যে ঘোড়া বদলে দিয়েছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের গল্প

ফার্গুসনের গর্বের সে ঘোড়া। ফাইল ছবি
ফার্গুসনের গর্বের সে ঘোড়া। ফাইল ছবি

২০১৩ সালেই সর্বশেষ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতেছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। এরপরই অবসর নিয়েছেন কিংবদন্তি কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। আর ফার্গুসনের সঙ্গে সঙ্গেই যেন ভাগ্যও বিদায় নিয়েছে ক্লাবটিকে। গত ছয় বছরে এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জেতার ক্ষমতা রাখে। এর পেছনে ইউনাইটেড ভক্তরা দুজন ব্যক্তির দায় দেখেন, ক্লাবের প্রধান নির্বাহী এড উডওয়ার্ড ও ক্লাবের যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মালিক গ্লেজার পরিবার।

সমর্থকদের অভিযোগ একেবারে ভুল নয়। ২০০৫ সালে ক্লাবটির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কিনে নিয়েছে গ্লেজার পরিবার। কাজটি করার পথে ইউনাইটেডকে দেনার দায়ে ফেলেছে তারা। সে সঙ্গে ক্লাবের ব্র্যান্ডকে ব্যবহার করে সর্বোচ্চ আয় করার উপায় খুঁজে যাচ্ছে মালিক পক্ষ। আর তাদের সেই কাজে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছেন উডওয়ার্ড। আর্থিক আয় প্রাধান্য পাওয়ায় মাঠের ফুটবল সাফল্য দিন দিন গুরুত্ব হারিয়েছে। ফলে এক সময় প্রিমিয়ার লিগে রাজত্ব করা দলটি এখন সেরা চারে থাকতে পারলেই তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে। মালিকপক্ষের দায় তো দেবেনই সমর্থকেরা।

কিন্তু একটু পেছনে ফিরলে এ দায় চাইলে কিংবদন্তি কোচ ফার্গুসনের ওপরও ফেলা যায়। কারণ ইউনাইটেডের কর্তৃত্ব গ্লেজার পরিবারের হাতে গিয়েছিল ২০০৫ সালের মে মাসে। ক্লাবের ২৮.৭ ভাগ শেয়ারের মালিক জন ম্যানিয়ের ও জন ম্যাকমেনাস আচমকা নিজেদের সব শেয়ার গ্লেজার প্রিবারের কাছে বিক্রি করে দেন। ফলে এক দিনের ব্যবধানে ইউনাইটেডের ৫৭ ভাগ শেয়ারের মালিক হয়ে যায় গ্লেজার পরিবার। কিন্তু এসব কিছুই হতো না, যদি অ্যালেক্স ফার্গুসন নিজের অহং সামলে রাখতে পারতেন।

ঝামেলাটার শুরু এক বক্তৃতা দিয়ে। ১৯৯৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ইয়র্ক রেসকোর্সের ডিনারে বক্তৃতা দিতে বলা হয়েছিল জন ম্যানিয়েরকে। গিমক্র্যাক রেসে বিজয়ী ঘোড়ার মালিকদের এ কাজ করতে বলাটাই ছিল রীতি। কিন্তু কথা অপটু কাজটা বন্ধু ফার্গুসনকে দিয়ে করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আয়োজকেরা সেটা হতে দেননি, কারণ ইউনাইটেড কোচের সঙ্গে ম্যাকনিয়েরের প্রতিষ্ঠান কুলমোরের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা মাথায় গেঁথে নিয়েছিলেন ম্যানিয়ের। আর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ফার্গুসনকে দিয়ে একদিন ঠিকই বক্তৃতা দেওয়াবেন এখানে।

তখনো ইউনাইটেডের শেয়ার কেনেননি ম্যানিয়ের। বন্ধু ফার্গুসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক আর ভালো ব্যবসার সুযোগ থাকায় ইউনাইটেডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন এই আইরিশ। আর সে সঙ্গে ফার্গুসনকে জড়ান নিজের ঘোড়দৌড়ের সাম্রাজ্যে। ২০০১ সালে গিমক্র্যাক রেসে অংশ নেওয়ার জন্য ঘোড়া বাছাই করছিলেন ম্যানিয়েরের কুলমোর। সে উদ্দেশে একে একে তিনটি ঘোড়ার সঙ্গে নাম জড়িয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ বিশ্বজুড়ে সেরা সব রেসের ঘোড়ার জন্ম দেওয়ার জন্য বিখ্যাত ‘ডানহিলে’র ঔরসজাত ‘রক অব জিব্রাল্টার’কেই বেছে নেওয়া হয়। দুই বছর বয়সী এই ঘোড়ার সঙ্গে ফার্গুসনের নাম জড়ানোর উদ্দেশে ইউনাইটেড কোচকে ফোন দিয়ে প্রস্তাব দেন ম্যানিয়ের। সেই ফোনকলে কী কথা হয়েছিল কে জানে, কিন্তু ইউনাইটেডের ইতিহাস বদলে দেওয়া ঘটনা ঘটেছিল এরপরই।

১৭ আগস্ট আয়ারল্যান্ডের ঘোড়দৌড়ে রক অব জিব্রাল্টারের পঞ্চাশ ভাগ মালিক হিসেবে নাম লেখানো হয় ফার্গুসনের। ঘোড়ার বাকি পঞ্চাশ ভাগ মালিকানা থাকে ম্যানিয়েরের স্ত্রীর নামে। কিন্তু সব সময় ফার্গুসনের লাল আর সাদা রং নিয়েই দৌড়েছে রক অব জিব্রাল্টার। ২০০২ সালে ফার্গুসন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘রক অব জিব্রাল্টার নিয়ে আমার প্রথম স্মৃতি হলো আগস্টের গিমক্র্যাক স্টেকস। কয়েক মাস আগেই ওকে কিনেছি আর এর মধ্যেই ও রেস জিতে ফেলেছে একটা।’

এখানে ‘কিনেছি’ বলতে ফার্গুসন কী বোঝাতে চেয়েছেন তা বোধগম্য নয়। কারণ, এই ঘোড়ার মালিক সব সময় ম্যানিয়ের ছিলেন, এর জন্য ফার্গুসন এক পয়সাও খরচ করেননি। শুধুমাত্র গিমক্র্যাক দৌড়ের আয়োজকদের জবাব দেওয়ার জন্য কাগজে-কলমে নিজের ঘোড়ার যৌথ মালিক বানিয়েছিলেন ফার্গুসনকে।

কিন্তু ফার্গুসন আক্ষরিক অর্থেই নিজেকে ঘোড়ার মালিক ভাবতে শুরু করেন। ফলে রক অব জিব্রাল্টার অবসর নেওয়ার পর শুরু হয় ঝামেলা। কারণ বিভিন্ন দৌড়ে অর্জিত প্রাইজমানি থেকে ১০ লাখ পাউন্ডের কিছু বেশি আয় করলেও জিব্রাল্টার প্রকৃত মূল্য এর চেয়েও অনেক বেশি। বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ঘোড়া হিসেবে তখন জিব্রাল্টারের অনেক চাহিদা। এবং বাকি জীবন যেসব রেসিং ঘোড়ার জন্ম দেবে সে, সেটার প্রকৃত মূল্য হিসেব করাটা বেশ কঠিন ছিল। তবে নিদেনপক্ষে ১০ কোটি পাউন্ডের কাছাকাছি দাম ধরা হচ্ছিল জিব্রাল্টার।

যৌথ মালিক হিসেবে এর অর্ধেক তো ফার্গুসনের। অন্তত কিংবদন্তি কোচ এমনটাই ভাবছিলেন। ক্লাব থেকে যে বেতন তিনি নিতেন, তার দশ গুন পেয়ে যাবেন শুধু একটি ঘোড়া থেকে! কিন্তু জন ম্যানিয়ের সেভাবে ব্যাপারটি দেখলে তো! তাঁর চোখে, এটা শুধুই সম্মানের একটি প্রস্তাব ছিল, যেন একটি চ্যাম্পিয়ন ঘোড়ার মালিক হিসেবে ফার্গুসন গর্ব করতে পারেন। তবু জিব্রাল্টার তাঁর ঘোড়দৌড়ের জীবনে যা আয় করেছে তার ৫০ ভাগ ফার্গুসনের প্রাপ্য বলে ধরে নিয়েছেন ম্যানিয়ের।

ফলে ফার্গুসনকে দুটো প্রস্তাব দিয়েছিলেন ম্যানিয়ের। এক, প্রাইজমানির অর্ধেক ও সব ট্রফির রেপ্লিকা। দুই, প্রতি বছর জিব্রাল্টার যত সন্তানের জন্ম দেবে, সেখান থেকে আয়ারল্যান্ডের একটি ও অস্ট্রেলিয়ার একটি বাচ্চা নিজের জন্য রেখে দিতে পারবেন টানা ১০ বছর। ডানহিল ও জিব্রাল্টার রক্তের এসব বাচ্চার জন্য বার্ষিক দেড় লাখ পাউন্ড অনায়াসে প্রাপ্তি থাকত ফার্গুসনের। কিন্তু ফার্গুসনের মাথায় তখন ঘুরছে একটি কথাই, ‘পঞ্চাশ ভাগ মানে ৫০ ভাগ!’

মিডিয়ার আলোতে নিজেকে আবিষ্কার করে অনভ্যস্ত ম্যানিয়ের কিছুটা পিছু হটেন। নতুন প্রস্তাব পাঠান, দুটি নয় চারটি বাচ্চা রেখে দিতে পারবেন ফার্গুসন। কিন্তু একগুঁয়ে ফার্গুসন সেটা মানলে তো। ফার্গুসনের তখন রোখ চেপেছে। কারণ তাঁর ধারণা। পঞ্চাশ ভাগ না হলেও ১৫-২০ ভাগ মালিকানা জেতা খুব করেই সম্ভব তাঁর পক্ষে। ওদিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে নিজেদের মালিকানা আরও বাড়িয়ে নিচ্ছিলেন ম্যানিয়ের ও ম্যাকম্যানাসের কুবিক এক্সপ্রেশন। মালিকপক্ষের সঙ্গে ফার্গুসনের এমন দ্বৈরথে সমর্থকেরা সবাই কোচের পক্ষ নিলেন। আর দুই পক্ষের রেষারেষি গড়াল কোর্টে।

ক্ষিপ্ত ম্যানিয়ের অন্য পথ ধরলেন। ইউনাইটেডের আর্থিক বিষয় নিয়ে তদন্তে নামল তাঁর দল। ইউনাইটেডের দলবদলে ফার্গুসন পুত্র জ্যাসনের অনিয়মের কথা ফাঁস হয়ে গেল এতে। ‘নাইনটি নাইন কোশ্চেন’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র সৃষ্টি করা হলো, যেখানে খেলোয়াড় দল বদলের অংশ হিসেবে বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের খবর মিলল। এমনকি ফার্গুসন যে বেতন নিচ্ছেন তাঁর নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হলো।

সমর্থকের ক্ষোভের মুখে ম্যানিয়েরের পক্ষে ইউনাইটেডে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ছিল। ওদিকে নিজের চাকরির সঙ্গে মর্যাদাও হারাতে বসেছিলেন ফার্গুসন। তাই শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষ একমত হয়ে একটা রফা করে নিল। ফার্গুসনকে একবারে ২৫ লাখ পাউন্ড দেন ম্যানিয়ের,যা ‘রক অব জিব্রাল্টার’ প্রাইজমানি থেকে প্রাপ্ত ফার্গুসনের অংশের পাঁচ গুন।

২০০১ সালে জন ও সুসান ম্যানিয়েরের সঙ্গে ফার্গুসন। তখন তাদের ভালো বন্ধুত্ব। সংগৃহীত ছবি
২০০১ সালে জন ও সুসান ম্যানিয়েরের সঙ্গে ফার্গুসন। তখন তাদের ভালো বন্ধুত্ব। সংগৃহীত ছবি

আইরিশম্যান ম্যানিয়েরে স্কটিশ ফার্গুসনের ওপর প্রতিশোধ নেওয়া তখনো বাকি ছিল। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মালিকানার নিজেদের পুরো অংশ তারা বিক্রি করে দিল পুরোপুরি ব্যবসায়িক চিন্তাধারার গ্লেজার পরিবারের কাছে। এতে ১৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো দেনার দায় কাঁধে নিতে হলো ক্লাবটিকে। গ্লেজারদের ইউনাইটেডের মালিকানা বুঝে নেওয়ার খবরে বিরক্ত হলেও ফার্গুসন তখনো ব্যাপারটি আমলে নেননি। অবশ্য হিসাব নিকাশে ভুল করার শুরুটা তো ফার্গুসনের আগেই হয়েছে।

ফার্গুসনকে ২৫ লাখ পাউন্ড দিলেও লাভ করেছেন ম্যানিয়েরই। কারণ, মাঝে বাৎসরিক চারটি করে জিব্রাল্টার বাচ্চার প্রস্তাবটিতে রাজি হলে ফার্গুসন ঘোড়াটির জীবদ্দশায় প্রতি বছর ২০ লাখ পাউন্ড আয় করতে পারতেন, এবং সেটা এখনো বজায় থাকত। অন্তত ‘রক অব জিব্রাল্টার’ বইয়ের লেখক মার্টিন হ্যানানের দাবি এটাই। কারণ, বাজারে জিব্রাল্টার বাচ্চার মূল্য এখনো আকাশ ছোঁয়া।

একটির ঘোড়ার মালিকানা নিয়ে ফার্গুসনের অহং গ্লেজার পরিবারকে সুযোগ করে দিয়েছে ইউনাইটেডের মতো এক ক্লাবের মালিকানা বুঝে নেওয়ার। সেই সুবাদেই উডওয়ার্ডের ব্যবসায়িক চিন্তা ও ব্র্যান্ডিং ক্লাবে গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। ফুটবলের বিস্ময়কর সব গল্পের মধ্যে তাই ‘রক অব জিব্রাল্টার’ ভালোভাবেই স্থান পাবে।