৬ মিনিটের রূপকথার নেপথ্যে 'লিফট'

মহাকাব্য লিখে ইস্তাম্বুলে শিরোপা উল্লাস করেছিল লিভারপুল। ছবি: এএফপি
মহাকাব্য লিখে ইস্তাম্বুলে শিরোপা উল্লাস করেছিল লিভারপুল। ছবি: এএফপি

কুসংস্কার তো কতই থাকে! খেলার মাঠে, খেলোয়াড়দের মধ্যে যার প্রভাব নিয়মিতই চোখে পড়ে। কেউ হয়তো ডান পা আগে দিয়ে মাঠে নামেন, আবার লিভারপুলের সাবেক স্ট্রাইকার ড্যানিয়েল স্টারিজের মতো কেউ মাঠে নামেন মাঠের দিকে পিছু ফিরে। তা এমন কুসংস্কার থেকে যদি ভালো কিছু হয়ে যায়, তা-ও মহাকাব্য লিখে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার মতো কিছু, তাহলে তো কথাই নেই!

লিভারপুলের ২০০৫ চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের নেপথ্যেও যেমন ছিল লিফট নিয়ে এক মজার খেলা। অন্তত সে সময়ের লিভারপুল কোচ রাফায়েল বেনিতেজের দাবি তেমনই। দাবিটা যে অবশ্য মজা করেই করা, তা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না!
গত মৌসুমে ষষ্ঠবারের মতো ইউরোপশ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরার পথে সেমিফাইনালে বার্সেলোনার বিপক্ষে অ্যানফিল্ডে মহাকাব্য লিখেছে ইয়ুর্গেন ক্লপের লিভারপুল। তবে ক্লাবটার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম রাতের কথা বলতে নিশ্চিতভাবে বার্সেলোনা নয়, লিভারপুলভক্তমাত্রই ফিরে যাবেন ঠিক ১৫ বছর আগে ইস্তাম্বুলের সেই স্বপ্নীল রাতটাতে। লিভারপুলের পঞ্চম চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের যে রাত এখনো হয়তো লিভারপুল ছাপিয়ে সাধারণ ফুটবলভক্ত মনেও অবিশ্বাস মাখানো মুগ্ধতা ছড়িয়ে যায়। এমন মহাকাব্যের দেখা তো আর প্রতি বছর মেলে না! লিভারপুলের ইতিহাসের তো বটেই, চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসেরই যে সেরা ফাইনাল সেটি, তা নিয়ে সম্ভবত তর্ক করার লোক খুব বেশি পাওয়া যাবে না।
২০০৫ সালের ২৫ মে। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল। একদিকে স্টিভেন জেরার্ডের লিভারপুল, অন্যদিকে তারকাখচিত এসি মিলান। কে নেই সেই মিলানে! গোলপোস্টে দিদা। তাঁর সামনে রক্ষণে আলেসান্দ্রো নেস্তা, পাওলো মালদিনি, জ্যাপ স্ট্যাম ও কাফুর মতো চার কিংবদন্তি। মাঝমাঠে তারকাদ্যুতিও একইরকম। ডিপলাইং প্লেমেকার আন্দ্রেয়া পিরলোর সামনে দুই পাশে ক্লারেন্স সিডর্ফ ও জেনারো গাত্তুসো, তাঁদের সামনে কাকা। আর দুই স্ট্রাইকার হার্নান ক্রেসপো ও আন্দ্রে শেভচেঙ্কো! বিপরীতে লিভারপুলে জেরার্ডের বাইরে বলার মতো নাম বলতে জাবি আলোনসো, লুইস গার্সিয়া, জেমি ক্যারাঘার আর স্যামি হুপিয়া।
প্রথমার্ধটা ম্যাচের আগের পূর্বানুমান মেনেই হলো। প্রথম মিনিটেই মালদিনির গোল, এরপর ক্রেসপোর দুই গোল মিলিয়ে বিরতিতেই ৩-০ গোলে এগিয়ে মিলান! শিরোপার উৎসবের প্রস্তুতি বুঝি ততক্ষণে অনেকটাই সারা মিলান শহরে। কিন্তু জেরার্ডে অনুপ্রাণিত লিভারপুল সেটা হতে দিলে তো!
লিভারপুল সমর্থকেরাও বুঝি কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন! দল ৩-০ পিছিয়ে, চ্যাম্পিয়নস লিগের জন্য ২১ বছরের অপেক্ষা ফুরোনোর এত কাছে এসেও এভাবে বড় হারের শঙ্কা তখন মাথার সামনে। অথচ চোখে জল নিয়েও তখনো ইস্তাম্বুল আতাতুর্ক স্টেডিয়ামে উপস্থিত লিভারপুল ভক্তরা গেয়ে চলছিলেন ক্লাবের সেই গানটা – ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন। 'ইন দ্য এন্ড অব আ স্টর্ম, দেয়ার'স আ গোল্ডেন স্কাই' কথাগুলো গান ছাপিয়ে যেন বিশ্বাস হয়ে ঝরছিল।
বিশ্বাসটাকে অক্সিজেন করেই দ্বিতীয়ার্ধে দৌড়েছেন জেরার্ডরা। দ্বিতীয়ার্ধে দলে একটা বদলও এনেছিলেন লিভারপুল কোচ বেনিতেজ। রাইটব্যাক স্টিভ ফিনানের বদলে নামান মিডফিল্ডার ডিটমার হামানকে। এরপর সেই মহাকাব্য! আক্রমণাত্মক খেলতে থাকা লিভারপুলে আশার সঞ্চার ৫৪ মিনিটে জেরার্ডের হেডে। গোলের উদ্‌যাপনে জেরার্ডের হাত উঁচিয়ে ভক্তদের কণ্ঠের জোর আরও বাড়ানোর আহ্বানই বলছিল, লিভারপুলের অধিনায়কের বিশ্বাসের জোর তখন কতটা! ৫৬ মিনিটে ভ্লাদিমির স্মাইচারের বক্সের বাইরে থেকে গোলায় ব্যবধান ৩-২। আর ৬০ মিনিটে সম্পূর্ণ হলো মহাকাব্যিক প্রত্যাবর্তন। জেরার্ডকে বক্সে ফেলে দেন গাত্তুসো, পেনাল্টি থেকে দ্বিতীয় চেষ্টায় বল জালে জড়ান আলোনসো। বাকি সময়ে লিভারপুল গোলকিপার জের্জি দুদেক অতিমানব হয়ে দাঁড়ানোয় আর গোল পায়নি মিলান। টাইব্রেকারেও আবার দুদেক-বীরত্ব, টাইব্রেকার শেষে লিভারপুলের কান্না। তবে এবার কান্না বিজয়ের আনন্দের।
কীভাবে হয়েছিল সেদিন এই মহাকাব্য রচনা? এতদিন পর সে বর্ণনায় ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য অ্যাথলেটিকে একটা কুসংস্কারের কথাও মজা করে টেনে আনলেন বেনিতেজ। সেই লিফট নিয়ে খেলার গল্প, 'এখনো মনে পড়ে, ম্যাচের আগে দলের হোটেলে লিফটের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যেটা আমাদের হোটেলের লবিতে নিয়ে যাবে। মনে মনে বলছিলাম, (অনেকগুলো লিফটের মধ্যে প্রতিটিকে আলাদা আলাদাভাবে বোঝাতে) যদি এই লিফটটা আগে আসে, তাহলে ১-০ গোলে জিতব, ওই লিফটটা এলে ড্র হবে ম্যাচ, ওই দিকের ওই লিফটটা এলে আমরা হারব। আর যদি অন্য লিফটটা আসে, তাহলে আমরা টাইব্রেকারে জিতব। কোনটি এসেছে, তা এখন আর নিশ্চয়ই বলে দিতে হয় না! রাতটাই ছিল আবেগের উত্থান-পতনের, সে কারণে লিফটের গল্পটা আরও যথাযথ মনে হয়।'

শুধুই একটা কুসংস্কারই এটা। কিন্তু হয়তো এটিই সেদিন ইঙ্গিত ছিল, ইস্তাম্বুল রঙিন হতে যাচ্ছে লিভারপুলের লালে!