে ১৩০ রান আসে এই বাঁহাতি ব্যাটিং জিনিয়াসের ব্যাট থেকে।

 ২০০৩ সালের অক্টোবর এসে লারার ৩৭৫ রানের রেকর্ড ভাঙ্গেন ম্যাথু হেইডেন। হেইডেনের কাছে মুকট হারানো পছন্দ হয়নি লারার। ২০০৪ সালের এপ্রিলেই লারা সিংহাসন নিজের করে নেন। টাইম মেশিনের মতো ১৯৯৪ সালের অ্যান্টিগা টেস্টে ফিরে যান, একই প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের ৩৭৫ ও হেইডেনের ৩৮০ রানের রেকর্ড ছাড়িয়ে ৪০০ রানের নতুন রেকর্ড গড়েন। সেদিন শর্ট লেগে ফিল্ডিং করছিলেন নাসের হোসাইন। ১০০ করার পরই নাকি নাসেরকে নতুন রেকর্ড গড়ায় ইঙ্গিত দিয়েছিলেন লারা, 'সেদিন আমি শর্ট লেগে ছিলাম। ১০০ করার পর আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বলেছিল “আমি হয়তো আমার রেকর্ডের পেছনে ছুটতে পারি।” সে জানত, উইকেট এতোটাই ফ্ল্যাট ছিল যে রেকর্ড গড়ার এটাই সুযোগ।'

 ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসেও লারা ধার হারাননি। ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে অ্যাডিলেড টেস্টে ২২৬ রানের ইনিংস খেলে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের চূড়ায় পৌঁছে যান এই ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি। অথচ ইনিংসটির শুরুতে লারা নাকি ব্যাটিং করছিলেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। কিন্তু ঘুমন্ত সিংহকে যে জাগাতে নেই, রিকি পন্টিংকে সেদিন এই শিক্ষাটাই দিয়েছিলেন লারা। ইনিংসের শুরুতে লারার মন্থর ব্যাটিং দেখে স্লিপ থেকে পন্টিং বলে বসেন, 'ব্রায়ান, কিছু শট খেলো দয়া করে। তুমি আমাদের সবাইকে বিরক্ত করছ।' পরের দেড় ঘন্টায় লারা একাই যোগ করেন ১৫০ রান। আউট হন ব্যক্তিগত ২২৬ রানে।

 ২০০৭ বিশ্বকাপ দিয়ে ক্রিকেটকে বিদায় জানান ব্রায়ান লারা। বিদায় বেলায় তিনি দর্শকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন, 'আমি কী বিনোদন দিতে পেরেছি?'

আজ লারার ৫১তম জন্মদিনে জবাবটা আবারও দিতে কারও আপত্তি থাকার কথা না। শুভ জন্মদিন, হে বিনোদনদায়ী ব্যাটিংয়ের পুরোধা।