তামিমের মঞ্চে বিরাটের 'মাস্টারক্লাস'

তামিমের সঙ্গে আলাপে ক্রিকেট নিয়ে অনেক কিছুই বললেন বিরাট কোহলি। ফাইল ছবি
তামিমের সঙ্গে আলাপে ক্রিকেট নিয়ে অনেক কিছুই বললেন বিরাট কোহলি। ফাইল ছবি

আমি সবসময় বিশ্বাস করেছি, আমি যে কোন পরিস্থিতি থেকে ম্যাচ জেতাতে পারব। সেটা যত কঠিনই হোক'— বক্তার নাম শেন ওয়ার্ন। কাল তামিম ইকবাল ফেসবুক লাইভে বিরাট কোহলির প্রায় একই কথা বলেছেন, 'পরিস্থিতি যাই হোক, দলকে জেতানোর চেষ্টা করবো।'

 বড় ক্রিকেটারদের ক্রিকেট দর্শনটাই এমন। কাল তামিমও এই প্রজন্মের সবচেয়ে বড় ক্রিকেটার বিরাটকে পেয়ে তাঁর ক্রিকেট দর্শনটা জেনে নিয়েছেন। তামিমের কিছু প্রশ্নের জবাবে কোহলি যা বলেছেন তা যে কোন ক্রিকেটারের জন্য ভাবনায় বদলাতে সাহায্য করবে। এ যেন এক ক্রিকেট 'মাস্টারক্লাস'!

 ক্যারিয়ারের শুরুতে বিরাট অতো আহামরি কিছু করেনি। অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে চ্যাম্পিয়ন করালেও সেই বয়স ভিত্তিক দলের কোহলি আর এখনকার কোহলিতে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ব্যাটিং কৌশল, ফিটনেসেও বিশাল ফারাক। তবে ভারতকে জেতানোর জেদ শুরুতে যেমন ছিল, এখনো ঠিক তেমনই। তামিম কাল কোহলিকে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুতে নিয়ে যান। শুরুর অনিশ্চয়তা থেকে ভারতের অপরিহার্য ক্রিকেটে পরিণত হওয়ার পেছনে মানসিকতা, দর্শনটাইকে মূল কারন হিসেবে দেখিয়েছেন কোহলি।

 তিনি বলছিলেন, 'শুরুতে সবার ভেতরই দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকে। অভিষেকের পর একটি সিরিজ খেলে দল থেকে বাদ পড়েছিলাম। তারপর আবার ডাক পাই ২০০৯ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির দলে। সেখানে দুই-তিনটি ম্যাচে আমি ভালো খেলেছিলাম, একটি শতকও ছিল। সেখান থেকে আমার আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। তখন মনে হয় আমি এখানে পারফর্ম করতে পারব। আমার বিশ্বাস ছিল আমার চেয়ে একজন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান যদি আউট হয়ে যায় তবু আমি ম্যাচ জেতাতে পারব। নিজের যোগ্যতার ওপর বিশ্বাস রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যেকোনো পরিস্থিতিকে ভিন্ন চোখে দেখতে পারেন। যদি অন্যরা সেটা না দেখতে পারে এবং আপনি পারেন, তাহলে আপনার পারফরমেন্স ভালো হবে, আপনি ম্যাচ জেতাতে পারবেন। এই ব্যাপারটা আমি নিয়মিত অনুশীলন করে আসছি। ম্যাচে যদি আপনার মনোভাব যদি ঠিক থাকে তাহলে সেটার ফল আসবেই। এটাই ছিল আমার সাধারণ প্রক্রিয়া যে আমি যাবো এবং যা কিছুই হোক না কেন দলের জন্য খেলবো। দলকে জেতানোর চেষ্টা করবো।'

 কিন্তু ক্রিকেট অনিশ্চয়তায় খেলা। বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের মনের ভেতর নিজের যোগ্যতা, সামর্থ্য নিয়ে ভয় ঢুকতে বাধ্য। কোহলিও নাকি ব্যতিক্রম নন। তামিম যেমন কাল প্রশ্ন করেছিলেন, 'নিজেকে নিয়ে কখনো সন্দেহ জেগেছে? কখনো মনে হয়েছে আমি যথেষ্ট ভালো নই?'

 কিছুক্ষণ চিন্তা করে কোহলি উত্তরে জানালেন, খেলার সময় নিজেকে নিয়ে সন্দেহ না হলেও অনুশীলনে নিজের সামর্থ্য প্রশ্ন জেগেছিল তাঁর মনে। খেলার সময় প্রতিযোগিতার উত্তাপে নাকি নেতিবাচক ভাবনা কোহলির মাথায়ই আসে না! অলস অনুশীলন বরং সন্দেহ ঘনীভূত করে, 'খেলার একটি ভালো দিক হচ্ছে সেখানে আপনি এসব চিন্তাভাবনার সময় পাবেন না। আপনি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিবেন, ব্যাটিং করবেন। দলের কি অবস্থা, আপনাকে দলের জন্য কি করতে হব এসব ভাবনাতেই আপনার এনার্জি চলে যাবে। খারাপ চিন্তাভাবনা মাথায় তখনই আসে যখন খেলার বাইরে থাকি, যখন সেই প্রতিযোগিতামূলক ভাবটা থাকেনা।'

 নিজের সামর্থ্য নিয়ে দোটানার ক্যানসার বাসা বাঁধতেই নাকি কঠিন আত্মবিশ্বাস প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করা শুরু করে, 'আমি যদি বিশ্বাস করি আমি যথেষ্ট ভালো, তাহলে আমি যথেষ্ট ভালো। তাই নিজেকে আমি শুধু বলতে থাকব, আমি যথেষ্ট ভালো। আমি নেটে যাবো এবং নিজের প্রবাহটা ঠিক থাকবে। আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে। তবেই নেতিবাচক ভাবনা ধীরে ধীরে কেটে যাবে। আমাদের কাজটা হল শুধু নিজের কাছে স্পষ্ট থাকা।'

 কোহলির সঙ্গে কথা হলে আর ফিটনেস নিয়ে কথা হবে তা হয় কী করে! কোহলির ফিটনেস ও শৃঙ্খলার প্রসঙ্গে তামিম বলছিলেন, 'একটা সময় ছিল যখন আমরা ফিটনেস ও শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন খেলার বিভিন্ন তারকাদের উদাহরণ কথা বলতাম। এখন আমরা গর্ব করে বলতে পারি, আমাদের ক্রিকেট দুনিয়ায় এমন একজন আছেন, যিনি হলেন আপনি। আমাদেরকে বিনোদন দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।'

 ম্যাচের আগে কোহলি প্রস্তুতির কথা জানতে চাইলে চলে আসে ফিটনেস প্রসঙ্গ। যে কোন ম্যাচের আগে কোহলির মূল প্রস্ততি নাকি ফিটনেস ও ডায়েট। ফিটনেস ঠিক থাকলে নাকি নেটে গিয়ে কিছুক্ষণ ব্যাটিং করলেই হয়। নেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানোর পক্ষে নন তিনি, 'কিছুক্ষণ অনুশীলন করে উঠে যাই। কারণ একটা জিনিস যখন ভালো হয় এবং আপনি সেটা অতিরিক্ত করে ফেলেন তখন বাজে অভ্যাস হয়ে যায়। যেহেতু সব শটই খেলতে পারছেন তাই আপনি যেকোন শটই মারা শুরু করে দিবেন। সেখানে কিছু ভুল হতে পারে, হতাশা তৈরি হতে পারে। আপনি আরও খেলতে থাকবেন এবং আরও খারাপ হতে পারে। এই সচেতনতাটা সবার থাকা উচিত। প্রত্যেক ব্যাটসম্যানই বুঝতে পারে এই সেশনে তার সব ঠিকমত হয়েছে। নেট থেকে বের হয়ে আসাও একটা স্কিল। আপনাকে জানতে হবে কখন নেট থেকে বের হতে হবে। কারণ সেই অতিরিক্ত দশ-পনেরো মিনিটে কিছু ভুল হয়ে যেতে পারে।'

 তামিমও অনেকটা কোহলির মতো। অনুশীলনে লম্বা সময় না কাটিয়ে বিশেষ কিছু কাজ করেই নেট ছাড়েন তিনি। মুশফিকুর রহিম আবার ব্যতিক্রম। নেটে লম্বা সময় ব্যাটিং করতে পছন্দ করেন তিনি। মুশফিকের কথা শুনতে কোহলির মনে পড়ল চেতেশ্বর পূজারার কথা, 'এটা পুরোপুরিভাবে ব্যক্তিগত ব্যপার। আমি যদি পূজারার কথা বলি, সে তিন ঘণ্টা ব্যাট করবে। দলের সবার ব্যাটিং মনে হয় সে একাই করে ফেলে। এটা প্রত্যেকের আত্নবিশ্বাস বাড়ানোর ভিন্ন ভিন্ন ধারন থাকে। কিন্তু আমার মনে হয় যদি আমার মাথা ঠিকভাবে কাজ করে, এমনকি মাঠের বাইরেও যখন হাঁটতে কিংবা কফি খেতে বের হবেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। আপনি সবসময় সিরিয়াস মুডে থাকতে পারবেন না। আপনার মানসিক অবস্থা যদি ভালো থাকে তাহলে ম্যাচেও সেই ভালো লাগার আত্নবিশ্বাসটা নিয়ে যেতে পারবেন। ক্রিকেট সবাই খেলতে পারে। মাঝে মাঝে আমরা সেটা জটিল করে ফেলি এবং চাপে পড়ি।'

 এছাড়া কাল লাইভে ভারতীয় দলের অনুশীলনে 'রাঘু' নামের থ্রোয়ারের প্রশংসা করেন কোহলি। পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে কোহলির ব্যাটিংয়ে উন্নতির বড় কারণ নাকি এই রাঘু। ডকস্টিক দিয়ে সহজেই নাকি গড়ে নব্বই মাইল বেগে বল ছুড়তে পারেন রাঘু।

 আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কঠিন জায়গা। সিংহাসন ধরে রাখতে হলে প্রতিনিয়ত সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। কোহলিকেও তাই করতে হয়েছে। ক্যারিয়ারের শুরুতে কোহলির স্টান্স ছিল সাদামাটা। কোন ব্যাক অ্যান্ড অ্যাক্রস মুভমেন্ট ছিল না। ২০১৪ সালে ইংল্যান্ড সফরে জিমি অ্যান্ডারসনের সুইংয়ের কাছে বার বার পরাস্ত হওয়ার পর স্টান্সে পরিবর্তন আনেন কোহলি। সফলও হন। ব্যাটিং কৌশল বদলে যেন রান মেশিনে পরিণত হয়েছেন ভারতীয় অধিনায়ক।

 ক্যার‍িয়ার শেষে কোহলিকে মানুষ মনে রাখবে রান তাড়া করার সময় তাঁর ব্যাটিংয়ের জন্য। সাদা বলের ক্রিকেটে রান তাড়ায় অবিশ্বাস্য সব কীর্তি গড়েছেন কোহলি। কাল তামিমও সুযোগ বুঝে রান তাড়ায় কোহলির কৌশল জেনে নেওয়ার নেন। কোহলির উত্তরে ঘুরে ফিরে সেই ক্রিকেট দর্শন বেরিয়ে আসে, 'রান তাড়া করা এমন একটি ব্যাপার যেখানে আপনি জানেন আপনার কত রান দরকার এবং কি কি করতে হবে। তাই আমার কাছে এর চেয়ে সহজ সমীকরণ আর কিছুই নেই। এই পরিস্থিতিটা আপনি কীভাবে দেখবেন সেটা আপনার ব্যাপার। এটাই আমার কাছে রান তাড়া করা সহজ সমীকরণ। ৩৭০ কিংবা ৩৮০ রান তাড়া করতে গেলেও কখনো আমার মনে হয়না যে এটা সম্ভব নয়।'