আশরাফুল-আমিনুলদের কীর্তির সাক্ষী সেই মানুষটি

টুইটারে ডেভিড শেফার্ডের এই ছবিটিই আপলোড করেছে হিস্টোরিক ক্রিকেট পিকচার্স। ছবি: টুইটার
টুইটারে ডেভিড শেফার্ডের এই ছবিটিই আপলোড করেছে হিস্টোরিক ক্রিকেট পিকচার্স। ছবি: টুইটার

মনে পড়ে ডেভিড শেফার্ডকে?


বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের এই মানুষটিকে বিশেষভাবে মনে রাখা উচিত। এদেশের ক্রিকেটের দুটি বড় ঘটনায় যে তাঁর নাম জড়িয়ে আছে। মোটাসোটা, নাদুস–নুদুস শরীরের সেই সর্বজন শ্রদ্ধেয়, বিখ্যাত আম্পায়ার বাংলাদেশের ক্রিকেটের কোন দুটি ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, সে আলোচনায় পরে আসা যাবে। তবে এতটুকু বলে দেওয়া যেতে পারে, সে দুই ঘটনার নায়ক আমিনুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আশরাফুল।

তাঁর আগে ডেভিড শেফার্ডের বর্ণালী জীবনটা একটু জেনে নেওয়া যাক। ক্রিকেট মাঠে নাচতেন শেফার্ড! সেই নৃত্য কি এত সহজে ভুলে যাওয়া যায়? ওটাই যে তাঁকে করে তুলেছিল বিখ্যাত, দর্শকনন্দিত। আম্পায়ারিং করার সময় ব্যাটিং করা দল যখন ১১১ রানে থাকত, কিংবা কোনো ব্যাটসম্যান যখন ১১১ রানে অপরাজিত থাকতেন, তখন তিনি দুই পায়ে ছোট্ট একটা লাফ দিতেন—অবশ্যই সংস্কারবশত; কিন্তু সেই লাফটা দেখার জন্য অধীর থাকত দর্শকেরা। ম্যাচ চলার সময় টেলিভিশন প্রযোজকেরা প্রস্তুত থাকতেন 'নেলসন' বা ১১১ রানের জন্য। ক্যামেরা ক্রুদের বলে দেওয়া থাকত, আর যাই কর, ১১১ রানের সময় শেফার্ডের দিকে ক্যামেরা ধরতেই হবে। ওই একটা সময় টেন্ডুলকার, লারা, সাঈদ আনোয়াররা হয়ে উঠতেন রীতিমতো ব্রাত্য। অন্তত সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে।

ক্যারিয়ারের একটা বড় অংশে তিনি আম্পায়ারিং করেছেন টেলিভিশন রিপ্লের সাহায্য ছাড়াই। তাঁর আম্পায়ারিংয়ের সময় ডিআরএস বা ডিসিশন রিভিউ পদ্ধতি ছিল অনেক দূরের ব্যাপার। ৯২টি টেস্ট আর ১৭২টি ওয়ানডে ম্যাচ পরিচালনার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি আম্পায়ারিং ছাড়েন ২০০৫ সালে।

টেস্ট পরিবারে নতুন আয়ারল্যান্ড ও আফগানিস্তান বাদে অন্য সব টেস্ট খেলুড়ে দেশেই তিনি আম্পায়ারিং করার বিরল কৃতিত্বের অধিকারী; ২০০৯ সালের ২৭ অক্টোবর ৬৮ বছর বয়সে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। গ্লুস্টারশায়ারের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা শেফার্ডের মতো একজন সম্মানীয় অভিভাবককে এখনো খুঁজে ফেরে ক্রিকেট নামের খেলাটি। জীবনটা যথেষ্ট বর্ণাঢ্য ছিল তাঁর। একটাই আক্ষেপ হয়তো ছিল তাঁর—কখনোই ইংল্যান্ড জাতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে খেলতে পারেননি। কিন্তু ২৮২টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ১২টি সেঞ্চুরির রেকর্ড কিন্তু অনেক ক্রিকেটারের জন্যই ঈর্ষণীয়।

বিখ্যাত আম্পায়ার, অথচ, সময় পেলেই ভাইয়ের পোস্ট অফিসে গিয়ে বসতেন। ভাবা যায়, তাঁর মতো বিখ্যাত ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব নিজ শহর ডেভনে দৈনিক পত্রিকা বিলির কাজ করতেন। ভোর ৬:৩০ মিনিটের আগেই তিনি পত্রিকা নিয়ে পৌঁছে যেতেন মানুষের বাড়ি।

২০০৫ সালে কিংস্টোনে পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচটি ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচ। সে ম্যাচে একটা খেলোয়াড়দের পক্ষ থেকে একটা ব্যাট উপহার দিয়েছিলেন ব্রায়ান লারা। তাতে লেখা ছিল, 'আপনার পেশাদারিত্ব, কাজ আর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের স্মৃতি বেঁচে থাকবে সব সময়।'

বাংলাদেশের ক্রিকেটের দুই বিখ্যাত কীর্তির সাক্ষী ডেভিড শেফার্ড। ছবি: এএফপি
বাংলাদেশের ক্রিকেটের দুই বিখ্যাত কীর্তির সাক্ষী ডেভিড শেফার্ড। ছবি: এএফপি

সবচেয়ে দারুণ কথাটা লেখা হয়েছিল তাঁর অবিচুয়ারিতে—'সবাই একটা ব্যাপার ভেবে মাথার চুল ছেঁড়ে—ক্রিকেটীয় চেতনা কাকে বলে? জিনিসটা কি! এত কিছু না করে ডেভিড শেফার্ডের জীবনটার দিকে তাকালেই তো উত্তরটা পেয়ে যাওয়া যায়।' টুইটারের জনপ্রিয় পেজ 'হিস্টোরিক ক্রিকেট পিকচার্সে' সম্প্রতি শেফার্ডের খেলোয়াড়ি জীবনের দুর্দান্ত একটা ছবি পোস্ট করা হয়েছে। ছবিটা বেশ বিরলও। তাতে দেখা যাচ্ছে তিনি ১৯৭৩ সালে জিলেট কাপের ফাইনাল শেষ গ্লুস্টারশায়ারের ড্রেসিং রুমে বিয়ারের বোতল নিয়ে বিজয় উদযাপন করছেন। সঙ্গে পাকিস্তানের বিখ্যাত 'মোহাম্মদ' পরিবারের অন্যতম ভাই সাদিক মোহাম্মদ। টুইটটিতে লেখা হয়েছে, 'শেফার্ড একজন ক্রিকেট আম্পায়ার হিসেবে সারা বিশ্বে সমাদৃত ছিলেন। কিন্তু তিনি ডেভন (তাঁর নিজের এলাকার ক্লাব) ও গ্লুস্টারশায়ারের একজন ভালো মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানও ছিলেন।'

বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে শেফার্ডের নাম জড়িয়ে আছে দারুণভাবে—এবার এই আলোচনায় আসা যাক। অন্তত দুজন বাংলাদেশি ক্রিকেটারের নাম শেফার্ড হয়তো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনে রেখেছিলেন, তাদের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের কারণে। ২০০০ সালের নভেম্বরে স্টিভ বাকনরের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট আম্পায়ার হিসেবে দাঁড়িয়ে শেফার্ড দেখেছিলেন আমিনুল ইসলামের অনবদ্য ১৪৫ রানের ইনিংসটি। এর ঠিক সাড়ে চার বছর পর ওয়েলসের কার্ডিফে তাঁর সামনেই মোহাম্মদ আশরাফুলের সেঞ্চুরি, যার কারণে বাংলাদেশের সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল রিকি পন্টিং, গ্লেন ম্যাকগ্রা, অ্যাডাম গিলক্রিস্টদের মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়া। অভিষেক টেস্টেই বাংলাদেশকে পেয়েছিলেন তিনি।

যদিও বাংলাদেশের মাটিতে আরও একটি টেস্টে তিনি আম্পায়ার ছিলেন। সেটি ১৯৯৯ সালের মার্চে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মধ্যকার এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে। ওয়াসিম আকরামের হ্যাটট্রিক ও ইনজামাম–উল–হক আর ইজাজ আহমেদের ডাবল সেঞ্চুরির জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে যে টেস্ট ম্যাচটি। তাঁর আম্পায়ারিং করা বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ '৯৯ সালেই ঢাকায় পাকিস্তানের বিপক্ষে। এরপর তিনি ঢাকা, কিম্বার্লি, কলম্বো, কেয়ার্নস, কিংস্টোন, সেন্ট জর্জ ও ট্রেন্টব্রিজে বাংলাদেশের আরও ১৩টি ওয়ানডেতে আম্পায়ারিং করেছেন।

শেফার্ড অবশ্য প্রথম ঢাকায় এসেছিলেন আরও আগে। ১৯৯৮ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সেই বিখ্যাত 'মিনি বিশ্বকাপে' তিনি তিনটি ম্যাচে আম্পায়ারিং করেন। এর মধ্যে টুর্নামেন্টের ফাইনালও ছিল। আমিনুল আর আশরাফুল গর্ব করে বলতেই পারেন—ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত আম্পায়ারের সামনেই দেশের হয়ে অনন্য কীর্তি তাঁদের।