সেদিন বার্সেলোনাকে যেভাবে বশ করেছিল লিভারপুল

প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হওয়া সেই স্কোর কার্ড। ফাইল ছবি
প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হওয়া সেই স্কোর কার্ড। ফাইল ছবি
>গত বছর ঠিক এই দিনে অবিশ্বাস্যভাবে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়ে বার্সেলোনা। প্রথম লেগে তিন গোলে পিছিয়ে থাকার পরেও নিজেদের মাঠ অ্যানফিল্ডে লিওনেল মেসির দলকে চার গোল দিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে অন্যতম 'কামব্যাক' কাব্য রচনা করে ইংলিশ ক্লাবটি

মে মাসের এই আট তারিখ দিনটা ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে উধাও হয়ে গেলে কেমন হতো? অন্তত বার্সেলোনার সমর্থকেরা এ জিনিসটা চাইতেই পারেন। ভাবতে পারেন, কোনো এক ভোজবাজির মতো যদি এই দিনটা একদম নাই হয়ে যেত, কতই না ভালো হত!

কিন্তু কেন? খোলাসা করে বলা যাক। ২০০৮ সালের কথা। জার্মান কোচ বার্নড শুস্টারের অধীনে রিয়াল মাদ্রিদ তখন অপ্রতিরোধ্য। ৮৫ পয়েন্ট নিয়ে লিগ শিরোপা জিতেছিলেন ক্যাসিয়াস, ক্যানাভারো, রামোস, রাউল, রবিনহোরা। ওদিকে ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডের প্রতাপশালী বার্সা তখন অস্তগামী। মেসি তখন আজকের মেসি নন। একই কথা খাটে জাভি-ইনিয়েস্তা-পুয়োল নিয়েও। রোনালদিনহো, জামব্রোত্তা, রাফায়েল মার্কেজের বার্সা রিয়ালের সঙ্গে লিগে পেরে ওঠেনি। বেশ বাজেভাবেই পর্যুদস্ত হয়েছিল।
শীর্ষে থাকা রিয়ালের সঙ্গে তাদের পয়েন্ট ব্যবধান ছিল ১৫, লিগে মেসিরা হয়েছিলেন তৃতীয়। লিগের ৩৬তম ম্যাচ খেলতে বার্সা যখন রিয়ালের মাঠে যায়, রিয়ালের লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিশ্চিত। আর লিগ শিরোপা নিশ্চিত হওয়ার পর যে রীতি, অনিচ্ছাসত্ত্বেও বার্সার খেলোয়াড়দের সেটা করতে হয়েছিল। ম্যাচ শুরুর আগে চ্যাম্পিয়ন দলকে গার্ড অফ অনার দিতে হয়েছিল পুয়োল-জাভিদের।

রিয়াল ম্যাচটাও খেলেছিল চ্যাম্পিয়নের মতো। একটি করে গোল দিয়েছিলেন রাউল, আরিয়ান রোবেন, গঞ্জালো হিগুয়েইন ও রুড ফন নিস্টলরয়। বার্সার হয়ে সান্ত্বনার গোলটা করেন থিয়েরি অঁরি, মেসির অ্যাসিস্ট থেকে।

এগারো বছর পর আবারও সেই ৮ মে, আবারও বার্সার আরেকটি হতাশা-কাব্য।

এ ম্যাচটায় কী হয়েছিল, কে না জানে!

রোমের ক্ষতটা তখনও দগদগে। এক বছর পেরোতে না পেরোতে ঐ একই ঢঙ্গে আজকের এই দিনে লিভারপুলের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিল বার্সেলোনা। রোমা কিংবা লিভারপুল - দুটি ম্যাচেরই চিত্রনাট্য এক। প্রথম লেগে নিজেদের মাঠে দোর্দণ্ড প্রতাপ প্রদর্শন, প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে অসহায় আত্মসমর্পন!

প্রথম লেগে নিজেদের মাঠে ৩-০ গোলে জিতেছিলেন মেসিরা। মেসির অবিশ্বাস্য ফ্রি-কিক, পাকা শিকারীর মতো ওঁত পেতে থাকা লুইস সুয়ারেজের নিখুঁত ফিনিশিং–কী ছিল না সেই ম্যাচে! ম্যাচের শেষ দিকে ওসমানে ডেম্বেলে একটা সহজ সুযোগ মিস করেছিলেন। কে ভেবেছিল, ওই মিসটাই বার্সাকে এত কাঁদাবে?

পরের লেগে জিতে ফাইনালে উঠতে হলে লিভারপুলকে পাহাড়সম বাধা অতিক্রম করতে হতো। কিন্তু এ যে লিভারপুল, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর দুর্দান্তভাবে ফিরে আসার রক্তটা যে তাদের ধমনীতেই বইছে। ২০০৫ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে এসি মিলানের বিপক্ষে সেই 'কামব্যাক', ২০০১ সালে উয়েফা কাপের ফাইনালে আলাভেসের বিপক্ষে পিছিয়ে পড়ার পরেও জয়, ১৯৭৯ সালে ক্লাব ব্রুজেসের বিপক্ষে একইভাবে ফাইনাল জিতে ইউরোপিয়ান কাপ নিজেদের করে নেওয়া–লিভারপুলের 'ফিরে আসার উপাখ্যান' লিখতে বসলে একটা উপন্যাসই হয়ে যাবে।

চ্যাম্পিয়নস লিগে আরও একবার হতাশা সঙ্গী হলো মেসিদের। ফাইল ছবি
চ্যাম্পিয়নস লিগে আরও একবার হতাশা সঙ্গী হলো মেসিদের। ফাইল ছবি

কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ জানতেন, এই অবস্থা থেকে ফাইনালে যদি কোন দল উঠতে পারে, সেটা লিভারপুলই। তার ওপর বাড়তি প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল দ্বিতীয় লেগের ভেন্যু। এমন অবস্থায় নিজেদের মাঠে কে না খেলতে চাইবে? মাঠের এগারো জন, আর গ্যালারিতে হাজার হাজার সমর্থক –'দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার' অতিক্রম করতে ক্লপ যেমন পরিবেশ চেয়েছিলেন, ঠিক তেমনটাই পেয়েছিলেন।

পাননি শুধু নিজের পছন্দের একাদশটাকে। দলের আক্রমণভাগের বিখ্যাত 'ত্রয়ী'র দুজন ; মোহাম্মদ সালাহ আর রবার্তো ফিরমিনো ছিলেন না চোটের কারণে। চোট সমস্যায় প্রায় বাদ পড়তে যাচ্ছিলেন দলের অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসন ও লেফটব্যাক অ্যান্ডি রবার্টসন। আগের চার মাস যে উইঙ্গার বেঞ্চে বসে কাটিয়ে দিয়েছিলেন, সে জের্দান শাকিরির সুযোগ হয়েছিল এ ম্যাচে। সুযোগ পেয়েছিলেন বেলজিয়ান স্ট্রাইকার ডিভক অরিগি। একে তো দরকার নূন্যতম চার গোল, তাঁর ওপর আক্রমণভাগের মূল দুজনই নেই। গোল আসবে কীভাবে? আশা কোথায়?
কিন্তু ক্লপ আশা দেখেছিলেন। নিজের বহুল পরীক্ষিত ৪-৩-৩ ছকেই ভরসা রেখেছিলেন। ফিরমিনোর জায়গায় অরিগি, সালাহর জায়গায় শাকিরি। ফিরমিনো যেমন স্ট্রাইকার হলেও একদম মাঝমাঠে নেমে এসে দুই উইঙ্গে মানে আর সালাহর কাছে বল বাড়িয়ে দেন, সেদিনের স্ট্রাইকার অরিগির ভূমিকা ছিল একটু ভিন্ন। মাঝমাঠে নামা লাগবে না, বরং ক্রমাগত বার্সার দুই সেন্টারব্যাক পিকে-লংলের মাঝখানের জায়গাটায় দৌড়াদৌড়ি করে তটস্থ করে রাখো।

আর ওদিকে লেফট উইংয়ে সাদিও মানে ছিলেন তাঁর মতোই। দুর্দান্ত গতিশীল, সুযোগ পেলেই ডি-বক্সে ঢুকে যাচ্ছিলেন।

মাঝমাঠে ছিলেন ফাবিনহো, জর্ডান হেন্ডারসন ও জেমস মিলনার। তিনজন যে জাভি, ইনিয়েস্তা কিংবা পিরলো-রোনালদিনহোর মতো সৃষ্টিশীল, সেটা তাদের সবচেয়ে বড় সমর্থকেরাও স্বীকার করবেন না । তবে তিনজনের খেলার একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল, যন্ত্রের মতো একই গতিতে খেলে যেতে পারেন পুরো নব্বই মিনিট। মাঠের প্রতি ইঞ্চি দৌড়ে প্রতিপক্ষকে 'ধাওয়া' করার সামর্থ্য আছে তাদের।

মিডফিল্ডে ক্লপের এমন তিনজনই দরকার ছিল। সুযোগসন্ধানী অরিগি ও মানের পেছনে যে তিন মিডফিল্ডার মেসিদের এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তেও প্রস্তুত নন। মিডফিল্ড থেকে কোনোভাবে মেসিদের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে সামনে বাড়িয়ে দাও, বাকিটা মানে আর অরিগি দেখবে। সঙ্গে শাকিরি তো আছেই বার্সার লেফটব্যাক জর্ডি আলবাকে ব্যস্ত রাখার জন্য।

বার্সার গোটা রক্ষণভাগের মধ্যে এই আলবাকেই 'পাখির চোখ' করেছিলেন ক্লপ। কারণ একটাই, মাঝেমধ্যেই রক্ষণকাজটা কীভাবে করতে হয়, সেটা ভুলে যান এই স্প্যানিশ তারকা। এই ভুলের সুযোগ নিয়েই প্রথম গোলটা আসে। বল ক্লিয়ার করতে পারেননি আলবা, বল চলে যায় পেছনে ওঁত পেয়ে থাকা মানের কাছে। তাঁর পা থেকে জর্ডান হেন্ডারসন হয়ে অরিগির পায়ে বল। ইতোমধ্যেই হেন্ডারসনের শট আটকাতে গিয়ে শুয়ে পড়া গোলরক্ষক মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগেনকে হারিয়ে বল জালে জড়ানোর জন্য এর চেয়ে বড় সুযোগ কি আর পেতেন অরিগি?

আলবাকে এভাবেই লক্ষ্য বানিয়েছিল লিভারপুল। রাইটব্যাক ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার আরনল্ডের গতির সঙ্গে সেদিন পেরে ওঠা আলবার কম্মো ছিল না। স্প্যানিশ এই লেফটব্যাক নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন, পারছেন না। আগের বছরের রোমা-দুঃস্বপ্নের কথাও কি মনে আসেনি? এসেছে হয়তো। না হয় মাত্র এক গোলে পিছিয়ে থেকেও (দুই লেগ মিলিয়ে তখনও ৩-১ গোলে এগিয়ে বার্সা) মাঝ বিরতিতে ড্রেসিংরুমে ওভাবে ভেঙে পড়ে কান্না করা শুরু করবেন কেন?

ওদিকে লিভারপুলের লেফটব্যাক রবার্টসনও একদমই পারছিলেন না। চোটের কাছে হার স্বীকার করে মাঠ থেকে উঠে যান, মিলনার চলে আসেন লেফটব্যাকের ভূমিকায়। রবার্টসনের জায়গায় মাঠে নামেন জর্জিনিও ভাইনাল্ডাম। রক্ষনভাগের পাঁচজনের পাশাপাশি মিডফিল্ডে হেন্ডারসন-ফাবিনহো যেহেতু মেসিদের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন, এই অবস্থায় এই ডাচ মিডফিল্ডারের ওপর একটাই দায়িত্ব দিলেন ক্লপ, 'সুযোগ বুঝে ওপরে উঠে যাও, অনেকটা দ্বিতীয় স্ট্রাইকারের ভূমিকা পালন কর।' আর এই কৌশলেই হলো কিস্তিমাত।

বামদিকে রবার্টসন না পারলেও, ডানদিকে আলেক্সান্ডার-আরনল্ড ঠিকই আলবার জীবন জেরবার করে ফেলছিলেন। দ্বিতীয় গোলটাও এল ওভাবেই। আরনল্ডের কাছ থেকে ডানপ্রান্ত দিয়ে আসা মাটিঘেঁষা ক্রসটা গোলমুখে পাঠাতে ভুল করলেন না ভাইনাল্ডাম। ব্যবধান ২-০!

বদলি নামা ভাইনাল্ডাম ম্যাচের রূপই বদলে দিয়েছেন। ফাইল ছবি
বদলি নামা ভাইনাল্ডাম ম্যাচের রূপই বদলে দিয়েছেন। ফাইল ছবি

'উপরে কী ভাইনাল্ডামকে আসলেই মার্ক করতে হবে? স্ট্রাইকারদের মতো? কিন্তু ও না মিডফিল্ডার?' পিকে-আলবাদের এই দোনমনার সুবিধা আরেকবার নিতে দুই মিনিটও লাগালেন না ডাচ তারকা। তৃতীয় গোলও অনেকটা দ্বিতীয় গোলের চিত্রনাট্যই মেনে চলল। উইং থেকে আসা বলে ভাইনাল্ডামের ছোঁয়া। আগে ডানপ্রান্ত থেকে আরনল্ড ক্রস দিয়েছিলেন, এবার বামপান্ত থেকে শাকিরি। ফলাফল একই। গোল!

বার্সেলোনা তখন এক বছর আগের রোম-বিপর্যয়ের কথা মনে করে একদম গতিহীন, নিশ্চল। নাবিকহারা নৌকার মতো। শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার এটাই মোক্ষম সময়, ভাবলেন অরিগি। কর্নার থেকে আসা আরনল্ডের বলটা যখন অরগির পায়ে এল, পিকেদের হুঁশই ছিল না, খেলা চলছে যে! 'কর্নার টেকেন কুইকলি... অরিগি...' এই চারটা শব্দ ইতিহাসেরই অংশ হয়ে গেল যেন!

চার গোল দেওয়ার আগের লিভারপুলের কীর্তি নিয়ে যতটা আলোচনা হয়েছে, চার গোল দেওয়ার পর বাকী ১৬ মিনিট গোল না খাওয়ার কীর্তিটা নিয়ে কিন্তু মোটেও আলোচনা হয়নি। তবে পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচারে মরিয়া মেসিদের ঐ শেষ ১৬ মিনিট গোল না করতে দেওয়াটাও কিন্তু কম কৃতিত্বের কাজ নয়। কারণ, মেসিরা কোনোভাবে একটা গোল দিয়ে ফেললেই ব্যস! বাদ পড়তে হতো লিভারপুলকে।

৪-৩-৩ ছকটা নিমেষেই হয়ে গেল ৪-১-৪-১। ততক্ষণে অরিগি-শাকিরি মাঠ থেকে উঠে পড়েছেন, নেমেছেন ডিফেন্ডার জো গোমেজ আর স্ট্রাইকার ড্যানিয়েল স্টারিজ। লেফটব্যাক হিসেবে গোমেজ খেললেও, তিনি আদতে তৃতীয় সেন্টারব্যাকের ভূমিকাই পালন করেছেন ঐ সময়টায়। চারজন ডিফেন্ডার পর্যন্ত যাতে মেসিরা না পৌঁছুতে পারেন, এ জন্য আদর্শ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের ভূমিকায় খেলে গেছেন ফাবিনহো। হেন্ডারসন ভাইনাল্ডামও মাঝমাঠে জায়গা ফাঁকা দেননি একটুও। বামদিকে মিলনার, ডানদিকে মানে। আর সামনে একক স্ট্রাইকার হিসেবে তখন স্টারিজ।

রক্ষণাত্মক এই কৌশলেও লিভারপুল ছিল সফল। ঐ ১৬ মিনিটে মেসিরা লিভারপুলের গোল বরাবর একটা শটও নিতে পারেননি!

শট নিতে পারলে হয়তো আট মার্চ দিনটা বার্সাকে এতটা কষ্ট দিত না!