কেন মরিয়া হয়ে খেলোয়াড় বিক্রি করতে চাচ্ছে বার্সেলোনা?

ক্লাবের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থই প্রাধান্য পাচ্ছে বার্তেমেউর কাছে। ছবি: এএফপি
ক্লাবের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থই প্রাধান্য পাচ্ছে বার্তেমেউর কাছে। ছবি: এএফপি

আর্থুর মেলো বার্সেলোনা ছেড়ে জুভেন্টাসে যাচ্ছেন, ইউরোপের দলবদলের বাজারে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে এ কথা। এমনকি ব্যক্তিগত চুক্তিটাও নাকি হয়ে গেছে আর্থুরের। শুধু তাঁর বদলে মিরালেম পিয়ানিচের বার্সেলোনায় যাওয়ার চুক্তিটা পাকা হয়ে গেলেই নাকি ঘোষণা চলে আসবে। এই দলবদলে জুভেন্টাসের লাভ দেখলেও বার্সেলোনার আপাত কোনো দীর্ঘমেয়াদী লাভ খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ। কিন্তু মরিয়া হয়ে এই দলবদল করতে চাওয়া বার্সেলোনার বোর্ডের চিন্তা ভিন্ন।

খেলোয়াড় কেনাবেচায় কিছু নিয়মের ফাঁক ব্যবহার করে ক্লাবগুলো আয় ব্যয় সমন্বয় করে নেয়। কোনো অর্থ বছরে আর্থিকভাবে সমস্যায় পড়লে হিসাব বিজ্ঞানের ছোটখাট সূত্র প্রয়োগ করে বিপদ সামলে নেন অনেকেই। আর্থার-পিয়ানিচের এই দলবদলে দুই দলই কাগজে-কলমে প্রায় ৬০ মিলিয়ন ইউরো লাভ করতে যাচ্ছে । কিন্তু গত মৌসুমে শত কোটি ইউরোর বেশি আয় করা বার্সেলোনাকে কেন তাড়াহুড়ো করে খেলোয়াড় বিক্রি করতে হচ্ছে? কেনই-বা মেসির চোখে 'নতুন জাভি'কে বিক্রি করে হলেও আয় বাড়াতে হচ্ছে?

এর পেছনে স্প্যানিশ লিগের নব্বই দশকের ইতিহাসে নজর দিতে হবে। ১৯৯০ সালে অধিকাংশ স্প্যানিশ ক্লাবকে করপোরেশন বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। শুধু মাত্র চারটি ক্লাব তখন লাভ দেখেছে। এ কারণে তাদের ক্লাব পরিচয় ধরে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এ চারটি ক্লাব হলো বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, অ্যাথলেটিক বিলবাও এবং ওসাসুনা।

সে সময় আর্থিকভাবে সাবলম্বী হলেও ভবিষ্যতে যেন কক্ষ্চ্যুত না হয় ক্লাবগুলো, সেটা নিশ্চিত করতে চেয়েছে স্প্যানিশ কর্তৃপক্ষ। এ কারণে ক্লাবের বোর্ড পরিচালকদের কাছ থেকে ব্যক্তিগত নিশ্চয়তা (গ্যারান্টি) নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, প্রতি বছর খরচের ১৫ ভাগ ব্যয় তাঁদের বহন করতে হবে। অর্থাৎ প্রতি বছর ক্লাব যে বাজেট করবে, সেটা যদি ক্লাবের আয় থেকে জোগাড় করা সম্ভব না হয় তবে ১৫ ভাগ অর্থ পরিচালকদের ব্যক্তিগত উৎস থেকে কেটে নেওয়ার অধিকার থাকবে ক্লাবের।

এখন ধরা যাক একটি বোর্ড বেশ কয়েক বছর ধরেই ক্লাবের দায়িত্বে আছে। সে ক্ষেত্রে তাদের প্রতি বছর এ চিন্তা না করলেও চলে। যদি দেখা যায়, যে বাজেট করা হয়েছে তার ১৫ ভাগের চেয়ে ওই বোর্ডের পুরো সময়কালে ক্লাবের লাভের পরিমাণ বেশি, তাহলে আর পরিচালকদের এ নিয়ে না ভাবলেও চলে।

বার্সেলোনার বর্তমান বোর্ড ২০১০ সাল থেকে দায়িত্বে আছে। মাঝে শুধু নেইমারের চুক্তি সংক্রান্ত কারণে বোর্ড সভাপতি বদলেছেন। চলমান ২০১৯-২০ মৌসুমে ক্লাবের খরচের যে হিসাব বার্সেলোনা বোর্ড দিয়েছে, সে অনুযায়ী ১০০ কোটি ৭০ লাখ ইউরোর বাজেট করেছিল। এর ১৫ ভাগ হচ্ছে ১৫ কোটি ইউরোর কিছু বেশি। ২০১০-১১ থেকে গত মৌসুম পর্যন্ত বার্সেলোনার বর্তমান বোর্ড লাভ দেখিয়েছে ১৯ কোটি ২০ লাখ ইউরো। তার মানে পরিচালকদের ভাবনার কিছু ছিল না। এ কারণে নতুন মৌসুমের শুরুতে পরিচালকদের কোনো গ্যারান্টি দিতে হয়নি।

কিন্তু করোনাভাইরাস এ মৌসুমে মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে সবার। এরই মাঝে খেলা শুরু হলেও দর্শক ফেরেনি মাঠে। ফলে টিকিট বিক্রির টাকা তো পাচ্ছেই না ক্লাব, সে সঙ্গে ক্লাবের বিভিন্ন আউটলেটের স্মারক বিক্রি থেকে আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে। খেলোয়াড়দের বেতন কমিয়েও ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে পারছে না ক্লাবগুলো। এ মৌসুমে যে আয়ের কথা ভেবে বাজেট করা হয়েছিল, সেটা যে হচ্ছে না তা নিশ্চিত। ফলে যে ক্ষতি হবে, সে অংকটা এত বছর ধরে করা আয় থেকে মিটিয়ে নিতে হবে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, বার্সেলোনা এ মৌসুমে ১৫ কোটি ইউরোর মতো ক্ষতি দেখবে।

২০১০/১১ মৌসুম থেকে ১৯ কোটি ২০ লাখ ইউরো লাভ করা বার্সেলোনা সেটা সামলে নিতে পারবে। কিন্তু বিপদে পড়বে বর্তমান বোর্ড। কারণ, তখন এই বোর্ডের লাভের অংক (৪ কোটি ২০ লাখ) বাজেটের ১৫ শতাংশের নিচে নেমে আসায় বাকিটার জন্য পরিচালকদের ব্যক্তিগত গ্যারান্টি দিতে হবে। আর যদি পরের মৌসুমেও করোনার কারণে লাভ নয় ক্ষতি দেখতে হয় বার্সেলোনাকে তখন বাজেটের ১৫ ভাগ নিজেদের 'পকেট' থেকে দিতে হবে বোর্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হর্তাকর্তাদের।

ফলে বার্সেলোনার আয় বাড়ানোটা এখন আর শুধু ক্লাবের ভালোর জন্য নয়, বার্তেমেউ ও তাঁর সঙ্গীদের ব্যক্তিগত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত এই বোর্ডের মেয়াদ আছে। ফলে সে সময়টা পার করে দেওয়ার দিকেই নজর তাঁদের। নিজেদের এই বিপদ থেকে বাঁচাতে তাই সব রকম চেষ্টাই করছেন তাঁরা। এর দুটি উপায় আছে; এক, আগামী মৌসুমের (২০২০/২১) বাজেট কমিয়ে আনা। ধরা যাক, ক্লাবের বাজেট ১০০ কোটি থেকে ৮০ কোটিতে নামিয়ে আনল বোর্ড। সে ক্ষেত্রে এর ১৫ শতাংশ দাঁড়াবে ১২ কোটি। তখন এ মৌসুমে ৭ কোটি ২০ লাখ আর্থিক ক্ষতি হলেও সমস্যা হবে না বোর্ডের। কিন্তু বার্সেলোনার খেলোয়াড়দের বেতন ইউরোপে সবচেয়ে বেশি। তাই হুট করেই ক্লাবের বাজেট এতটা কমিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব।

দ্বিতীয় উপায় হলো, বর্তমান মৌসুমের খরচ কমিয়ে আনা। অগ্রিম লাভের ব্যবস্থা করা ও বর্তমানের ব্যয় ভবিষ্যতে পাঠিয়ে দেওয়া। এ কারণেই আর্থুর-পিয়ানিচ দলবদলটা কাজে লাগবে বার্সেলোনার। এই দলবদলে এক দিকে যেমন ৬ কোটি ইউরোর লাভ দেখানো যাবে, অন্যদিকে পিয়ানিচের জন্য ব্যয় করা ৭ কোটি ইউরোও চুক্তির পাঁচ বছরে ভাগ হয়ে যাবে। ফলে আগামী মৌসুমে খরচের অংকে মাত্র ১ কোটি ৪০ লাখ ইউরো যোগ হবে।

দীর্ঘমেয়াদে মাঠের পারফরম্যান্স কিংবা আর্থিক দিক থেকে বার্সেলোনার এতে কোনো লাভ হবে না। কিন্তু বর্তমান বোর্ডের কর্তারা নিজেদের পকেটের টাকা বাঁচাতে পারবেন। এতে ক্লাব হিসেবে বার্সেলোনার ক্ষতি হলেও বর্তমান বোর্ড তো লাভবান হবে। ক্লাবকে বিপদে ফেলে নিজেদের লাভের দিক দেখার অভিযোগ এই বোর্ডের বিরুদ্ধে অনেক আগেই উঠেছে। করোনাভাইরাস বিপর্যয় একটু নগ্নভাবেই বিষয়টি সবার সামনে এনে দিয়েছে।