জার্মানিতে ২ মাসের বেশি আটকে আছি

>আনা ফ্রাঙ্ক ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা তাঁর ডায়েরির জন্য। অনেকে বলেন, করোনাভাইরাস আক্রান্ত এই অনিশ্চিত সময়টাও নাকি বিশ্বযুদ্ধের মতোই। ক্ষুদ্র এক অনুজীবের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী তো যুদ্ধেই নেমেছে! তা এই সময়ে বাংলাদেশের ঘরবন্দী খেলোয়াড়েরা যদি ডায়েরি লিখতেন, কী থাকত তাঁদের লেখায়? খেলোয়াড়দের হাতে কলম তুলে দিয়ে সেটিই জানার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো-
গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব। ফাইল ছবি
গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব। ফাইল ছবি

গত ৫ মার্চ ঢাকা থেকে জার্মানি রওনা হই দুটি টুর্নামেন্ট খেলতে। ৬ তারিখ পৌঁছাই। ৭-১৬ মার্চ একটা ওপেন জিএম টুর্নামেন্ট ছিল এখানে। আমার আরেকটি লক্ষ্য ছিল 'চেস বুন্দেসলিগার' ম্যাচ খেলা। বুন্দেসলিগা বলতে আমরা জার্মান ফুটবল লিগই হয়তো বুঝি। কিন্তু এ দেশে দাবা লিগের নামও বুন্দেসলিগা। এটিকে দাবা বিশ্বের সেরা লিগ ধরা হয়।

পাঁচ বারের সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথন আনন্দও এই লিগে খেলেন। তাঁর দল চ্যাম্পিয়নও হয়। আমি একটি দলের হয়ে খেলতে এসেছি। আমার সঙ্গে বাংলাদেশের ফিদে মাস্টার তৈয়বুর রহমানও একই দলে খেলতে আসে। তেয়বুর লিগের একটা ম্যাচ খেললেও আমি কোন ম্যাচ খেলার আগেই করোনাভাইরাসের কারণে দাবার সব টুর্নামেন্ট বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। মাঝে মাঝে জীবনের গতি থেমে যায়। তাই বলে এভাবে থেমে যাবে ভাবতেই পারিনি।
বুন্দেসলিগায় আমি আগেও একবার খেলেছি। লিগটা ৭-৮ মাসব্যাপি চলে। এবারের লিগ গত ২৩ নভেম্বর শুরু হয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল ২ মে। এত লম্বা সময় এখানে থেকে খেলা সম্ভব নয়। তাই সাধারণত আসি না। তবে এবার সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কয়েকটি ম্যাচ খেলতে এসেছিলাম। ভারতের অনেক দাবাড়ু এই লিগে খেলে। এটি চার স্তরের লিগ। যতটুকু জানি, বিশ্বে জার্মানিতেই সবচেয়ে বেশি রেটেড দাবাড়ু আছে।

আমি এখন ফ্রাংকফুটের কাছে মেইনজ শহরে। কদিন আগে এখানে ঠান্ডা ছিল। এখন বেশ রোদ। ভালো লাগছে প্রকৃতি। কিন্তু খারাপ লাগছে মাত্র ২ সপ্তাহ জার্মানিতে থাকার প্রস্তুতি নিয়ে এসে দুই মাসের বেশি থাকতে হলো বলে। আরও কতদিন থাকতে হয় কে জানে! ব্যয়বহুল একটা দেশে এত লম্বা সময় থাকা কঠিন। এখানে বড় বোনের বাসায় আছি বলে রক্ষা।
জার্মানিতে করোনা পরিস্থিতি ইতালি, ফ্রান্স বা যুক্তরাজ্যের মতো খারাপ হয়নি। ইউরোপে সবচেয়ে কম মৃত্যু এ দেশেই। শুধু নিজেদের নয়, অন্য দেশের করোনা রোগিরও চিকিৎসা করছে জার্মানি। এক দেশের বিপদে আরেক দেশ পাশে দাঁড়িয়েছে। এটা দারুণ ব্যাপার। আমি যে এলাকায় আছি এখানে এখন লকডাউন অনেকটাই শিথিল। স্কুল, কলেজ বন্ধ থাকলেও গত ২০ এপ্রিল পরীক্ষামূলকভাবে ছোট দোকানপাটসহ অনেক কিছু খুলেছে। কিছু দিন আগেও ২ জনের বেশি একসঙ্গে চলাফেরা করা যেত না। এখন চাইলে ঘরের বাইরে যাওয়া যায়। তবে খুব প্রয়োজন ছাড়া আমি বের হই না ।
ঘরে দাবাই আমার সঙ্গী। দাবাড়ুদের সবচয়ে বড় সুবিধা খেলাটা অনলাইনে খেলা যায়। অপ্রত্যাশিত এই অবসরে অনলাইনে দাবা খেলে অনেকটা সময় পার করছি। দাবা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে নানা আলোচনা করি। দাবাড়ুদের অনলাইনে আড্ডা বা খেলাটা খুব কাজে দেয়। এমনিতে সিনেমা-টিনেমা কমই দেখি। তবে এই কদিনে কে কটা সিনেমা দখেছি তা মনে হয় সারা জীবনের চেয়ে বেশি। এ ছাড়া গল্পের বইও পড়ি সময় কাটাতে।

কিন্তু একটা জায়গায় এত লম্বা সময় আটকে থেকে আর ভালো লাগছে না। এই সময়ে খেলার প্রতি মনোযোগ ধরে রাখাও কষ্টকর। দেশে ফিরতে উদগ্রীব হয়ে আছি। কিন্তু কবে ফিরতে পারব জানি না। কবে খেলা শুরু হবে সেটাও অজানা। এসব ভাবলে খারাপ লাগে। চলতে চলতে হঠাৎ এভাবে কড়া ব্রেক কষতে হবে কখনো ভাবিনি। জার্মানিতে এসে আটকা পড়ব, তাও ভাবনায় ছিল না। করোনকালীন জীবনে ডায়েরি লিখলে হয়তো এই কথাগুলোই লিখতাম।

ভালো কথা, আমি জার্মানি আসারও একমাস আগে এখানে খেলতে আসেন বিশ্বনাথন আনন্দ। ৩ মাস হয়ে গেল তিনিও জার্মানিতে। ভাবাই যায় না খেলতে এসে এভাবে বন্দি আছেন ভিন দেশে! কিন্তু মানুষ যা ভাবছে তার ঠিক উল্টোটাই হয়তো ভাবছে করোনাভাইরাস। করোনাকে হারাতে ভিনদেশে বন্দি থেকেও যদি ভালো হয়, তবে তাই হোক!