ছবিতে ক্রিকেটের '১০' নস্টালজিয়া

জীবনে কিছু মুহূর্ত আসে, যা মানুষ মনে রাখে সারাজীবন। আলোকচিত্র সে মুহূর্তগুলোকে করে তোলে অমর, অবিনস্বর। অ্যালবামের পাতা উল্টে সে ছবিগুলো মানুষকে করে স্মৃতিকাতর। মাঠে বড় বড় লেন্স আর ক্যামেরা নিয়ে খেলার দুর্দান্ত সব ঘটনাকে ইতিহাসে রূপ দেন ফটো সাংবাদিকেরা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যে ছবিগুলোতে কথা বলে যায় ইতিহাস। ক্রিকেট এমন একটা খেলা যা দেড় শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে জন্ম দিয়েছে নানা উপাখ্যান। বিশ্বখ্যাত সব আলোকচিত্রীদের ক্যামেরায় ধরে রাখা ক্রিকেটের অজস্র ঐতিহাসিক মুহূর্তের মধ্য থেকে ১০টি বাছাই করে এখানে দেওয়া হলো। যে ছবিগুলো সবাইকে টাইম মেশিনে চড়িয়ে ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে আসবে ক্রিকেটে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে-

সেই সিরিজের স্মৃতি। ছবি : টুইটার
সেই সিরিজের স্মৃতি। ছবি : টুইটার

সেই ভয়ংকর বডিলাইন বোলিং

ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানকে ঠেকাতে 'নৃশংস' এক পথ বেছে নিয়েছিলেন ইংলিশ অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিন। ১৯৩২ সালে অ্যাশেজ সিরিজের আগে 'হোমওয়ার্ক'টা দারুণ করেছিল ইংল্যান্ড দল। তীব্র গতির শর্ট পিচ বলে অস্ট্রেলীয় কিংবদন্তির দুর্বলতাটা ধরে ফেলেছিলেন জার্ডিন। ফাস্ট বোলার হ্যারল্ড লারউডের দায়িত্ব ছিল ব্র্যাডম্যানসহ অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানদের শরীর লক্ষ্য করে একের পর একে কামানের গোলা ছোড়া। পুরোপুরি নিয়মের মধ্য থেকে নিয়মের দুর্বলতার সর্বোচ্চ ব্যবহার। ছবিতে দেখুন লেগ সাইডে বেশিরভাগ ফিল্ডার রেখে অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানের শরীর লক্ষ্য করে বোলিং করা। পদ্ধতিটা কাজে লেগেছিল। ইংল্যান্ড ৪–১ ব্যবধানে সিরিজ জিতলেও এটি ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে। অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের কূটনৈতিক সম্পর্কও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। জার্ডিনও হয়ে আছেন ক্রিকেট ইতিহাসের ভিলেন।

সেই মুহূর্ত্ব। সংগৃহীত ছবি
সেই মুহূর্ত্ব। সংগৃহীত ছবি

ব্র্যাডম্যানের সেই বোল্ড আউট

মাত্র ৪ রান করতে পারলেই টেস্ট ক্যারিয়ারে ব্যাটিং গড়টা হবে তাঁর ১০০। এমন একটা উপলক্ষ্যের সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে হতাশ করেছিলেন ব্র্যাডম্যান। ১৯৪৮ সালের অ্যাশেজ সিরিজই ছিল ব্র্যাডম্যানের শেষ সিরিজ। ওভালে শেষ টেস্টের আগে অস্ট্রেলিয়া ৩–০ ব্যবধানে এগিয়ে সিরিজ জয়ও নিশ্চিত করেছে। অপেক্ষাটা ছিল কেবল ব্র্যাডম্যানের রূপকথার নায়ক হওয়ার। কিন্তু সেদিন মোটামুটি অখ্যাত লেগ স্পিনার এরিক হলিসের বলে শূন্য রানে ফিরেছিলেন তিনি। টেস্টটা ইনিংস ও ১৪৯ রানে জিতলেও ব্র্যাডম্যান আটকে রইলেন ৯৯.৯৪ গড়ে।

ইতিহাস রচনা হলো। ছবি: টুইটার
ইতিহাস রচনা হলো। ছবি: টুইটার

মেয়েরা খেলল লর্ডসে

১৯৭৩ সালেই ইংল্যান্ডে মেয়েদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের নারী ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে তখন সে দেশের মেয়েদের ক্রিকেট হতো। ইংল্যান্ডের নারী দলের অধিনায়ক ছিলেন র‌্যাচেল ফ্লিন্ট। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সে বিশ্বকাপের ফাইনাল ইংল্যান্ড খেলেছিল এজবাস্টনে। তবে নারী ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন চেয়েছিল খেলাটা হোক লর্ডসে। কিন্তু ক্রিকেটের আইনপ্রণেতা সংস্থা মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) তাতে রাজি ছিল না। ১৯৭৪ সালেও একবার ইংলিশ নারী ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন লর্ডসে খেলার অনুমতি চেয়ে পায়নি। তাদের সে অপেক্ষার অবসান হয় ১৯৭৬ সালের ৪ আগস্ট। লর্ডসে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ওয়ানডে খেলতে নামে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার নারী দল।

এখনো মনে আছে সবার। ছবি: ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া
এখনো মনে আছে সবার। ছবি: ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া

মাঠে মুখোমুখি ডেনিস লিলি–জাভেদ মিয়াঁদাদ

১৯৮১ সালে অস্ট্রেলিয়া সফর করে পাকিস্তান দল। এমনিতেই মাঠের লড়াইয়ের পাকিস্তান পেরে উঠছিল না, তারওপর জাভেদ মিয়াঁদাদের অধিনায়কত্ব নিয়ে পাকিস্তান দলের মধ্যে ছিল প্রচণ্ড কোন্দল। পার্থে একটি টেস্টে পাকিস্তান অলআউট হয় ৬২ রানে। এক পর্যায়ের ২৬ রানে ৮ উইকেট হারিয়েছিল পাকিস্তান দল। সে টেস্টেই ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম লজ্জাজনক দৃশ্যের অবতারণা করেন অস্ট্রেলীয় পেসার ডেনিস লিলি ও পাকিস্তান অধিনায়ক মিয়াঁদাদ। একটি সিঙ্গেলস নেওয়ার সময় লিলি মিয়াঁদাদের দৌড়ানোর পথ আগলে রাখলে 'বড়ে মিয়া' যান খেপে। রীতিমতো ব্যাট নিয়ে তেড়ে আসেন লিলির দিকে। অস্ট্রেলীয় ফাস্ট বোলারও মুষ্টিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেন দুই মুঠো মিয়াঁদাদের দিকে বাড়িয়ে। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া ১৮০ রানে গুটিয়ে গেলেও পাকিস্তান অলআউট হয় ৬২ রানে। অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংসে ৪২৪ রান করলে পাকিস্তানের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ৫৪৩ রানের। ২৬২ রানে হারে পাকিস্তান।

ক্রিকেটের চেতনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল এ ঘটনা। ফাইল ছবি
ক্রিকেটের চেতনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল এ ঘটনা। ফাইল ছবি

ট্রেভর চ্যাপেলের আন্ডার আর্ম বোলিং

ম্যাচ পাতানো কিংবা বল টেম্পারিংয়ের মতোই হইচই হয়েছিল সে ঘটনাটি নিয়ে। এটিও ১৯৮১ সালের ঘটনা। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্ব সিরিজ টুর্নামেন্টের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়েছিল মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) সে সময়কার রেকর্ড ৫২ হাজার ৯৯০ দর্শকের সামনে। তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ খেলাটির শেষ বলে ম্যাচটি টাই করতে নিউজিল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল ৬ রান। বোলিংয়ে ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক কোচ ট্রেভর চ্যাপেল। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক, ট্রেভরের বড় ভাই গ্রেগ কোনো সুযোগই দিলেন না কিউইদের। ভাইকে বললেন গড়িয়ে বল করতে। সে সময় গড়িয়ে বল করা বা আন্ডারআর্ম বোলিং ছিল ক্রিকেটীয় আইনের বড় একটা ফাঁক। গ্রেগ সেই ফাঁক ব্যবহার করেন। নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যান ছিলেন ব্রায়ান ম্যাককিন। ঘটনাটি আলোড়ন তুলেছিল খেলার দুনিয়ায়। অস্ট্রেলিয়া–নিউজিল্যান্ডের কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব

আধুনিক ফিল্ডিংয়ের সূচনা। ছবি : টুইটার
আধুনিক ফিল্ডিংয়ের সূচনা। ছবি : টুইটার

উড়ে এলেন জন্টি রোডস

১৯৯২ বিশ্বকাপ। ব্রিসবেনে দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি পাকিস্তান। ক্রিকেট বিশ্ব তখনো ঠিক পুরোপুরি চিনে উঠতে পারেনি জন্টি রোডস নামের এক অসাধারণ ফিল্ডারকে। ব্যাটসম্যানের আশেপাশে দাঁড়িয়ে তাঁর অদ্ভুত ফিল্ডিং তখন সবে মুখে মুখে ফিরছে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে ইনজামাম–উল–হককে উড়ে গিয়ে রান আউট করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন জন্টি। সূচনা হয় ক্রিকেট ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়ের। ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকার সাংবাদিক ভিভি কৃষ্ণানের তোলা এই ছবিটিই এখানে ব্যবহার করা হলো।

অবিশ্বাস্য এক গল্প লিখল বাংলাদেশ। ফাইল ছবি
অবিশ্বাস্য এক গল্প লিখল বাংলাদেশ। ফাইল ছবি

ডেভিডদের গোলিয়াথ বধ

রূপকথা গল্পে ১৭ বছর বয়সী বালক ডেভিডের হাতে দৈত্য গোলিয়াথের পরাভূত হওয়ার ঘটনা আছে। ক্রিকেট ইতিহাসেও এক ম্যাচ হার মানায় সে রূপকথাকেও। গল্পে তো তাও লেখক কল্পনার আশ্রয় নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু ২০০৫ সালের ১৮ জুন কার্ডিফে বাংলাদেশের পক্ষে কোনো ভালো কিছু কল্পনা করারও সাহস ছিল না কারও। সে সময়কার মহাপরাক্রমশীল অস্ট্রেলীয় দলের বিপক্ষে ম্যাচ। ক্রিকেটে তখন বড় ব্যবধানে হারাটাই ভবিতব্য বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের। কার্ডিফে সেদিন রূপকথাকেও হার মানিয়েছিল বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়াকে ৫ উইকেটে হারিয়ে তর্কসাপেক্ষে ক্রিকেটে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটনটারই জন্ম দিয়েছিল হাবিবুল বাশারের দল। সেঞ্চুরি করে এক হাতেই অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল।

বিদায় টেন্ডুলকার। ফাইল ছবি
বিদায় টেন্ডুলকার। ফাইল ছবি

বিদায় নিলেন কিংবদন্তি

২৪ বছরের ক্যারিয়ার। অনেক ক্রিকেট দর্শকের দৈনন্দিন অভ্যেসেরই অংশ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সময়ের নিষ্ঠুর ফেরে একদিন তাঁকেও খেলা ছাড়তে হলো। হ্যাঁ, শচীন টেন্ডুলকারের কথাই বলা হচ্ছে। ২০১৩ সালের নভেম্বরে নিজ শহর মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে জীবনের শেষ ইনিংসে ব্যাটিং করতে নামলেন ওয়ান্ডার বয় থেকে লিটল মাস্টার, এরপর ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠা টেন্ডুলকার। কিংবদন্তিকে মুম্বাই কেবল নয়, গোটা ক্রিকেট দুনিয়াই বিদায় জানিয়েছিল দারুণ আবেগে, হৃদয়ের সব ভালোবাসা নিংড়ে দিয়ে।

রাজপুত্রের রাজ্য ফিরে পাওয়া। ফাইল ছবি
রাজপুত্রের রাজ্য ফিরে পাওয়া। ফাইল ছবি

ব্রায়ান লারার '৪০০*'

২০০৪ সালের এপ্রিল। ঠিক দশ বছর আগেই অ্যান্টিগায় গ্যারি সোবার্সের ৩৬ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহটা নিজের করে নিয়েছিলেন। কিন্তু ছয় মাস আগে সেই রেকর্ডটা হারিয়ে ফেলেন ম্যাথু হেইডেনের কাছে। কিন্তু ক্রিকেটের রাজপুত্র সেন্ট জোনসে আবারও রাজকীয়ভাবে ফেরেন। ক্রিকেটের ধ্রুপদী সংস্করণে নিজের নামের পাশে লেখেন '৪০০'। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের আগের ৩ টেস্টে ক্যারিবীয় তারকার সাকল্যে রান ছিল ১০০। কিন্তু সেন্ট জোনসে সব হিসাব–নিকাশ পাল্টে দেন তিনি, জিনিয়াসরা তো এমনই হন।

পাকিস্তানের ক্রিকেটের কালো দিন। ফাইল ছবি
পাকিস্তানের ক্রিকেটের কালো দিন। ফাইল ছবি

এমন দিনও দেখতে হয়েছিল ক্রিকেটকে

২০০৯ সালের মার্চ। ক্রিকেট দুনিয়া এমন এক ঘটনার সাক্ষী হলো, যেটির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কথাও কেউ কোনো দিন ভাবেনি। পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে যাওয়ার পথে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট দলের বাস শিকার হলো রক্তক্ষয়ী এক সন্ত্রাসী হামলার। বন্দুকধারীরা এলোপাতারি গুলি চালালো কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনে, তিলকরত্নে দিলশান, থিলান সামারাবীরা, মুত্তিয়া মুরলিধরনদের ওপর। ক্রিকেটাররা সামান্য আঘাত পেলেও এই ঘটনায় নিরাপত্তারক্ষীসহ নিহত হলেন বেশ কয়েকজন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে সন্ত্রাসী হামলার পর গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের মাঠে সামরিক হেলিকপ্টার। লঙ্কান দলকে সে হেলিকপ্টারে করেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিমানবন্দরে দেশের ফ্লাইট ধরাতে। এই একটি ঘটনাই এক দশকের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে পাকিস্তানের মাটি থেকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছিল।