কল্পনায় ১০ স্কোর করছি

>আনা ফ্রাঙ্ক ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা তাঁর ডায়েরির জন্য। অনেকে বলেন, করোনাভাইরাস আক্রান্ত এই অনিশ্চিত সময়টাও নাকি বিশ্বযুদ্ধের মতোই। ক্ষুদ্র এক অনুজীবের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী তো যুদ্ধেই নেমেছে! তা এই সময়ে বাংলাদেশের ঘরবন্দী খেলোয়াড়েরা যদি ডায়েরি লিখতেন, কী থাকত তাঁদের লেখায়? খেলোয়াড়দের হাতে কলম তুলে দিয়ে সেটিই জানার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো-
আব্দুল্লাহ হেল বাকি। ছবি: প্রথম আলো
আব্দুল্লাহ হেল বাকি। ছবি: প্রথম আলো

কথা ছিল এখন আমি বিশ্বকাপ শ্যুটিংয়ের অনুশীলন নিয়ে ব্যস্ত থাকব। স্কোর কত ভালো করলে ফাইনাল রাউন্ডে খেলা যাবে, এই হিসেবই করার কথা ছিল এখন। পারফরম্যান্সের বিচারে অলিম্পিকে খেলার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলাম। সব মিলিয়ে এই সময়টা পুরোপুরি শ্যুটিংয়ে ডুবে থাকবো, এমন পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল!

করোনাভাইরাস আমাদের পুরোপুরি ঘর বন্দী করে দিল। প্রায় দুই মাস হলো গাজীপুরে গ্রামের বাড়িতে আছি। সর্বশেষ ২০০৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষার পর এতদিন বাড়িতে থাকা হয়েছিল আমার।

সে হিসেবে প্রায় ১৪ বছর পর অনেক দিন যাবত বাড়িতে থাকা। বিকেএসপিতে পড়াশোনা করার সুবাদে হোস্টেলেই থাকতে হয়েছে বেশি। বিকেএসপি থেকে বের হওয়ার পর ন্যাশনাল ক্যাম্প আর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর চাকরিই আমার সব। দেশে-বিদেশে খেলা নিয়ে ব্যস্ততায় বাড়িতে বেশি আসা হয় না। ঈদেও সর্বোচ্চ ৭-৮ দিন বাড়িতে থাকি। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। অপ্রত্যাশিত এই ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে থাকা হচ্ছে। আমিও সময়টা উপভোগ করছি।

বাবা-মার কাছ থেকে এই কয়েক দিনে অনেক গল্প শুনেছি। তাঁদেরও অনেক কৌতূহলের বিষয় আছে। ঘরোয়া আলোচনায় পারিবারিক অনেক সুখ-দু:খের কথা উঠে আসছে, যার অনেক কিছুন আমার অজানাই ছিল। ছোট বেলা থেকেই পরিবারের বাইরে থাকায় অনেক আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারে অন্ধকারেই ছিলাম। ফোনে তাঁদের খোঁজ-খবর নিচ্ছি। সব কিছু মিলিয়ে সময়টা ভালো যাচ্ছে। শুধু করোনা আতঙ্কটা না থাকলেই হতো।

আমাদের যেদিকে বাড়ি, সে এলাকায় এখনো করোনা শনাক্তের খবর পাইনি। তবু আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। নিজেকে নিয়ে নয়, বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে। দাদা-দাদীকে নিয়েও দশ্চিন্তা আছে। যে কোনো সময় যদি পরিবারের কেউ আক্রান্ত হয়, এ নিয়ে ভয় কাজ করে।

অনুশীলন আর খেলতে না পারা নিয়ে দুশ্চিন্তা তো আছেই। শ্যুটিং ফুটবল, ক্রিকেট বা অন্যান্য দলীয় খেলার মতো ফিটনেস নির্ভর খেলা নয়; যে বাসায় ফিটনেসের কাজ করে খেলা শুরু হলে অল্প কয় দিনের অনুশীলনেই মাঠে নামতে পারব। সত্যি বলতে বাসায় বসে অনুশীলন করার মতো কিছু নেই শ্যুটিংয়ে। শারীরিক কিছু অনুশীলন থাকলেও গুলি ছুড়ে নিশানা ঠিক রাখার অভ্যেসটাই হলো আসল। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কোনো শ্যুটারের বাড়িতেই সে ব্যবস্থা নেই।

একেকটা দিন যায় আর হিসেব করি, কতদিন রাইফেল ধরি না! এ মাসের ১২ তারিখে শ্যুটিং থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার দুই মাস পূর্ণ হবে। খেলোয়াড়দের জন্য অনেক লম্বা সময়ের বিরতি। এখন অনুশীলনে নামলেও আগের স্কোরে ফিরে যেতে কমপক্ষে দুই মাস সময় লাগতে পারে।

শরীর ফিট রাখার জন্য কিছু ব্যায়াম করি। বেশি জোর দিয়েছি মেডিটেশনে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রতিদিন এক ঘণ্টা সময় নিয়ে দুই সেশন মেডিটেশন করি। বলা যায় এটাই আমার সারা দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কল্পনায় ১০ স্কোর করছি, এতে আত্মবিশ্বাসটা অন্তত থাকে। খেলার মানসিকতাটা ধরে রাখা যায়।

অনলাইনেও সময় কাটাচ্ছি অনেক। অনলাইন বলতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তেমন নয়। বেশিরভাগ সময় ইউটিউবে শ্যুটিং দেখি। বিশ্বের বড় বড় খেলোয়াড়দের সঙ্গে নিজের শ্যুটিং দেখে কল্পনায় নিজেকে সেখানে নিয়ে যাই। এখন কল্পনায় শ্যুটিং করা ছাড়া তো আর উপায়ও নেই!