মরিনহো-ম্যাজিকের এক দশক

চ্যাম্পিয়নস লিগ হাতে হোসে মরিনহো। ছবি : এএফপি
চ্যাম্পিয়নস লিগ হাতে হোসে মরিনহো। ছবি : এএফপি
>তাদের আগে কোনো ইতালিয়ান ক্লাব ঐতিহাসিক ট্রেবল জিততে পারেনি। পারেনি তাদের পরেও। হোসে মরিনহো নামের এক জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় ইন্টার মিলানের সেই ইতিহাসগড়া দিনের দশ বছর পূর্তি ছিল গতকাল

ধরুন, আপনি একটা ক্লাবের পাঁড় সমর্থক। ক্লাবের জয় আপনাকে হাসায়, কাঁদায় যেকোনো পরাজয়। ক্লাবের সাফল্য-ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করে আপনার ভালো থাকা, না থাকা। সেই আপনার সামনেই যদি সুযোগ আসে প্রাণপ্রিয় সেই ক্লাবটার সভাপতি হওয়ার, ক্লাবের প্রধান নেতা হওয়ার, তাহলে কেমন লাগবে? আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো মনে হওয়াটা স্বাভাবিক।
সেটাই হয়েছিল মাসিমো মোরাত্তির জীবনে। গোটা পরিবার ইন্টারের সমর্থক, তাই জন্ম থেকে মনের মধ্যে অজান্তে নীল-কালো ডোরাকাটা দাগ বসে গিয়েছিল। বাবা আনহেলো মোরাত্তি ছিলেন ইন্টারের কিংবদন্তি সভাপতি। ঘর ও ঘরের বাইরে মিলিয়ে তাঁর অধীনে ইন্টার তাদের ইতিহাসের সেরা সময় কাটায়। তিনবার জেতে লিগ, দুবার করে জেতে চ্যাম্পিয়নস লিগ আর ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ। ছোটবেলায় বাবার হাতে ঝকমকে চ্যাম্পিয়নস লিগ (তৎকালীন ইউরোপীয়ান কাপ) শিরোপাটা দেখে মাসিমোরও মনে আশা জাগে, 'একদিন আমিও…।' 

চ্যাম্পিয়ন লিগ হাতে ইন্টারের সাবেক সভাপতি ও মাসিমো মোরাত্তির বাবা – অ্যানহেলো। ছবি: টুইটার
চ্যাম্পিয়ন লিগ হাতে ইন্টারের সাবেক সভাপতি ও মাসিমো মোরাত্তির বাবা – অ্যানহেলো। ছবি: টুইটার

১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দুই দফায় ইন্টারের সভাপতি ছিলেন মাসিমো মোরাত্তি। নিজের প্রিয় ক্লাবকে সাধ্যমত সব কিছুই দিয়েছেন এই তেল ব্যবসায়ী। দলে এনেছেন রোনালদো, রবার্তো ব্যাজ্জিও, হাভিয়ের জানেত্তি, আনহেলো পেরুজ্জি, ক্লারেন্স সিডর্ফ ও ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরির মতো তারকাদের। শিরোপার সুবার যে একদমই পাচ্ছিলেন না, তা কিন্তু নয়। ইন্টার মিলান সব সময়েই কিছু না কিছু জিতেছে, সেটা লিগ হোক বা কাপ। তবে একটা শিরোপা কোনোভাবেই নাগালে আনতে পারছিলেন না মোরাত্তি। চ্যাম্পিয়নস লিগ! অথচ, ওই শিরোপা জিতবেন, এমন আশা নিয়েই তো বছরের পর বছর ইন্টারের সভাপতিত্ব করে যাচ্ছেন!কোচ রবার্তো মানচিনি ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় ততদিনে ইন্টারকে 'গোলিয়াথ' বানিয়ে ফেললেও মহাদেশীয় প্রতিযোগিতায় ইন্টার তখনও পুঁচকে 'ডেভিড'। সভাপতিকে কোনোভাবেই চ্যাম্পিয়নস লিগ এনে দিতে পারছিলেন না মানচিনি।

২০০৮ সালে সকল ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল যেন। স্টিভেন জেরার্ড-ফার্নান্দো তোরেসের লিভারপুল ঘুম ভাঙিয়ে দিল মোরাত্তির। নাহ, এই কোচ দিয়ে আর হবে না! চেলসিকে মধ্য সারির দল থেকে পরাক্রমশালী বানিয়ে, তার আগে পুঁচকে পোর্তোকে নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে হোসে মরিনহো তখন বিশ্বের যেকোনো ক্লাবের কাছেই পরম প্রার্থিত এক কোচ। সদ্য চেলসির দায়িত্ব ছাড়া মরিনহোর হাতে তখন দুটি জিনিস অফুরন্ত। এক – অবসর, দুই – চাকরির প্রস্তাব। রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, বার্সেলোনা - কে তখন চায়নি মরিনহোকে কোচ বানাতে? মোরাত্তি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। মরিনহোকেই চাই। প্যারিসের এক হোটেলে মরিনহোর সঙ্গে দেখা করে এসে চুক্তির খুঁটিনাটি ঠিক করে ফেললেন ঝানু এই ব্যবসায়ী। বিদায়ঘন্টা বেজে গেল মানচিনির।

সব ট্রফি জিতলেও এক চ্যাম্পিয়নস লিগই ছিল মোরাত্তির অধরা। ছবি: এএফপি
সব ট্রফি জিতলেও এক চ্যাম্পিয়নস লিগই ছিল মোরাত্তির অধরা। ছবি: এএফপি

পোর্তোকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতিয়ে চেলসিতে এসে প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই সাংবাদিকদের মন-পছন্দ খবরের শিরোনাম দিয়ে দিয়েছিলেন মরিনহো, 'আমাকে উদ্ধত ভাববেন না। তবে আমি একজন ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন। আমার মনে হয়, আমি বিশেষ একজন।' একই ধারা বজায় রাখলেন ইন্টারে এসেও। মরিনহো ইন্টারে আসছেন, এই গুঞ্জনের সঙ্গে তখন আরেকটা গুঞ্জন বেশ ডালাপালা মেলেছিল। শোনা যাচ্ছিল, নিজের সঙ্গে চেলসি থেকে নিজের সাবেক শিষ্য মিডফিল্ডার ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডকে আনছেন মরিনহো। এক শিরোনাম-সন্ধানী সাংবাদিক এ নিয়ে প্রশ্নও করলেন সেদিন। 'আমাকে গর্দভ ভাববেন না' - মরিনহোর অকপট উত্তর!

তবে ল্যাম্পার্ডকে না আনলেও আরেক শিষ্যকে বেশ ভালোভাবেই চেয়েছিলেন মরিনহো - স্বদেশী সেন্টারব্যাক রিকার্দো কারভালহো। ইন্টারের মূল খেলোয়াড়দের প্রায় সবার বয়সই মোটামুটি তিরিশের ডানে ছিল। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে ধাবিত হওয়ার এক যন্ত্রণা, গতি কমে যায়। জানেত্তি, ইভান কর্দোবা, মার্কো মাতেরাজ্জি, লুইস ফিগো, প্যাট্রিক ভিয়েরা, হুলিও ক্রুজ, হার্নান ক্রেসপো – মোটামুটি সবারই একই দশা। বিশেষ করে রক্ষণভাগে খেলার জন্য সেন্টারব্যাকদের যেমন গতির দরকার, তা ছিল না ইন্টার ডিফেন্ডারদের। দৃঢ় রক্ষণভাগ গঠনে সুনাম কুড়ানো মরিনহো তাই আস্তে আস্তে দলে কার্যকরী, গতিশীল ও অপেক্ষাকৃত কম বয়সের খেলোয়াড় আনা শুরু করলেন।

লিগে ইন্টারের ৪-১-২-১-২ ছক। ছবি: সংগৃহীত
লিগে ইন্টারের ৪-১-২-১-২ ছক। ছবি: সংগৃহীত

প্রথম মৌসুমে মানচিনির মূল একাদশে তেমন পরিবর্তন আনেননি । সেবার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে হেরে চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় ইন্টার। নতুন কোচ এনেও লাভ হচ্ছে না, ভেবে কিছুদিন রাগারাগি করলেন মোরাত্তি। রিয়াল মাদ্রিদ তখন সুযোগ খুঁজছে, মোরাত্তির সঙ্গে মরিনহোর সম্পর্কের অবনতি ঘটলেই তাদের পোয়াবারো। পর্তুগিজ কোচকে বার্নাব্যুর টিকিট ধরিয়ে দেবে তাঁরা। কিন্তু মরিনহো নিজের প্রতিজ্ঞায় অটল। ক্লাব-সভাপতির আজন্মলালিত স্বপ্ন পূরণ করেই ছাড়বেন। ইন্টারে প্রথম মৌসুমে নিজের পছন্দের তেমন খেলোয়াড় না আনলেও দ্বিতীয় মৌসুমে দলকে ঢেলে সাজালেন।

আর এই দল সাজানোর কাজে মরিনহোকে আড়াল থেকে সবচেয়ে বড় সাহায্য করলেন তাঁর প্রিয় শিষ্য জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ। সদ্য ট্রেবল জেতা বার্সা কোচ পেপ গার্দিওলার তখন একজন স্ট্রাইকার লাগবে, পছন্দ হল ইব্রাকে। সাড়ে চার কোটি ইউরোর সঙ্গে ট্রেবল জেতা দলের অন্যতম প্রধান কাণ্ডারি স্যামুয়েল ইতোর বিনিময়ে ইন্টার থেকে বার্সায় গেলেন ইব্রাহিমোভিচ। মরিনহোও দলের সবচেয়ে বড় তারকা ও প্রিয় শিষ্যর বিনিময়ে বার্সা থেকে নিজের সবচেয়ে পছন্দের খেলোয়াড়টিকেই আনলেন। ইতোকে পাওয়ার জন্য মরিনহো এতটাই মুখিয়ে ছিলেন যে, ইন্টারের জার্সির পেছনে ইতোর নাম-নম্বর লিখে ছবি তুলে ইতোকে পাঠিয়ে বলেছিলেন, 'দেখো, এই জার্সিটা তোমার অপেক্ষা করছে। তাও তুমি আসবে না?'

চ্যাম্পিয়নস লিগের ৪-২-৩-১ ছক। ছবি: সংগৃহীত
চ্যাম্পিয়নস লিগের ৪-২-৩-১ ছক। ছবি: সংগৃহীত

একইভাবে মরিনহো 'পটিয়েছিলেন' রিয়াল মাদ্রিদের ডাচ মিডফিল্ডার ওয়েসলি স্নাইডারকে। নবনির্বাচিত রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের 'দ্বিতীয় গ্যালাকটিকো' প্রজেক্টের অংশ হিসেবে ততদিনে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে পা রেখেছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, কাকা, করিম বেনজেমারা। ফলে রিয়ালে অনেকটাই অপাংক্তেয় হয়ে গিয়েছিলেন স্নাইডার, আরিয়াল রোবেন, রুড ফন নিস্টলরয়দের 'ডাচ শাখা।' পরিস্থিতির পুরো ফায়দা নিলেন মরিনহো। স্নাইডারকে একের পর এক টেক্সট মেসেজ দিয়ে দলে আসতে রাজি করালেন। রক্ষণভাগের গতি বাড়াতে কারভালহোকে না পেলেও বায়ার্ন মিউনিখ থেকে আনলেন ব্রাজিলের ডিফেন্ডার লুসিওকে। জেনোয়া থেকে এলেন আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার দিয়েগো মিলিতো আর মিডফিল্ডার থিয়াগো মোত্তা। বড় ম্যাচে গোল করার এক অমূল্য স্বভাব ছিল এই মিলিতোর। আর এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসো, দেয়ান স্তানকোভিচ থাকার পরও মিডফিল্ডে বল ধরে রেখে খেলা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হল মোত্তাকে। লাৎসিও থেকে বিনামূল্যে যোগ দিলেন স্ট্রাইকার গোরান পানদেভ। ইব্রা ছাড়াও দল থেকে চলে গেলেন ফিগো, ক্রেসপো, আদ্রিয়ানো, ক্রুজ, বোনুচ্চি, বিয়াবিয়ানি, ম্যাক্সওয়েল, বুরদিসো, সুয়াজো ও ভিয়েরা।

মরিনহোর এই দলটাকে আগাগোড়া রক্ষণাত্মক বলে হেয় করা হলেও, আসলে কিন্তু তা ছিল না। বরং মরিনহোর ইন্টার ছিল প্রতিক্রিয়াশীল দলের এক অনন্য উদাহরণ। প্রতিপক্ষের শক্তি বিবেচনা করে প্রতি ম্যাচে দল সাজাতেন মরিনহো, প্রতিপক্ষের শক্তিগুলো নিষ্ক্রিয় করে কীভাবে ম্যাচ জেতা যায়, সেটাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। সঙ্গে বাড়তি অস্ত্র হিসেবে যুক্ত হয়েছিল দুর্দান্ত প্রতি আক্রমণ। প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে দ্রুততম সময়ে আক্রমণ করে গোল করাটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল মরিনহোর চেলসি। একই গুণ রপ্ত করল ইন্টারও। মরিনহো আসার পর দুই মৌসুমে লিগে যথাক্রমে ৭০ ও ৭৫ গোল দিয়েছে ইন্টার। যা ছিল লিগের সর্বোচ্চ। এমন একটা দলকে কীভাবে আগাগোড়া রক্ষণাত্মক বলবেন?

মরিনহোর সেই পাগলাটে দৌড়। ছবি: এএফপি
মরিনহোর সেই পাগলাটে দৌড়। ছবি: এএফপি

মরিনহোর ইন্টার মূলত ৪-১-২-১-২ ছকে খেলত। পুরো রক্ষণভাগ ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার তারকা দিয়ে সাজিয়েছিলেন মরিনহো। সবার পেছনে থাকতেন দুর্দান্তভাবে খেলার গতিবিধি বুঝতে পারা গোলরক্ষক ব্রাজিলের জুলিও সিজার। সামনে ডিফেন্ডার হিসেবে আর্জেন্টিনার ওয়াল্টার স্যামুয়েল ও নতুন আসা লুসিও। রাইটব্যাকে আরেক ব্রাজিলিয়ান মাইকন, বাঁদিকে দলের কিংবদন্তি অধিনায়ক, আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার হাভিয়ের জানেত্তি। দুই সেন্টারব্যাকের সামনে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে ছিলেন আর্জেন্টিনার এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসো। তাঁর বাঁদিকে মোত্তা, ডানদিকে দেয়ান স্তানকোভিচ। মিডফিল্ডে নিয়ন্ত্রণ রাখার পাশাপাশি রক্ষণভাগকে বাড়তি নিরাপত্তা দিতেন ক্যাম্বিয়াসো, কেননা ওয়াল্টার স্যামুয়েল বা লুসিওর কেউই তেমন ওপরে উঠতেন না। প্রতিপক্ষ বেশি যন্ত্রণা দিলে ক্যাম্বিয়াসোকে সাহায্য করতেন মোত্তা, সঙ্গে সফল পাস দেওয়ার মাধ্যমে মিডফিল্ডের নিয়ন্ত্রণ রাখার কাজটা ছিলই। ওদিকে স্তানকোভিচের কাজ ছিল আক্রমণে ওপরে থাকা স্নাইডারকে সাহায্য করা, যন্ত্রের মত ওঠানামা করা। দুই স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতেন দিয়েগো মিলিতো ও স্যামুয়েল ইতো। তবে দলের প্রয়োজনে মিলিতোকে একক স্ট্রাইকার হিসেবে রেখে প্রায় সময়েই ডান বা বাঁ উইংয়ে খেলতেন ইতো, ফুলব্যাকদের নিরাপত্তা দিতেন।

চ্যাম্পিয়নস লিগেও মোটামুটি একই ছকে খেলেছে ইন্টার। তবে মরিনহো জানতেন, ইতালিয়ান লিগের ক্লাবগুলোর চেয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ক্লাবগুলো আরও বেশি আক্রমণাত্মক। ফলে ম্যাচ জেতার জন্য তাঁকে কৌশলগত কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রায়ই স্তানকোভিচের জায়গায় মাঠে নামতেন গোরান পানদেভ। কাগজে-কলমে মাঠে তিন স্ট্রাইকার (মিলিতো, ইতো, পানদেভ) থাকলেও সবার ওপরে খেলতেন মিলিতো, ডান উইংয়ে ইতো, আর পানদেভের জায়গা হতো মিডফিল্ডে থাকা ক্যাম্বিয়াসোর ডানদিকে, যিনি কি না মিডফিল্ডে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি সুযোগ পেলেই পাকা উইঙ্গারের মতো মাঠের বাঁ কোণায় চলে যেতেন। ফলে মাঝে মাঝেই ছকটা ৪-১-২-১-২ থেকে ৪-২-৩-১ হয়ে যেত।

রাইটব্যাক মাইকন ইন্টারের আক্রমণের অন্যতম প্রধান উৎস ছিলেন। দুর্দান্ত গতিশীল এই ফুলব্যাক সুযোগ পেলেই ওপরে উঠে যেতেন, তাঁর ফেলে আসার জায়গাটা তখন দেখে রাখতেন স্টানকোভিচ (লিগে) ও ইতো (চ্যাম্পিয়নস লিগে)। ওদিকে লেফটব্যাক হাভিয়ের জানেত্তির আবার সে সুযোগটা ছিল না। মাইকন আক্রমণে চলে গেলেও জানেত্তি নিচেই থাকতেন, লুসিও ও স্যামুয়েলের পাশে তৃতীয় সেন্টারব্যাক হিসেবে।

দলের আক্রমণভাগের মূল চাবি ছিল মিডফিল্ডার ওয়েসলি স্নাইডারের হাতে। দুই স্ট্রাইকারের পেছনে মাঝখানটায় আদর্শ আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারের ভূমিকা পালন করতেন এই ডাচ তারকা। ইতো-মিলিতো প্রায়ই দুই উইংয়ে চলে যেতেন, ফলে তাঁদের চোখে চোখে রাখা প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররাও জায়গা থেকে সরে আসতেন। ফলে ডিবক্সে প্রায়ই জায়গা ফাঁকা পেয়ে যেতেন স্নাইডার। এ কারণে শটও নিয়েছেন প্রচুর। দুই পায়ে সমান স্বচ্ছন্দ ছিলেন, ফলে ডিফেন্ডাররা বুঝতে পারতেন না, স্নাইডার ডান পায়ে শট নেবেন, না বাঁ পায়ে।

মোরাত্তির স্বপ্নপূরণ। ছবি: এএফপি
মোরাত্তির স্বপ্নপূরণ। ছবি: এএফপি

ইন্টারের সাফল্যের পেছনে মূল রহস্য এটাই। আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের বিভিন্ন পজিশনে খেলার সক্ষমতা। ইতো আজীবন স্ট্রাইকার হিসেবে খেললেও দলের প্রয়োজনে ইন্টারে অনেক সময় হয়ে গিয়েছিলেন ফুলব্যাকও। একই কথা প্রযোজ্য পানদেভের ক্ষেত্রেও। রাইটব্যাক জানেত্তি হয়ে গিয়েছিলেন লেফটব্যাক। দলের প্রয়োজনে রোমানিয়ান লেফটব্যাক ক্রিস্টিয়ান কিভু খেলতেন লেফট উইঙ্গার হিসেবে। আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে ইন্টারে আসা স্তানকোভিচ পুরোদস্তুর সাবধানী মিডফিল্ডার হয়ে গিয়েছিলেন। দরকার পড়লেই সেন্টারব্যাক ওয়াল্টার স্যামুয়েলকে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলাতেন মরিনহো।

মরিনহো দলের প্রত্যেককে নিজের দর্শন বোঝাতে পেরেছিলেন। খেলোয়াড়েরাও জানপ্রাণ দিয়ে কোচের পরিকল্পনা মাঠে বাস্তবায়ন করার কাজে লেগে যেতেন। বার্সেলোনার বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালটার কথাই ধরুন। প্রথম লেগ ছিল ইন্টারের মাঠে, পরের লেগ বার্সার। ফাইনালে উঠতে হলে অন্তত এক লেগে বার্সাকে হারাতেই হবে, জানতেন মরিনহো। মেসিকে খাঁচাবদ্ধ করে দুর্দান্ত প্রতি আক্রমণের যে উদাহরণটা সেদিন ইন্টার দেখিয়েছে, সেটাই মরিনহোর দর্শন। প্রথম লেগে ৩-১ গোলে জেতার পর বার্সার মাঠে ইন্টারের লক্ষ্য ছিল, নিজেরা গোল করতে পারি বা না পারি, কোনোভাবে গোল যেন হজম না করতে হয়। যে কারণে দ্বিতীয় লেগে ৮৬ শতাংশ বলের দখল নিয়েও দুই গোল দিয়ে ফাইনালে উঠতে পারেননি মেসিরা। মাত্র এক গোল দিয়েছিল কাতালান ক্লাবটি, তাও সেন্টারব্যাক জেরার্ড পিকের কল্যাণে। মরিনহোর দৃষ্টিভঙ্গী ছিল সোজাসাপটা, শুধুমাত্র বলের দখল নিয়েই যে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যায়, সে ধারণা ভুল। ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ বহুভাবেই নেওয়া যায়। বার্সা যদি বল নিয়ে খেলতে চায়, খেলুক। ইন্টার খেলবে মাঠের জায়গা নিয়ে, জাভি-মেসি বা ইনিয়েস্তা-মেসির মাঝখানের জায়গাটা নিয়ে। পুয়োল-জাভি বা পিকে-ইয়াইয়া তোরেদের মাঝের সংযোগস্থলটা নিয়ে। যাতে কোনো ফাঁক গলে দুর্দান্ত কোনো পাস বা শট বের হতে না পারে। যে কারণে বলের দখল থাকলেও বার্সেলোনা গোলের সুযোগ সৃষ্টি করতে পেরেছে সামান্যই (অন্তত প্রথম লেগে)। আর গোলের সুযোগই যদি সৃষ্টি না করা যায়, তবে সে বলের দখল রেখে লাভ কী?

বার্সার বিপক্ষে ওই ম্যাচ শেষে আঙুল তুলে মরিনহোর সেই পাগলা দৌড়ের কথা ফুটবল ইতিহাসেরই অংশ হয়ে গেছে। ঠিক যেমন অংশ হয়েছে কয়েকদিন পর বায়ার্ন মিউনিখকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি নিয়ে মাসিমো মোরাত্তির উদযাপনের ছবিটা।

মরিনহো কথা দিয়েছিলেন, মোরাত্তির স্বপ্ন পূরণ করেই ছাড়বেন। সে কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন, ইন্টারকে জিতিয়েছিলেন অমূল্য ট্রেবল। সেই ট্রেবল জয়েরই দশ বছর হল গতকাল। যা এখনও মরিনহো ও মোরাত্তি, দুজনেরই ফুটবলীয় ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ অর্জন হয়ে জ্বলজ্বল করছে।