'...মনে হলো প্রাণটা বেরিয়ে যাবে'

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আজ ১৫ বছর পূর্তি মুশফিকুর রহিমের। ছবি: শামসুল হক
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আজ ১৫ বছর পূর্তি মুশফিকুর রহিমের। ছবি: শামসুল হক
>মুশফিকুর রহিমের লম্বা সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল এ মাসের শুরুতে। দীর্ঘ আলাপচারিতার কিছু অংশ প্রথম আলোয় প্রকাশ হয়েছিল গত ৯ মে, তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে। আজ বাকিটা প্রকাশ হলো তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ১৫ বছর পূর্তিতে। বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল উইকেটকিপার ব্যাটসম্যানের জানা-অজানা নানা গল্প উঠে এল এ আলাপচারিতায়—

প্রশ্ন: অভিষেক টেস্টের নানা স্মৃতিই তো থাকে। এমন একটি স্মৃতি শুনতে চাই, যেটি মনে পড়লে আপনার খুব হাসি পায়।
মুশফিকুর রহিম: নিশ্চয়ই জানেন, অনূর্ধ্ব-১৯ খেলার সময়ই আমি জাতীয় দলে সুযোগ পাই। (২০০৫ সালে) ইংল্যান্ড সফরের সুযোগ পাওয়ার আগে যুব দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়া সফরে ছিলাম। অস্ট্রেলিয়া সফর থেকেই তাড়াহুড়ো করে বাংলাদেশ দলের ইংল্যান্ড সফরে যোগ দিতে হয়। অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সেভাবে জোরে বোলিং করা বোলারকে খেলতে হয়নি। তখন এক ধরনের গার্ড ব্যবহার করতাম, যেটার দাম ৬০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা দাম। ওই গার্ড যখন ব্যবহার করেছি, তখন বুঝিনি এটা এত গুরুত্ব বহন করে। কারণ, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে আমাকে তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। অভিষেক টেস্টে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের একটা বল আমার লাগার পর মনে হলো প্রাণটা বেরিয়ে যাবে! ব্যাটিংয়ের সময় কোনো একটা বিরতিতে ড্রেসিংরুমে এসে দেখি (তলপেটের) গার্ড দশ টুকরো হয়ে গেছে। তখন উপলব্ধি হয়েছে গার্ডের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই (হাসি)! এই অভিজ্ঞতার পর সব সময়ই আগে নিশ্চিত করি, গার্ড যেন ভালো হয়। 

প্রশ্ন: দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বাংলাদেশের বেশ কয়েক প্রজন্মের ক্রিকেটারের সঙ্গে খেলেছেন, কাছ থেকে দেখেছেন। ১৫ বছর আগের খেলোয়াড়দের সঙ্গে এখনকার তরুণদের মৌলিক পার্থক্যটা কোন জায়গায়?
মুশফিক: যখন শুরু করি, আমি, সাকিব (আল হাসান), তামিম (ইকবাল) অনেক সৌভাগ্যবান ছিলাম। সুমন ভাই (হাবিবুল বাশার), (মোহাম্মদ) রফিক ভাই, মাশরাফি ভাই (বিন মুর্তজা), জাভেদ ভাই (ওমর বেলিম), রাজিন (সালেহ) ভাইদের অধীনে আমরা ক্যারিয়ার শুরু করেছি। তাঁদের অনেক সহায়তা পেয়েছি। তখন অনেক ম্যাচ ব্যর্থ হলেও তাঁরা যে সমর্থন দিয়েছে, সেটি না পেলে এত দূর নাও আসতে পারতাম। সত্যি বলতে ওই সময়ের সঙ্গে এখনকার ক্রিকেটারদের অনেক পার্থক্য আছে। আমাদের শুরুর সময় অনেকে হয়তো নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে সন্তুষ্ট থাকত। আসলে তখন ম্যাচ জেতানো খেলোয়াড়ই কম ছিল। এখন যে দলে নতুন আসুক, সে জানে এই দলে সাকিব, তামিম, রিয়াদ ভাই, মাশরাফি ভাই কিংবা এমন খেলোয়াড় আছে, যারা একাই দলকে জিতিয়ে দিতে পারে। এখন যেকোনো খেলোয়াড় এই ভাবনা নিয়েই আসে যে আমাকে এই পর্যায়ে ভালো খেলতে হবে, এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এটা চ্যালেঞ্জ ও ভীষণ চাপের। তবে দেখেন তাদের স্ট্যান্ডার্ড শুরু হচ্ছে অনেক উঁচু পর্যায় থেকে। তাদের চিন্তাভাবনাও অন্য রকম হতে হয়। নিজের খেলা নয়, দলকে জেতাতে যা করণীয় সেটাই তাকে করতে হয়। ১৫ বছরে আমাদের দলে এটাই বড় পরিবর্তন। আবারও সাকিব-তামিমকে কৃতিত্ব দিই। সুমন ভাইয়েরা যেখানে শেষ করেছেন, তারা সেখান থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেছেন। আমরা এটা এমন জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, যেটা পরের প্রজন্ম আরও সামনে টেনে নিয়ে যেতে পারে।

প্রশ্ন: ১৫ বছরে অনেক কোচের সঙ্গে কাজ করা হয়েছে আপনার। আপনাকে যদি তালিকা করতে বলা হয় কোন কোন কোচকে সবচেয়ে এগিয়ে রাখবেন?

মুশফিক: নাজমুল আবেদীন ফাহিম স্যার আর মতি স্যার (মতিউর রহমান)। দুজনই বিকেএসপির। এই দুজন বলতে গেলে ক্যারিয়ারের একবারে শুরু থেকে আমার হৃদয়ের খুব কাছাকাছি আছেন। আমার খারাপ-ভালো, দুই সময়েই তাঁরা আমার সঙ্গে থাকেন। বেশিরভাগ সময় দুজনকে ফোন দেওয়া হয়। বিশেষ করে খারাপ সময়ে বেশি যোগাযোগ হয়। বিদেশি কোচদের মধ্যে জেমি সিডন্স। তিনি ব্যাটসম্যানদের জন্য স্পেশাল কোচ ছিলেন। তাঁর কিছু টেকনিক, কৌশল খুবই ভালো ছিল। এরপর চন্ডিকা হাথুরসিংহে। এ দুজন ব্যাটসম্যানদের জন্য অনেক ভালো কোচ ছিলেন।

দলের ব্যাটিংয়ে আস্থার প্রতীক মুশফিক। ছবি: প্রথম আলো
দলের ব্যাটিংয়ে আস্থার প্রতীক মুশফিক। ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন: ১৫ বছরের ক্যারিয়ারের নিজের সেরা তিনটা ইনিংস বেছে নিতে বললে কোন তিনটি নেবেন?
মুশফিক: ১. ২০১৩ সালে গলে আমার প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি। ২. ২০১৮ এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ১৪৪। ৩. ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ফিফটি।
প্রশ্ন: আপনার দেখা বাংলাদেশের সেরা তিনটি ম্যাচ?
মুশফিক: ১. ভারতের বিপক্ষে ২০০৭ বিশ্বকাপে জয় ২. ২০১৬ সালের অক্টোবরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুর টেস্ট জয়। ৩. ২০১৭ সালের জুনে কার্ডিফে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জয়।
প্রশ্ন: কোন তিনটি হার কিছুতেই ভুলতে পারেন না?
মুশফিক: ১. পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০১২এশিয়া কাপের ফাইনাল ২. বেঙ্গালুরুতে ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে হার আর ৩. ২০১৮ সালের জুলাইয়ে গায়নায় উন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে পরাজয়। মোট কথা আমি যে হারগুলোর জন্য দায়ী বা আমার দোষে তীরে এসে তরি ডুবেছে দলের!
প্রশ্ন: কোন তিন বোলারকে খেলতে কঠিন মনে হয়েছে?
মুশফিক: ১. অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ: যদিও তাকে কম খেলেছি। আমার প্রথম টেস্ট, ২০০৭ বিশ্বকাপে খেলেছে। তখন সে নিজের সেরা ছন্দে। আমাকে তাকে কঠিন মনে হয়েছে। ২. মুত্তিয়া মুরালিধরন: যখন প্রথম খেলি তার বিপক্ষে, ওকে কিছুই বুঝিনি। ২০০৬ সালে বগুড়া টেস্টে ওকে পড়তেই পারিনি। ৩. মরনে মরকেল: সব সময় কঠিন মনে হয়নি। তবে ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ওকে খেলতে বেশ সমস্যা হচ্ছিল।
প্রশ্ন: ঠিক বিপরীত প্রশ্ন, কোন বোলারকে খেলতে খুব সহজ মনে হয়েছে?
মুশফিক: তেমন নেই। তবে পরিসংখ্যান বলে থিসারা পেরেরার বিপক্ষে আমার রেকর্ড ভালো। কিছুটা হলেও ওকে পড়তে পারি।
প্রশ্ন: এখন পর্যন্ত ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত কোনটিকে বলবেন?
মুশফিক: ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি, ২০১৩ সালে গল টেস্টে। যদিও আমার সেটা করার কথা ছিল না। আগের রাতেও আশরাফুল ভাই আর আমি এক সঙ্গে ডিনার করলাম। দুজন কত পরিকল্পনা করলাম। বললাম, ওদের পুরো দুই-তিন খাটাতে থাকব। শ্রীলঙ্কা এমন এক দল, ওরা আমাদের একটা সময় ভীষণ খাটিয়েছে। কুমার সাঙ্গাকারা যে খারুজ! আমার সামনেই সে তিন-চারটা ডাবল করেছে। এ কারণে এই দলটার বিপক্ষে আমার একটা ক্ষোভ ছিল। সেই টেস্টে ভেবেছিলাম যতটা পারা যায় ওদের খাটাব। ওরা যদি হাত মেলাতে আসে, তবুও মেলাব না! পুরো পাঁচদিন না খাটাতে পারলেও টেস্টটা আমরা ভালোভাবে ড্র করেছিলাম।

প্রশ্ন: এখন যদি ওই ২০০৫-০৬ সালের মুশফিককে কিছু উপদেশ দিতে বলা হয়, তাহলে কী বলবেন?

মুশফিক: তখন খুব ছোট ছিলাম। বড় শট খেলা বা গতিময় বোলারদের খেলা কিংবা ভালো মানের স্পিনের বিপক্ষে খেলার দক্ষতা তেমন ছিল না। শুরুতে দক্ষ হওয়াটা কঠিন। নিশ্চয়ই জানেন, বাংলাদেশের ঘরোয়া বা বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসতে কত বড় একটা ধাপ পার হতে হয়। অন্যান্য দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের মান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে থাকে না। ঘরোয়া ক্রিকেটে চার-পাঁচ বছর খেলে নিজেদের পাকিয়ে তাদের ক্রিকেটাররা এই পর্যায়ে আসে। তাদের ১৮ থেকে ২০-এ যেতে হয়। আমাদের এখানে ১০ থেকে ২০-এ লাফ দিতে হয়। এ যাত্রাটা অনেক কঠিন। আমাদের অনেক খেলোয়াড়কে সংগ্রাম করতে হয় এ কারণেই। খুব কম খেলোয়াড় আছে যাদের ১০-১৫ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার হয়। এখন যে জায়গায় আছি মনে হয়, তখন যদি আরও ভালো শট খেলার দক্ষতা থাকত, নিয়মিত আরও ওপরে খেলার সুযোগ পেতাম তাহলে হয়তো পরিসংখ্যানটা অন্যরকম হতে পারত।
প্রশ্ন: ১৫ বছরের যাত্রা শেষ। ক্যারিয়ারের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন। একটা সময় প্রকৃতির নিয়ম মেনে পুরো পথটাই শেষ হয়ে যাবে। যখন খেলা ছাড়বেন, তিন সংস্করণের কোনটি আগে ছাড়বেন?

মুশফিক: (হেসে) এ ধরনের ভাবনা এক সেকেন্ডের জন্যও ভাবিনি। যেদিন সময় হবে, বলব। টেস্ট অবশ্যই বড় ভালো লাগার জায়গা। তবে সবার আগে ফিটনেস, এরপর পারফরম্যান্স। এই দুটো যত দিন ঠিক থাকবে একটা সংস্করণ ছেড়ে আর দুটোতে মনোযোগ বাড়ানোর চিন্তা নেই। ভবিষ্যতই সব বলে দেবে। তিনটি সংস্করণেই ধারাবাহিক ভালো খেলা বড় চ্যালেঞ্জ, বড় দায়িত্ব। হ্যাঁ, একদিন শেষ তো করতেই হবে। তবে যেটা দিয়ে শেষ করব সেটা ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস হবে। এখন বুঝে নিন কখন কোনটা দিয়ে শেষ করতে পারি।