'শত্রু'র লড়াইটাই পছন্দ তামিমের

আক্রমণাত্মক তামিমের প্রিয় হলে প্রতিপক্ষকেও আক্রমণাত্মক হতে হয়। প্রথম আলো ফাইল ছবি
আক্রমণাত্মক তামিমের প্রিয় হলে প্রতিপক্ষকেও আক্রমণাত্মক হতে হয়। প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রতিপক্ষ কখনো দুর্বল হয়, কখনো হয় প্রবল। হয় প্রিয়-অপ্রিয়ও। কিছু প্রতিপক্ষের বিপক্ষে মাঠে নামাটা যেন নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতা। আবার কোনো কোনো প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলতে একটু বেশিই পছন্দ করেন খেলোয়াড়েরা। বাংলাদেশ দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের প্রিয় প্রতিপক্ষ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনে আজ জানুন তামিম ইকবালের প্রিয় প্রতিপক্ষের কথা—

এ রকম অভিজ্ঞতা তামিম ইকবালের আগে হয়নি। ব্যাটিং করতে নেমেছেন, আর শুরু থেকেই কিনা কেমার রোচ বল করতে লাগলেন থার্ডম্যান ওপরে তুলে!

গত বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজের ঘটনা। তামিম স্মৃতি হাতড়ে ফিরে যান সেই ম্যাচে, ‘কেমার রোচ আমাকে বোলিংই শুরু করে থার্ডম্যান ওপরে নিয়ে এসে। ৫০ ওভারের ম্যাচে শুরু থেকেই থার্ডম্যান ওপরে এনে বল করতে আপনি কোথাও দেখবেন না। কিন্তু ওদের লক্ষ্য ছিল, অফ স্টাম্পের বাইরে আমাকে কোনো সুযোগই না দেওয়া।’

প্রসঙ্গটা এল তামিমের প্রিয় প্রতিপক্ষ নিয়ে আলোচনায়। অবশ্য বাংলাদেশ দলের এই ওপেনারের প্রিয় প্রতিপক্ষের তালিকাটা একটু লম্বাই। কেমার রোচদের কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেমন সেখানে আছে; আছে ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ডও। প্রিয় প্রতিপক্ষ নিয়ে তামিমের দর্শন এ রকম, ‘যেসব দল আক্রমণ করে বেশি, তাদের বিপক্ষে খেলতেই আমার বেশি ভালো লাগে। যেমন অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড। অনেক সময় ছোট দলগুলোও আক্রমণাত্মক বোলিং করে, ফিল্ডিংটা আক্রমণাত্মক সাজায়। আমি এ রকম চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করি। অনেক দল খুব রক্ষণাত্মক থাকে। তাদের সঙ্গে খেলাটা বেশি উপভোগ করি না।’

আক্রমণাত্মক প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলায় একটা ইঁদুর-বিড়াল লড়াই থাকে। তামিম যে শট খেলতে ভালোবাসে, ওটা ঠেকাও। অথবা ওই শট খেলার প্রলোভন দেখিয়েই তাকে ফেরানোর ফাঁদ তৈরি করো। আবার তামিমের দিক থেকেও থাকে পাল্টা লড়াইয়ের প্রতিজ্ঞা। যেভাবেই হোক প্রতিপক্ষের ফাঁদে পা না দিয়ে নিজের খেলাটা বের করে নিতে হবে। এসব লড়াইয়ে কখনো তামিম জেতেন, কখনো জেতে প্রতিপক্ষ। কিন্তু লড়াইটা তামিম বরাবরই উপভোগ করেন, ‘প্রতিপক্ষ আক্রমণাত্মক হলে দেখা যায় স্লিপ, গালি রেখে কঠিনভাবে ফিল্ডিং সাজায়, আক্রমণাত্মক বোলিং করে। শরীরী ভাষাও থাকে অন্য রকম। আমার তখন চ্যালেঞ্জ থাকে, কীভাবে তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়া যায়। প্রতিপক্ষ যে দলই হোক, আমি এই চ্যালেঞ্জই উপভোগ করি। তাতে কখনো প্রতিপক্ষ সফল হয়, কখনো আমি।’

স্মৃতি হাতড়ে তামিম ফিরে গেলেন সে রকম দুটি টেস্টে, যেখানে প্রতিপক্ষের সব আক্রমণ ছিন্ন করে সফল হয়েছিলেন তিনি। প্রথমে বললেন ২০১৭ সালের আগস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মিরপুর টেস্টের কথা, ‘সম্ভবত দ্বিতীয় ইনিংসে, ওরা লেগের দিকে ফিল্ডিং সাজিয়ে আমাকে উইকেট বরাবর বল করছিল। বাংলাদেশের উইকেট তো একটু মন্থর। একটু পুশ করতে চাইলেই বল ওপরে উঠে যায়। প্যাট কামিন্সের মতো বোলার যদি টানা ওভাবে বল করে যায় এবং ও রকম একটা লড়াই জিতে আপনি ওদের পরিকল্পনা বদলাতে বাধ্য করতে পারেন, সেটা খুবই আনন্দের হয়।’ তামিম যে দুই ইনিংসেই সে রকম আনন্দ পেয়েছিলেন, তাঁর প্রমাণ আছে টেস্টের স্কোরকার্ডেই। বাংলাদেশের ২০ রানে জেতা সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসে তামিম করেন ৭১ রান, দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৮।

অন্য ঘটনাটি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গত বছর হ্যামিল্টন টেস্টে। বাংলাদেশ ম্যাচটা হারলেও ওই কন্ডিশনে তামিমের ১২৬ ও ৭৪ রানের ইনিংস দুটি লড়াইয়ের ভেতর থাকা লড়াইগুলোতে ঘোষণা করছে তাঁর নিরঙ্কুশ জয়। বিশেষ করে প্রথম ইনিংসে কিউই পেসার নিল ওয়াগনারের সঙ্গে দারুণ জমে উঠেছিল লড়াইটা। এত দিন পরও সে কথা বলতে গিয়ে রোমাঞ্চিত তামিম, ‘আমরা জানি, ওয়াগনার একটার পর একটা বাউন্সার দিতে পছন্দ করে। অন্যদিকে আমি ব্যাটিংয়ে খুব বেশি কিছু পরিবর্তন করতে পছন্দ করি না। কিন্তু ওই ইনিংসে আমি অনেক সময় ৬ নম্বর স্টাম্পে গার্ড নিয়েও ব্যাট করেছি। আবার অফ স্টাম্পের ওপর দাঁড়িয়েও খেলেছি। ওর প্রত্যেকটা বল আমি চেজ করছিলাম।’

ওয়াগনারকে লক্ষ্য স্থির করতে না দিতেই ওই কৌশল ছিল তামিমের, ‘আমার মনে হচ্ছিল ও বাউন্সারই মারবে। কিন্তু আমি যদি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকি, তাহলে ওর জন্য টার্গেট করাটা সহজ হয়ে যাবে। আমি নড়াচড়া করতে থাকলে ওর কাজটা কঠিন হতে পারে।’ এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কথার তির ছোড়াছুড়িও হয়েছে মাঠে। তামিম বারবার স্ট্যান্স বদলানোয় ওয়াগনার একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি কতক্ষণ এটা করবে?’ তামিমের জবাব ছিল, ‘আজ আমি এটা করতেই থাকব...।’ দুজনের অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছিলেন নিউজিল্যান্ডের অন্য খেলোয়াড়েরা।

প্রিয় প্রতিপক্ষ মানে তাই শুধু সহজ প্রতিপক্ষই নয়, যার বিপক্ষে খেলতে নামবেন আর হাসতে হাসতে সেঞ্চুরি-উইকেট তুলে নেবেন। প্রিয় প্রতিপক্ষ সে-ও, যে ‘শত্রু’ চোখে চোখ রেখে কথা বলে। হার-জিত সেখানে বড় নয় বটে, তবে জিতে গেলে আনন্দটা হয়ে যায় তুলনাহীন।