মুম্বাই বিমানবন্দরে ৭২দিন আটকা, যেন সিনেমার গল্প

মুম্বাই বিমানবন্দরে আটকা পড়েছিলেন জুয়ান মুলার। ছবি: এএফপি
মুম্বাই বিমানবন্দরে আটকা পড়েছিলেন জুয়ান মুলার। ছবি: এএফপি

করোনাভাইরাস মহামারি অনেক মানবেতর গল্পের জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে মুম্বাই বিমানবন্দরে জন্ম হলো অন্যরকম এক গল্পের। হলিউডে 'দ্য টার্মিনাল' সিনেমার সঙ্গে অনেকেই এ ঘটনার মিল খুঁজে পেতে পারেন।

র‌্যান্ডি জুয়ান মুলার। ঘানার ২৩ বছর বয়সী ফুটবলার। গত বছরের নভেম্বরে ছয় মাসের ভিসায় গিয়েছিলেন ভারতে। কেরালার ওআরপিসি স্পোর্টস ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি সবকিছু গুবলেট করে দেয়। দেশে ফেরার চেষ্টা করেও পারেননি। লকডাউনের কারণে মুম্বাই বিমানবন্দরে টানা ৭২ দিন কেটেছে মুলারের।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি আলোচনার ঝড় তুললে শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে রেহাই মেলে মুলারের। তাঁর এই অবস্থা জানতে পারেন মহারাস্ট্রের পর্যটন ও পরিবেশ মন্ত্রী আদিত্য থ্যাকারে। 'মুম্বাই মিরর' জানিয়েছে গত বুধবার বান্দ্রার একটি হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মুলারকে।

গত ২১ মার্চ থেকে মুম্বাই বিমানবন্দরের ২ নম্বর টার্মিনালে অবস্থান করছিলেন মুলার। বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মী ও স্টাফদের সহায়তায় দিন পার করছিলেন তিনি। টাকা ফুরিয়ে আসার পর বিমানবন্দরের কর্মীদের দেওয়া সমুচা ও ফ্রায়েড রাইস খেয়ে ক্ষুধা মিটিয়েছেন ঘানার কুমাসি থেকে উঠে আসা এ ফুটবলার। সেখানকার শৌচাগারে গোসল ও কাপর পরিষ্কারের পাশাপাশি বাগানে ঘোরাঘুরি ও বই পড়ে সময় কেটেছে মুলারের।

সংবাদমাধ্যমকে মুলার বলেন, 'ভারতে ছয় মাসের ভিসায় এসেছিলাম। মাচ প্রতি ২ থেকে ৩ হাজার রুপি পাওয়ার কথা ছিল। প্রায় কোনো ম্যাচ না খেললেও এখানে আসার ভিসা ও টিকিট মিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ রুপি খরচ হয়েছে। কিন্তু লকডাউন শুরুর পর বাড়ি ফিরতে চাইলাম। ৩০ মার্চ কেনিয়া হয়ে ঘানার পৌঁছানোর বিমান টিকিট করা ছিল। মুম্বাই একটু আগেভাগেই চলে এসেছিলাম এরপর তো লকডাউন শুরু হলো। আন্ধেরির পুলিশ আমাকে বিমানবন্দরে যেতে বলে কিন্তু এর মধ্যে থাকার কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি।'

ঘানার ফুটবলার র‌্যান্ডি জুয়ান মুলার। ছবি: টুইটার
ঘানার ফুটবলার র‌্যান্ডি জুয়ান মুলার। ছবি: টুইটার

মুলার এরপর বিমানবন্দরে থেকে যাওয়ার প্রেরণা পেয়েছেন স্টিভেন স্পিলবার্গের সিনেমা 'দ্য টার্মিনাল' থেকে। ইরানি এক শরণার্থী করিমি নাসেরির ফ্রান্সে চার্লস দ্য গল বিমানবন্দরে মানবেতর জীবন নিয়ে ২০০৪ সালে এ সিনেমা বানান তিনি। মুলার বলেন, 'টম হ্যাংকসকে (দ্য টার্মিনাল সিনেমায় মূল চরিত্রে) দেখে প্রেরণা পেয়েছি। সকালে উঠে গোসল সেরে বিমানবন্দরের বাগানে হাঁটাহাঁটি করতাম। স্টাফ ও নিরাপত্তাকর্মীরা আমাকে খাবার ও টাকা দিয়েছে। কিন্তু বিমানবন্দরে চড়া মূল্যের কারণে টাকা বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নেই। প্রতিদিন প্রায় একই রুটিন ছিল। আকাশ দেখেছি। জরুরি অবস্থার উড়োজাহাজগুলোর ওড়া দেখে স্বপ্ন দেখেছি একদিন আমিও উড়তে পারব।'

আপদকালীন সময়ে উড়োজাহাজে ওঠা অনেক যাত্রী এ সময় মুলারকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন। বই পেয়েছেন তাঁদের কাছ থেকে। মুলার জানান, 'এক যাত্রীর কাছে থেকে 'বি ইয়োর ওউন থেরাপিস্ট' বইটি পাই। এটি আমার হতাশা দূর করতে সহায়তা করে।' মুম্বাই বিমানবন্দরে কোনো হয়রানির শিকার হননি বলে জানিয়েছেন মুলার, 'সিআইএসএফ (ভারতের শিল্পাঞ্চল নিরাপত্তারক্ষী) শুরুতে আমার বিমানবন্দরে থাকা পছন্দ করেনি। তাদের কোনো দোষ নেই। এখানে সবাই খুব ভালো ব্যবহার করেছে। রাতে ঠান্ডা লাগায় বালিশ ও কম্বল পেয়েছি তাদের কাছ থেকে। বিমানবন্দরে প্রচুর জায়গা বদল করে ঘুমিয়েছি।'

বিমানবন্দর থেকে বের হওয়া নিয়েও কথা বলেন মুলার, 'সিআইএসএফ এবং বাকি স্টাফরা আমাকে আর টাকা ও খাবার দিতে পারছিল না। তারা টুইট করতে বলে। টুইট করার পর এখান থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে সিআইএসএফ থেকে একটি ফোন পেয়েছিলাম।'

যুব সেনার রাহুল কানাল মুলারকে বান্দ্রার লাকি হোটেলে নিয়ে যান। রাহুল জানান, 'আদিত্য থ্যাকারে এ ঘটনার জানার পর তাকে সাহায্য করতে বলেন। তিনি মুম্বাই ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনেরও সভাপতি। আমরা তাকে কাপড় ও খাবার দিয়েছি। তার দেশে ফেরার জন্য টাকার ব্যবস্থা করা হবে।' ঘানা হাই কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে মুলারের। জরুরি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে তাকে দেশে ফেরানো হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে ঘানা হাই কমিশন।