ঢাকার সেই 'নো' বল ভোলেননি আকরাম

১৯৯৫ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের সেই আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে ওয়াসিম আকরাম। ছবি: শামসুল হক
১৯৯৫ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের সেই আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে ওয়াসিম আকরাম। ছবি: শামসুল হক

বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ারে স্মরণীয় কত ম্যাচই না খেলেছেন! শুধু এক দিনের ক্রিকেটের কথা বললেও দুটি বিশ্বকাপ ফাইনাল আছে। জয়ে রঙিন প্রথম ফাইনালে তিনিই ম্যান অব দ্য ম্যাচ, পরাজয়ের বেদনায় নীল দ্বিতীয়টিতে পাকিস্তানের অধিনায়ক। আরও কত ম্যাচ, স্মরণীয় কত পারফরম্যান্স! এসবের ভিড়ে ঢাকা লিগে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ কেন আলাদাভাবে মনে রাখবেন ওয়াসিম আকরাম?

তারপরও সেই ম্যাচটি ঠিকই মনে আছে তর্কাতীতভাবে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা বাঁহাতি পেসারের। তামিম ইকবালের মহা আলোচিত ফেসবুক আড্ডায় যোগ দিয়ে নিজেই টেনে এনেছেন সেই ম্যাচের প্রসঙ্গ। ম্যাচে কী হয়েছিল, ওয়াসিম আকরামের তার চেয়ে বেশি মনে আছে গ্যালারি ভর্তি দর্শকের কথা। তা ১৯৯৫ সালের ১১ মার্চের সেই ম্যাচে দর্শক হয়েছিল বটে। নিজের লেখা পুরনো ম্যাচ রিপোর্টে দেখছি, সংখ্যাটা ত্রিশ হাজার বলে অনুমান করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের দর্শকসংখ্যা তখন অনুমানই করতে হতো।

প্রায় ২৫ বছর আগের সেই ম্যাচে আবাহনী দলে তাঁর দুই টিমমেট মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ও আকরাম খানও ছিলেন সেদিনের আড্ডায়। স্বাভাবিকভাবেই সেই ম্যাচের প্রসঙ্গ এসেছে। এসেছে সেই নো বলও। ব্যতিক্রমী এক নো বল। ব্যাটসম্যান বোল্ড, অথচ উল্টো চার রান পেয়ে যাচ্ছে ব্যাটিং দল! পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের ভাগ্যও মোহামেডানের দিকে স্থির হয়ে গিয়েছিল ওই নো বলে। এ কারণেই এত দিন পরও সেই 'নো' বলটা মনে আছে ওয়াসিম আকরামের।

সেই ম্যাচে আবাহনীর সর্বোচ্চ স্কোরার মিনহাজুল আবেদীনের সঙ্গে মাঝ উইকেটে ব্যাটসম্যান ওয়াসিম আকরাম।ছবি: শামসুল হক
সেই ম্যাচে আবাহনীর সর্বোচ্চ স্কোরার মিনহাজুল আবেদীনের সঙ্গে মাঝ উইকেটে ব্যাটসম্যান ওয়াসিম আকরাম।ছবি: শামসুল হক

ম্যাচের সবচেয়ে নাটকীয় ও ফলাফল নির্ধারক এই অংশটাই আগে বলে নিই। প্রিমিয়ার লিগে তখন ৪৫ ওভারের ম্যাচ। ম্যাচের ৮৯তম ওভারে ওই নাটক। শেষ দুই ওভারে মোহামেডানের লাগে ৯ রান, হাতে ৩ উইকেট। ওয়াসিম আকরামের আর একটি ওভারই বাকি। এর আগে তিন স্পেলে ৮ ওভার বোলিং করে ৩৫ রানে নিয়েছেন ২ উইকেট। আবাহনী অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু অনুমিতভাবেই শেষ ওভারের জন্য অপেক্ষা না করে মোহামেডান ইনিংসের ৪৪তম ওভারটি করতে ডাকলেন তাঁর তুরুপের তাসকে।

আবাহনীই তখন ফেবারিট। সেটি বোলারের নাম ওয়াসিম আকরাম বলেই। এমন পরিস্থিতিতে একটা-দুটি ম্যাচ জিতিয়েছেন নাকি! ওভারের প্রথম বলটিই বিখ্যাত সেই ইনসুইঙ্গিং ইয়র্কার। হাসিবুল হোসেন শান্ত কেন, বিশ্বের বড় বড় ব্যাটসম্যানও যেটিতে বোল্ডই হতেন। নতুন ব্যাটসম্যান উইকেটকিপার নাসির আহমেদ নাসু দ্বিতীয় বলটি কোনোমতে সামলানোর পর তৃতীয় বলে একটি রানও নিয়ে নিলেন। স্ট্রাইকে মুস্তাদির লিটু। মূলত বাঁহাতি স্পিনার, তবে ব্যাটিংটাও মোটামুটি ভালোই পারতেন। কিন্তু ওয়াসিম আকরাম তো ওয়াসিম আকরাম! লিটুও বোল্ড! আবাহনীর খেলোয়াড়দের মধ্যে জয়ের আগাম আনন্দ। তুমুল হইচইয়ে আম্পায়ার জাহাঙ্গীর আলমের প্রসারিত ডান হাত অনেকের চোখেই পড়েনি। নো বল! আবাহনীর সর্বনাশের সেটি শুরু। শেষ সেই বলেই বাই থেকে মোহামেডান চার রান পেয়ে যাওয়ায়।

এত বছর পরও দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে। বল স্টাম্পে লেগে থার্ডম্যান বাউন্ডারির দিকে ছুটে যাচ্ছে আর ওয়াসিম আকরাম দু হাত ছুঁড়ে চিৎকার করছেন, বল রোখো, বল রোখো...। কিন্তু বল যাঁর 'রোখা'র কথা, সেই থার্ডম্যান ফিল্ডার সাইফুল ইসলাম তখন আগাম বিজয়োল্লাস করতে করতে ওয়াসিম আকরামের দিকেই ছুটে আসছেন। উত্তেজনায় আম্পায়ারের প্রসারিত হাত তিনি খেয়ালই করেননি। যখন করলেন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। গড়িয়ে গড়িয়ে বল চলে গেছে বাইরে। উইকেটের বদলে ওই চার রানই মোহামেডানের জন্য সমীকরণটাকে একদম সহজ বানিয়ে দিল। ৮ বলে ৪ রান। সবারই তখন বোঝা হয়ে গেছে, ওয়াসিম আকরামের শেষ দুটি বল পার করে দিতে পারলে মোহামেডানই জিতবে। নতুন জীবন পাওয়া লিটু তা পারও করে দিলেন।

ফিল্ডিংয়ের ফাঁকে একটু বিশ্রাম: ওয়াসিম আকরামের সঙ্গে মিনহাজুল ও নাঈমুর রহমান (বাঁয়ে)। ছবি শামসুল হক
ফিল্ডিংয়ের ফাঁকে একটু বিশ্রাম: ওয়াসিম আকরামের সঙ্গে মিনহাজুল ও নাঈমুর রহমান (বাঁয়ে)। ছবি শামসুল হক

শেষ ওভারটি করেছিলেন ১৯৯২ বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তান দলের আরেক ক্রিকেটার---লেগ স্পিনার ইকবাল সিকান্দার। তাঁর জন্য কাজটা ছিল অনেক কঠিন। সেটি তিনি পারলেনও না। প্রথম দুই বলে নাসু ৩ রান নেওয়ার পর স্ট্রাইক পেলেন লিটু। তৃতীয় বলে স্কয়ার কাটে চার মেরে মোহামেডানকে মাতিয়ে তুললেন উৎসবে। শুধু আবাহনী নয়, ওয়াসিম আকরামের বিপক্ষেও জয়---উৎসবে বাড়তি রং লাগাতে এটাই যথেষ্ট ছিল। মোহামেডানের বাঁধনছাড়া উৎসবের কারণ ছিল আরও। ওয়াসিম আকরাম যোগ হওয়ার আগেই সেবারের লিগের পারফরম্যান্সে আবাহনী ছিল পরিষ্কার ফেবারিট। তার ওপর আবাহনীকে সর্বশেষ কবে হারিয়েছিল, সেটিই তখন ভুলে যাওয়ার উপক্রম মোহামেডানের। আগের তিন বছরে চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের ছয়টি ম্যাচেই জয়ী দলের নাম ছিল আবাহনী।

এই প্রেক্ষাপটের কথা বাদ দিন, শুধু ওই ম্যাচেরও এত খুঁটিনাটি ওয়াসিম আকরামের মনে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ১০৪টি টেস্ট খেলেছেন, ৩৫৬টি ওয়ানডে---সেগুলোরই কত কিছু মনে নেই! তবে অনেক আশা করে তাঁকে আনা আবাহনীকে যে জেতাতে পারেননি, এটা হয়তো মনে আছে। নিজের পারফরম্যান্সও যে 'ওয়াসিম আকরামী'য় ছিল না, হয়তো এটাও। বোলিংয়ে ৩ উইকেট নেওয়ার আগে ছয় নম্বরে ব্যাটিং করে ২৩ বলে ১৭ রান। ব্যাটিং করতে নামার সময়ই চার-ছয়ের আসন্ন ঝড়কে বরণ করে নিতে গ্যালারি থেকে একটা হর্ষধ্বনি উঠেছিল। সেই ঝড় আর ওঠেইনি। স্বভাববিরুদ্ধ এক-দুই রান করে নিয়ে যে-ই ছক্কা মারতে গেছেন, তখনই অক্কা। মোহাম্মদ রফিকের বলে লং অফে নাদিম ইউনুসের হাতে ক্যাচ।

৬ নম্বরে ব্যাটিং করতে নেমে ওয়াসিম আকরাম করেছিলেন ২৩ বলে ১৭। আ্উট হয়ে যান ছক্কা মারার প্রথম চেষ্টাতেই। ছবি: শামসুল হক
৬ নম্বরে ব্যাটিং করতে নেমে ওয়াসিম আকরাম করেছিলেন ২৩ বলে ১৭। আ্উট হয়ে যান ছক্কা মারার প্রথম চেষ্টাতেই। ছবি: শামসুল হক

ওই ম্যাচ যাঁরা দেখেছেন, নাদিম ইউনুসের কথা তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে। আবাহনীতে যেমন দুই পাকিস্তানি ছিলেন, মোহামেডানেও তা-ই। একজন এই নাদিম ইউনুস, যাঁকে পাকিস্তানের বাইরে তখনো কেউ চেনেন না। অন্যজন আমির মালিক, যাঁকে মোটামুটি সবাই চেনেন। আগের বছরই ১৪তম টেস্ট খেলেছেন এবং আবার পাকিস্তান দলে ফেরার আশা করছেন। সেই আশা আর পূরণ হয়নি। আমির মালিকের ক্যারিয়ারের গল্প শুনলে আপনারও একটু মায়া হবে। ফার্স্ট ক্লাস অভিষেকেই দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি (যে কীর্তি আছে শুধু আর দুজনের---আর্থার মরিস ও নরি কন্ট্রাকটর), অভিষেক টেস্টে অপরাজিত ৯৮, ভারতের বিপক্ষে ১৯৮৯ সিরিজে পরপর দুই টেস্টে সেঞ্চুরি, পাঁচ বছর পর আবার সুযোগ পেয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ বাঁচানো ৬৫----অথচ এরপরই চিরতরে বাদ। আবাহনী-মোহামেডান ওই ম্যাচের আগে বলা হচ্ছিল, মোহামেডান দলে ব্যাট হাতে ম্যাচ উইনার আছেন দুজনই, অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও এই আমির মালিক। অথচ এঁদেরকে ছাপিয়ে নায়ক হয়ে গিয়েছিলেন এর আগে লিগে বলার মতো কিছুই করতে না পারা নাদিম ইউনুস। ওয়াসিম আকরামকে খেলবেন বলে এই ম্যাচের আগে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের চেয়েও যিনি বেশি রোমাঞ্চিত ছিলেন। পাকিস্তানেও কখনো তা খেলার সুযোগ পাননি যে! নাদিম ইউনুসের ম্যাচজয়ী ৮৪ রানের ইনিংসটিতেও ওয়াসিম আকরামের অবদান আছে। রান যখন ৫৮, ইকবাল সিকান্দারের বলে মিড উইকেটে তাঁর ক্যাচ ফেলে দেন ওয়াসিম আকরাম। এরপর আরও ২৬ রান করেছেন নাদিম ইউনুস , ম্যাচের অমন উত্তেজনাকর সমাপ্তির পর আরও বড় হয়ে উঠেছে ওয়াসিম আকরামের ওই ব্যর্থতা। নো বল বিতর্ক বড় হয়ে না উঠলে আবাহনী সমর্থকেরা পরাজয়ের জন্য নির্ঘাত ওয়াসিম আকরামকেই দাঁড় করাতেন কাঠগড়ায়।

আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ বলেই হয়তো শেষটা অমন নাটকীয় হয়েছিল। নইলে ৬ রানে মোহামেডানের প্রথম উইকেট পড়ার পর সাজ্জাদ আহমেদ শিপনের সঙ্গে নাদিম ইউনুসের ১২১ রানের জুটি একতরফা একটা ম্যাচেরই পূর্বাভাস দিচ্ছিল। সেই প্রথম উইকেটটি নিয়েছিলেন ওয়াসিম আকরাম। হঠাৎ লাফানো তাঁর দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলটি ছোবল দেয় নুরুল আবেদীন নোবেলের কাঁধে। পরেরটি ফণা তোলে গুড লেংথ থেকে, মুখ বাঁচাতে ব্যাট তুলে গালিতে ক্যাচ দেন নোবেল। শেষ ওভারে তৃতীয় উইকেটটি নেওয়ার আগে ওয়াসিম আকরামের আরেকটি উইকেট বুলবুলের। প্রতিপক্ষ অধিনায়ককে ফেরাতেই ওয়াসিম আকরামকে আক্রমণে ফিরিয়েছিলেন অধিনায়ক লিপু।

এই ম্যাচের আগে লিপু তাঁর দলের ব্যাটিং লাইন আপকে আবাহনীর ইতিহাসের সেরা বলে রায় দিয়ে দিয়েছিলেন। সেটি অত্যুক্তিও ছিল না। লিপু-হারুনুর রশিদ লিটন-নাঈমুর রহমান দুর্জয়