রাগবিতে বাংলার মুখ আলিশা

চোখে স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন আলিশা। সংগৃহীত ছবি
চোখে স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন আলিশা। সংগৃহীত ছবি
>

বাবা টাঙ্গাইল-৬ আসনের সাংসদ। মা থাইল্যান্ডের মানুষ। এই দম্পতির কন্যা আলিশা ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা শেষে এখন বাংলাদেশ নারী রাগবি দলের অধিনায়ক।

নব্বইয়ের দশকের মাঝপথে থাইল্যান্ডে পড়তে যান বাংলাদেশের এক তরুণ। সেখানে অ্যাজাম্পসন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ার সময় পরিচয় থাই তরুণী আইরা সোয়াইংসআরাসামের সঙ্গে। অতঃপর প্রণয় ও বিয়ে। বিদেশে পড়তে গিয়ে কাউকে ভালো লাগা, বিয়ে—এমন তো কতই হয়। তা খেলার সঙ্গে এই গল্পের সম্পর্ক কী?

সম্পর্ক হলো, এই আসহানুল ইসলাম-আরিয়া ইসলাম দম্পতির তিন সন্তানের একজন আজ বাংলাদেশের জাতীয় নারী রাগবি দলের অধিনায়ক। খেলাটা বাংলাদেশে নতুন হতে পারে, তবে একটি খেলার জাতীয় দলের অধিনায়ক হওয়াটা বড় অর্জন তো বটেই। আলিশা ইসলাম তাই নিজেকে গর্বিত ভাবেন।

আলিশার জন্ম ১৯৯৮ সালে, ব্যাংককে। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় বোনের পর আলিশা, এরপর ছোট ভাই। আলিশা শুধু বাংলাদেশ নারী রাগবি দলেরই অধিনায়ক নন, লেবেল ওয়ান কোচিং কোর্স করে বাংলাদেশ রাগবির ডেভেলপমেন্ট অফিসারও। বাবা আহসানুল ইসলাম বর্তমানে টাঙ্গাইল-৬ আসনের সাংসদ। দাদা সাবেক সাংসদ হাজি মকবুল হোসেন। গত রোজার ঈদের দিন করোনায় দাদাকে হারিয়ে আলিশা এখনো বেদনাহত, 'দাদা খুব ভালোবাসতেন আমাকে। তিনি এভাবে চলে যাবেন, ভাবিনি।'

বাংলাদেশের প্রথম নারী রাগবি দলের অধিনায়ক হয়ে যাবেন, আলিশার ভাবনার বাইরে ছিল সেটিও। রাগবির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ২০১৪-১৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের টেম্পল ইউনিভার্সিটি ফিলাডেলফিয়ায় বিবিএ পড়ার সময়। রাগবির দেশে গিয়ে রাগবির প্রেমে পড়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয় দলে নিয়মিত খেলেন। ২০১২-১৪ ব্যাংকক পাতানা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ার সময় ফুটবল, বাস্কেটবল ও টেনিস খেলতেন। কারাতে আর কিক বক্সিংও করেন।

জন্ম থাইল্যান্ডে হলেও আলিশার প্রাথমিক পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশেই। বিদেশে অনেক বছর কাটিয়েও তাই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কটা গভীরই আছে। তবে একটা সময় পর্যন্ত আলিশা জানতেনই না যে বাংলাদেশেও রাগবি খেলা হয়, 'যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা শেষ করি ২০১৮ সালে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফিরেও জানতাম না বাংলাদেশে রাগবি খেলা হয়। একদিন পত্রিকার দেখলাম রাগবির একটি টুর্নামেন্ট হচ্ছে। এটায় খেলা হয়নি। তবে পয়লা বৈশাখের একটা টুর্নামেন্টে প্রথমবার খেলা হয়েছে।'

পরিবারের সঙ্গে আলিশা। সংগৃহীত ছবি
পরিবারের সঙ্গে আলিশা। সংগৃহীত ছবি

দেশে এখন পর্যন্ত দুটি ঘরোয়া টুর্নামেন্টে খেলেছেন আলিশা। গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নারী রাগবিতে সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন। তবে ফাইনালে আলিশার দল টাঙ্গাইল ঠাকুরগাঁয়ের কাছে ৫-১০ পয়েন্টে হেরে যায়। টুর্নামেন্টে ১৬টি দলের অংশগ্রহণ দেখে উচ্ছ্বসিত আলিশা বলছিলেন, 'মেয়েরা ওই টুর্নামেন্টে ২০০ ভাগ দিয়েছে মাঠে। আমার উৎসাহ অনেক বেড়েছে। জানতাম না বাংলাদেশে এত বড় রাগবি পরিবার আছে। টাকা নেই, তবে সবাই খেলাটা খুব ভালোবাসে।'

সেই ভালোবাসার কল্যাণেই আলিশা আসার পর গত বছর বাংলাদেশ জাতীয় নারী রাগবি দল গঠিত হয়। রংপুরের ক্যাম্পে অংশ নেন আলিশাও। গত আগস্টে দলটি ইন্দোনেশিয়ায় প্রথম কোনো টুর্নামেন্টে অংশ নেয় (এশিয়ান কোয়ালিফাইং রাউন্ড, সেভেন 'এ' সাইড )। চীনা তাইপের সঙ্গে ম্যাচে ১০-১০ পয়েন্টে ড্র আর বাকি তিনটিতে হার। তবে ফল নয়, খেলাটাই সেখানে বড় ছিল বাংলাদেশের রাগবি–কন্যাদের জন্য।

রাগবি ১৫-'এ' সাইড জাতীয় দল এখনো হয়নি বাংলাদেশে। সেভেন 'এ' সাইড অনেকটা ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টির মতো। ৭ মিনিট করে দুই অর্ধ। ১৫-'এ' সাইড ৮০ মিনিটের খেলা। আলিশার বেশি ভালো লাগে সেভেন 'এ' সাইড। কিন্তু তিনি তো চাইলে থাইল্যান্ডের হয়েও খেলার চেষ্টা করতে পারতেন! সেটি করেননি কেন? থাইল্যান্ডে রাগবির প্রসার আছে, ভবিষ্যৎ অনেক ভালো। ২২ বছর বয়সী তরুণী আলিশা কিছুটা অনভ্যস্ত বাংলায় বলছিলেন, 'বাংলাদেশকে আমি ভালোবাসি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরলে বাবা বলেন, ঢাকায় রাগবি ফেডারেশন আছে। চাইলে এখানে খেলতে পারো। এভাবেই যোগাযোগ হলো।'

যুক্তরাষ্ট্রে রাগবি খেলাটা দৈনিক তিন বেলা খাবারের মতো। ওখানে খেলেই রাগবির ভিতটা শক্ত হয়েছে আলিশার। দেশে এসে তাই অন্য খেলোয়াড়দের ভিড়ে নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছেন ব্যতিক্রম হিসেবে। রাগবি বাদে তাঁর প্রিয় খেলা ফুটবল ও টেনিস। এর বাইরে গিটার বাজান, ছবি তোলেন। পড়তে বেশি ভালো লাগে মনোবিজ্ঞানের বই। বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মৌসুম আলী বলছিলেন, 'ওকে দেখে অনেক মেয়ে আসছে রাগবিতে। একজন সংসদ সদস্যের মেয়ে রাগবি খেলছে, এটা বিরাট ব্যাপার।'

সব এক পাশে রেখে আলিশার এখন একটাই প্রার্থনা, করোনার দুঃস্বপ্ন দ্রুত শেষ হোক। তাহলেই আবার ফিরতে পারবেন মাঠে। সে কথা ভেবে এখনই রোমাঞ্চিত আলিশার কণ্ঠ, 'ইনশা আল্লাহ আগামী বছর আবার আমরা বিদেশে রাগবি খেলতে যাব।'