তাঁকে হারিয়ে কাঁদছে আবাহনী, শোকার্ত সতীর্থরা

শনিবার বিকেলে বাফুফে ভবন প্রাঙ্গণে ফুলে ফুলে ঢাকা গোলাম রাব্বানী হেলালের কফিন। ছবি: সংগৃহীত
শনিবার বিকেলে বাফুফে ভবন প্রাঙ্গণে ফুলে ফুলে ঢাকা গোলাম রাব্বানী হেলালের কফিন। ছবি: সংগৃহীত

শনিবার বিষণ্ন এক বিকেলে গোলাম রাব্বানী হেলালকে চিরবিদায় জানাল ঢাকা আবাহনী লিমিটেড। আজ থেকে তিন দিন ক্লাবের পতাকা অর্ধনমিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আবাহনী কর্তৃপক্ষ। আপাতত ক্লাবের সাবেক ফুটবলারের প্রতি এটাই আকাশি নীলের শ্রদ্ধার্ঘ্য। মঙ্গলবার দোয়া মাহফিল হবে আবাহনী প্রাঙ্গণে, যে প্রাঙ্গণে প্রথম পা রেখেছিলেন ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে। কৈশোরের শেষ ধাপে তখন তিনি দাঁড়িয়ে।
গতকাল যখন ক্লাবে এলেন, কফিনে তাঁর নিথর দেহ। কোনো সাড়া নেই। সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেলেন গতকালই দুপুর ১২টার দিকে। রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের বিছানায় অচেতন অবস্থায় কাটল তাঁর ষাটোর্ধ্ব জীবনের অন্তিম সময়গুলো। ২৮ মে মস্তিষ্কে তীব্র রক্তক্ষরণের ধকলটা আর সামলানো গেল না। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অনন্তলোকের পথে পাড়ি জমালেন সত্তর-আশির দশকে আমাদের ফুটবল নস্টালজিয়ার অন্যতম চেনা মুখ গোলাম রাব্বানী।
বাফুফে ভবনে জানাজা শেষে গোলাম রাব্বানীর মরদেহ আনা হয় প্রিয় আবাহনী ক্লাবে। খেলোয়াড়ি জীবনে তাঁর সবচেয়ে বড় ভালোবাসার জায়গা ছিল এটি। ক্লাবও তাঁকে ভালোবাসা জানাতে ভোলেনি। গোলাম রাব্বানীর কফিন ঢেকে দেওয়া হলো আবাহনীর পতাকায়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত খেলোয়াড় এবং পরে পরিচালক-ম্যানেজার হয়ে ধানমন্ডির ক্লাবটির প্রেমেই বাঁধা রইলেন তিনি। তাঁর নিথর শরীর সেই ক্লাব চত্বরে দেখে নীরবে চোখের জল ফেলেছেন সাবেক সতীর্থরা।
করোনার কারণে অনেকেই আসতে পারেননি। তবে করোনা-ভয় অনেককে আটকেও রাখতে পারেনি ঘরে। আবাহনী-মোহামেডানের বেশ কয়েকজন ফুটবলার প্রিয় সতীর্থকে শেষবার দেখতে আসেন। যাঁদের মধ্যে আছেন আবাহনীর সাবেক অধিনায়ক কাজী আনোয়ার, খোরশেদ বাবুল, শেখ আসলাম, জোসিম উদ্দিন জোসি, কায়সার হামিদ, ইকবাল হোসেন, মামুন, আলমগীর, মাসুদ রানা প্রমুখ। আবাহনী সমর্থকগোষ্ঠীর লোকজন এলেন। আবাহনী-মোহামেডানের পক্ষ থেকে ফুল দেওয়া হলো। এই আতঙ্কময় সময়েও হেলালের কফিনে পুষ্পস্তবকের অভাব হয়নি।
গোলাম রাব্বানীর এমন বিদায় কেউই চাননি। সবাই মর্মাহত। সাবেক সতীর্থ কাজী আনোয়ার স্মৃতিচারণায় প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘হেলাল এমন এক মানুষ ছিল, যাঁকে আপনি কখনো ভুলতে পারবেন না। খুব স্টাইলিশ প্লেয়ার ছিল। শৌখিন, দামি কাপড়চোপড় পরত। ক্লাব থেকে পারিশ্রমিক হিসেবে যা পেত, সবই কাপড়চোপড়ের পেছনে ব্যয় করত। ছোটদের খুব ভালোবাসত। জার্সি, বুট কিনে দিত। আসলে ওর কথা বলে শেষ করা যাবে না।’
আবাহনীর ম্যানেজার হিসেবে দল তৈরি করতেন হেলাল। নিজের বাসায় নিয়ে খেলোয়াড়দের রাখতেন। মাসুদ রানা, জাকিরদের তখন উঠে আসার সময়। এই ফুটবলাররা হেলালের অফুরন্ত ভালোবাসা পেয়েছেন। ফুটবলাররা তাঁর বাসায় গিয়ে কিছু পছন্দ করলে হেলাল সেটা দিয়ে দিতেন। উদার মন ছিল তাঁর। ফুটবলারদের নিয়ে নিজের বাসায় গল্প, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া...একটা উৎসবেই ডুবে থাকতেন মানুষটি।

আবাহনীর হেলালের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন মোহামেডানের কায়সার হামিদ। ছবি: সংগৃহীত
আবাহনীর হেলালের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন মোহামেডানের কায়সার হামিদ। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বকাপ ফুটবলের ম্যাচ দেখার শখ ছিল তাঁর। সম্ভবত বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিশ্বকাপ ম্যাচ দেখেছেন গোলাম রাব্বানী। ম্যারাডোনাসহ বিশ্বের অনেক বড় ফুটবলারের সঙ্গে তাঁর ছবি আছে। খেলার মাফফার সংগ্রহে রাখতেন। ১৯৮২ সালে জেলের রুমসঙ্গী কাজী আনোয়ার পেছন ফিরে বলেন, ‘বড় বড় লোকের সঙ্গে ছিল ওর ওঠাবসা। এটা খুব ভালো লাগত আমাদের। অসুস্থ হওয়ার পর গত সাত-আট মাস আগে ক্লাবে আসত নিয়মিত। স্রেফ মনের বিনোদনের জন্য। মুড়ি, পেঁয়াজি সঙ্গে নিয়ে আসত। এক-দেড় ঘণ্টা ক্লাবে আড্ডা মারত আমাদের সঙ্গে। খুবই প্রাণবন্ত ছিল। আনন্দ অনুভব করত আবাহনী ক্লাবে এলে।’
১৯৮৪ সাল থেকে আবাহনী ক্লাবে শেখ আসলামের সঙ্গে একই রুমে ছিলেন গোলাম রাব্বানী। টানা ৯ বছর। সেই আসলাম স্মৃতিচারণায় প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘আবাহনী ক্লাবে কত সময় যে একসঙ্গে কাটিয়েছি, হিসাব করা কঠিন। আমার আর হেলাল ভাইয়ের ছোট দুটি বিছানা ছিল আলাদা। দুজনের মাথা থাকত কাছাকাছি। এলিফ্যান্ট রোডে হেলাল ভাই আর গোলকিপার পিন্টু ভাইয়ের চায়নিজ হোটেল ছিল। ওখান থেকে কখনো কখনো রাতে ফিরতে দেরি হলে খুব সাবধানে রুমে ঢুকতেন। এটা কখনো ভোলার নয়। খুবই ভদ্রলোক একজন মানুষ।’

শবে বরাতের রাতে আসলামকে নিয়ে ঢাকা শহর ঘুরতেন গোলাম রাব্বানী। দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করতেন। আসলাম বলেন, ‘ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারানোয় তাঁর মনে ভেতর দুঃখ ছিল। তবে প্রকাশ করতেন না। আমরা সেটা বুঝতাম। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় এশিয়ান যুব ফুটবলে ক্যাম্পে একসঙ্গে ছিলাম। সেবার ঈদে ছুটি মেলেনি। ওই সময় হেলাল ভাই আমাকে ভলি শেখান, হাফ ভলি দেখান। এগুলো সেই যে শিখলাম, আর ভুলিনি।’
আবাহনীর ছোট লনটায় তখন ফুটবল নিয়ে নানা রকম বাজি হতো, যা স্কিল তৈরি করতে সহায়ক হতো ফুটবলারদের। স্মৃতিচারণায় আবাহনীর সাবেক ফুটবলাররা বলছেন, ম্যাচে মিস পাস হলে বরিশালের ভাষায় বকা দিতেন সতীর্থদের। আবাহনী হারছে বা ড্র করছে, এমন সময় গোটা দলকে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করতেন। মানুষটার মন-প্রাণজুড়ে ছিল শুধুই আবাহনী। আজকাল এই ক্লাবপ্রেম কোথায় হারিয়ে গেছে!

শেষ যাত্রায় আবাহনীর পতাকা সঙ্গে পেলেন হেলাল। ছবি: সংগৃহীত
শেষ যাত্রায় আবাহনীর পতাকা সঙ্গে পেলেন হেলাল। ছবি: সংগৃহীত

সাবেক ফুটবলার জাকির হোসেন এসব নিয়ে দুঃখ করেন। বলেন, ‘হেলাল ভাই আবাহনী ছাড়া আর কিছুই বুঝতেন না। আবাহনী ক্লাবের পাশেই অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলেন। আমরা যখন ১৯৯১ সালে ক্লাবে অনুশীলন করি, তিনি প্রতিদিন আসতেন। আমাদের নাশতা খাওয়াতেন। আসলে হেলাল ভাইয়ের কথা বলে শেষ করা যাবে না।’ আবাহনীতে খেলা সাবেক গোলরক্ষক বরিশালের মেহেদি হাসান বাবলু বলেন, ‘আমি মনে হয় ভাই হারালাম। ও এত ভালো ছিল।’
এভাবে সবার মুখেই শুধু হেলাল-মুগ্ধতা। আর তাঁর জন্য শোক। হেলাল মূলত ওপরে খেলতেন। তবে ক্লাব যেখানে প্রয়োজন, সেখানেই খেলাত তাঁকে। এমন ফুটবলার-সংগঠক দেশের ফুটবলে এখন দেখা যায় না। তাঁর আত্মা চিরশান্তিতে থাকুক। এটাই গোটা ফুটবল অঙ্গনের প্রার্থনা।