ফুটবলে কাশফুল, সাঁতারে শেওলা

>

অদ্ভুত নীরবতায় আচ্ছন্ন স্টেডিয়াম পাড়া। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সময়ে কোথাও খেলাধুলা নেই। মাঠ, গ্যালারি, সুইমিংপুল—সব কেমন বোবা চাহনিতে তাকিয়ে। অযত্ন, অবহেলায় পড়ে আছে সব। কাউকে দোষ দেওয়ারও উপায় নেই। যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব যাদের, ক্ষুদ্র অণুজীব যে ঘর বন্দী করে ফেলেছে তাদেরও! করোনাকালে কেমন আছে ঢাকার ক্রীড়া স্থাপনাগুলো? সেটি জানতেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে প্রথম আলোর এই সরেজমিন প্রতিবেদন

বঙ্গবন্ধুতে হাঁটু–ঘাস: অনেক সময় ব্যস্ত সড়কের চেয়েও বেশি যানজট লেগে থাকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এলাকায়। ভেতরে খেলা, স্টেডিয়ামের দোতলা, তিনতলায় বিভিন্ন ফেডারেশনের কার্যালয়, নিচে স্টেডিয়াম মার্কেট। এসবের বাইরেও হকার–ফেরিওয়ালাদের ভিড়। কী পাওয়া যায় না এখানে! ফুচকা, চটপটি থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিকস সরঞ্জাম। সেই সদা ব্যস্ত স্টেডিয়াম চত্বর এখন পুরোই ফাঁকা। কিছু ছিন্নমূল মানুষ বন্ধ দোকানের বারান্দায় শুয়ে-বসে অলস সময় কাটাচ্ছে। গত ১৮ মার্চ থেকেই খেলাধুলা বন্ধ। ধুলোবালি আর আবর্জনায় নোংরা হয়ে আছে পুরো এলাকা।

খেলা দূরে থাক, অনেক দিন হলো মাঠকর্মীদের পা-ও পড়ছে না বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। ফুটবল মাঠে তাই দেখা মিলেছে কাশফুলের। বড় হচ্ছে ঘাস।  ছবি: বদিউজ্জামান
খেলা দূরে থাক, অনেক দিন হলো মাঠকর্মীদের পা-ও পড়ছে না বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। ফুটবল মাঠে তাই দেখা মিলেছে কাশফুলের। বড় হচ্ছে ঘাস। ছবি: বদিউজ্জামান

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ভেতরেও একই অবস্থা। ডাগআউটের ছাউনিগুলো উল্টে পড়ে আছে। বোঝাই যায় করোনার কারণে প্রিমিয়ার ফুটবল লিগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আর মাঠকর্মীদের পা পড়েনি এদিকে। এই সুযোগে মনের আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে বড় হচ্ছে ঘাস। ভিআইপি গ্যালারির সামনের গোলপোস্টের আশপাশে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হতে পারে, কোনো জঙ্গলের কাছেই বুঝি চলে এসেছেন! ঘাসে হাঁটু ডুবে যাওয়ার জোগাড়।

মাঠটাও যেন বাড়ির পেছনে অবহেলায় পড়ে থাকা বাগান! সাদা সাদা ছোট ঘাসফুলগুলো আকাশপানে তাকিয়ে। অ্যাথলেটিকস ট্র্যাকের পাশ ঘেঁষে গজিয়ে উঠেছে কাশফুলের ছোট ঝাড়। বুটের দাপাদাপি না থাকায় মাঝ মাঠের ন্যাড়া জায়গাটাও এখন সবুজ গালিচার মতো। রোদে পুড়ে ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে হলুদ কর্নার-ফ্ল্যাগগুলো। ত্রিপল দিয়ে ঢাকা হাইজাম্পের ম্যাট পড়ে আছে অ্যাথলেটিকস ট্র্যাকের ওপর।

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বর্তমান অবস্থা। ছবি: প্রথম আলো
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বর্তমান অবস্থা। ছবি: প্রথম আলো

স্টেডিয়ামের ভেতরে একটি কক্ষে থাকেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী জালাল উদ্দিন। স্টেডিয়াম দেখাশোনা করেন। মাঠের এমন চেহারা দেখতে মোটেও ভালো লাগে না প্রায় পঁচিশ বছর ধরে এই স্টেডিয়ামে কাটিয়ে দেওয়া জালাল উদ্দিনের, ‘১৯৯৫ সাল থেকে এখানে চাকরি করছি। কোনো দিন দেখিনি মাঠের ঘাস এত বড় হয়েছে। ঘাস কাটার লোকও নেই এখন। করোনাভাইরাসের ভয়ে সবাই ঘরে বসে আছে।’

হকি হারাচ্ছে ঔজ্জ্বল্য: হকি স্টেডিয়ামে ঢোকার মুখেই বাধা। রবিউদ্দিন গেটের সামনে পরিত্যক্ত বিলবোর্ড ও কাঠের ছোট চৌকি দিয়ে বানানো হয়েছে দেয়ালের মতো। কেউ যাতে চাইলেই স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়তে না পারে, সে জন্যই ফেডারেশনের এমন ব্যবস্থা। মাঠকর্মীরা নেই। হকি মাঠের নীল টার্ফে পানি পড়েনি দীর্ঘদিন। আগের সেই ঔজ্জ্বল্য হারাতে বসেছে। কালচে বর্ণ ধারণ করেছে টার্ফ।

নিষ্প্রাণ পল্টন: পল্টন খেলার পাড়াতেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের উল্টো দিকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়াম ও শহীদ তাজউদ্দীন ইনডোর। দুই গেটেই তালা দেওয়া। বক্সিংয়ের সামনে আউটার স্টেডিয়াম। বছরজুড়ে এখানে চলে ক্রিকেট ও ফুটবলের অনুশীলন। খেলোয়াড়দের দাপাদাপিতে আগে মাঠে ঘাসই থাকত না। এখন সেখানেও সবুজের প্রাচুর্য। তালাবন্ধ শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্স আর হ্যান্ডবল স্টেডিয়াম। কাবাডি স্টেডিয়ামে সংস্কারকাজ চলছে। পাশের ভলিবল স্টেডিয়াম একেবারেই ফাঁকা।

জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে ভাসছে শেওলা। কাল মিরপুরের সুইমিং কমপ্লেক্সের পুলে।  প্রথম আলো
জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে ভাসছে শেওলা। কাল মিরপুরের সুইমিং কমপ্লেক্সের পুলে। প্রথম আলো

সুইমিংপুলে শেওলা ভাসে: পল্টনে একসঙ্গে অনেক খেলার বসবাস। সেখানেই যদি থাকে এমন কবরের নিস্তব্ধতা, মিরপুরে একাকী পড়ে থাকা সুইমিং কমপ্লেক্সের অবস্থা তো কল্পনা করাই যায় না। আশপাশে শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম আর ইনডোর কমপ্লেক্স থাকলেও পল্টনের মতো এখানকার ক্রীড়া স্থাপনাগুলো অত গা ঘেঁষাঘেঁষি করে নেই।

সব ঠিক থাকলে এই সময়ে বাংলাদেশ গেমসের জন্য প্রস্তুত থাকত মিরপুর সুইমিং কমপ্লেক্স। সুইমারদের বুক পেতে নেওয়ার অপেক্ষায় থাকত পুলের স্বচ্ছ পানি। চলত সাঁতারুদের অনুশীলন। কিন্তু করোনাকালে পুলে যে সাঁতার কাটার মতো পানিই নেই! জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে শেওলা পড়েছে। পাশের ডাইভিং পুলও শুকনো খটখটে। ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে কোনো ভাষা নেই। খাঁ খাঁ করছে সুইমিং কমপ্লেক্সের পাশের ক্রীড়াপল্লির নতুন ভবন। অনেক দিন ঝাড়ু পড়েনি বলে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া ফুলের আচ্ছাদনে লালগালিচার মতো মনে হয় সামনের রাস্তাটাকে।

করোনার রূঢ় সময় কবে শেষ হবে, কেউ জানে না। তবে মানুষের মতো মাঠ–সাঁতারপুলেরও যেন স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আকুতি। খেলা ফিরুক খেলার নিয়মে।