খেলা নেই, তবু আছে প্রাণ

>খেলা নেই, কর্মকর্তারা বিসিবির কার্যক্রম চালাচ্ছেন বাসা থেকে। কিন্তু মাঠ পরিচর্যার কাজ তো আর বাসা থেকে হয় না।

বিশাল লোহার গেটটা পেরিয়ে সবুজ ঘাসে পা বাড়াতেই কিচিরমিচির শব্দ। মেঘলা দুপুরে সুনসান নীরবতায় মনের আনন্দে ঘাসফুলের ভিড়ে খুঁটে খুঁটে ঘাসপোকা খাচ্ছে শালিকের দল। তাদের বিরক্ত করার কেউ নেই মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে। 

নীরবতা ভাঙে ঘাসকাটার যন্ত্রের ভোঁ ভোঁ শব্দে। পাঁচ-ছয়জন মাঠকর্মী তখন শেরেবাংলার সবুজ ক্যানভাসটা ঠিক রাখার কাজে ব্যস্ত। সরকারি নির্দেশনা মেনে ১৫ মার্চ থেকে সব ধরনের ক্রিকেটীয় কার্যক্রম স্থগিত করেছে বিসিবি। ২২ মার্চ থেকে ঘরে বসে চলছে ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজ। 

কিন্তু মাঠের পরিচর্যা তো আর ঘরে বসে হয় না! ক্রিকেট মাঠে এই কাজটা বন্ধ রাখারও উপায় নেই। সে জন্য পালা করে কাজ করতে হচ্ছে গ্রাউন্ডসম্যানদের। সেটির প্রতিফলন স্টেডিয়ামে ঢুকলেই চোখে পড়ে। কোথাও অযত্ন–অবহেলার চিহ্ন নেই। এক অর্থে গ্রাউন্ডসম্যানরাও অবশ্য ‘হোম অফিস’ই করছেন। কারণ, তাঁদের থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা আরও আগে থেকেই স্টেডিয়ামের ভেতরে। 

করোনার দিনেও থেমে নেই মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের মাঠকর্মীদের কাজ। মাঠের নিয়মিত পরিচর্যার কাজটা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। কাল দুজন মাঠকর্মীকে ব্যস্ত দেখা গেল ঘাস ছোট করার কাজে।  ছবি: রানা আব্বাস
করোনার দিনেও থেমে নেই মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের মাঠকর্মীদের কাজ। মাঠের নিয়মিত পরিচর্যার কাজটা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। কাল দুজন মাঠকর্মীকে ব্যস্ত দেখা গেল ঘাস ছোট করার কাজে। ছবি: রানা আব্বাস

মাঠে নিয়মিত পানি দেওয়া, ঘাস ছোট করে রাখা, বাজে ঘাস বাছা—নিয়মিত এসব কাজ করে যাচ্ছেন মাঠকর্মীরা। শ্রীলঙ্কান কিউরেটর গামিনি ডি সিলভা ঢাকায় থাকলেও স্টেডিয়ামে খুব একটা আসা হয় না তাঁর। গামিনির সহকারী আব্দুল মতিন বলছিলেন, ‘আমরা সব প্রস্তুত করে রাখছি, যেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে চাইলেই মাঠটা খেলার জন্য দিতে পারি।’

মিরপুরে মোট মাঠকর্মী ৪৩ জন। বিসিবির গ্রাউন্ডস বিভাগ চেয়েছিল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সব মাঠকর্মীকে আট দিন করে ছুটি দিতে। কিন্তু ছুটির অংশ হিসেবে শুরুতে যাঁরা বাড়িতে গিয়েছিলেন, তাঁরা আর ফিরতে পারেননি। এ মুহূর্তে কাজ করছেন ১৪ জন। মাঠকর্মীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় পরিচর্যার ক্ষেত্রে একাডেমি মাঠ ও ইনডোরের বাইরের উইকেট স্বাভাবিকভাবেই একটু কম গুরুত্ব পাচ্ছে তাঁদের কাছে। দুই জায়গাতেই ঘাসগুলো বেশ বড় হয়ে গেছে। কাশফুলের ঝাড় গজাচ্ছে ড্রেসিংরুমের সামনে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ হয়নি সিলেট ও চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের পরিচর্যার কাজও। চট্টগ্রামে ১৮ মাঠকর্মীর ১১ জনই আছেন স্টেডিয়ামে। সিলেটে আছেন ১৭ মাঠকর্মীর মধ্যে ১০ জন। গামিনি ডি সিলভার মতো বিসিবির দুই ভারতীয় কিউরেটর প্রবীণ হিংগানিকার ও সঞ্জীব আগারওয়ালও দেশে যেতে পারেননি। প্রবীণ আছেন চট্টগ্রামে আর সঞ্জীব সিলেটে। 

প্রায় দুই মাস ধরে অব্যবহৃত পড়ে আছে ইনডোরের বাইরের উইকেটগুলো।  ছবি: প্রথম আলো
প্রায় দুই মাস ধরে অব্যবহৃত পড়ে আছে ইনডোরের বাইরের উইকেটগুলো। ছবি: প্রথম আলো

করোনার সময় কাজ করতে হচ্ছে বলে মাঠকর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে—জানালেন গ্রাউন্ডস বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার আব্দুল বাতেন। তিনি বলেন, ‘মাঠকর্মীদের স্যানিটাইজার, গ্লাভস, মাস্ক ইত্যাদি দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে যতটুকু সম্ভব কাজ করা হচ্ছে। না হলে মাঠটা নষ্ট হয়ে যাবে। কাজ করতে কর্মীদের জোর করা হচ্ছে না। এখানে যারা থাকছে, তারাই শুধু করছে।’

স্বাস্থ্য নিরাপত্তার সরঞ্জামাদির পাশাপাশি খাদ্যসহায়তা ও বিসিবি সভাপতির পক্ষ থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে মাঠকর্মীদের। মাঠকর্মীদের পাশাপাশি মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে সক্রিয় নিরাপত্তাকর্মীরাও। 

ড্রেসিংরুমের সামনে যেতেই চোখে পড়ল কাচের দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা ঢাউস একটা সাদা বোর্ড। মার্কার দিয়ে তাতে লেখা ‘স্টাম্প হিটিং লিডারবোর্ড’, নিচে খেলোয়াড়দের একটা তালিকা। খেলা বন্ধের আগে সেটি যে উদ্দেশ্যেই লেখা হয়ে থাকুক না কেন, এখন তার অর্থ ভিন্ন। বুকের মধ্যে নামগুলো ধরে রেখে শেরেবাংলা স্টেডিয়াম যেন নীরবে অপেক্ষা করছে ওই খেলোয়াড়দের জন্যই।