শেষ মুহূর্তের হতাশাকাব্য, অতঃপর সম্ভাবনা

এই দশকের শেষদিকে ব্যর্থ হয়েছেন ক্লপও। ছবি : এএফপি
এই দশকের শেষদিকে ব্যর্থ হয়েছেন ক্লপও। ছবি : এএফপি
>

টানা তিন দশক পর আবারও লিগ শিরোপার স্বাদ পেয়েছে লিভারপুল। গত তিরিশ বছর ধরে হাজারো চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আবারও ইংলিশ ফুটবলের রাজা হয়েছে 'অল রেড'রা। দীর্ঘ তিরিশ বছরের এই যাত্রাটা কেমন ছিল? সেটিই জানানোর চেষ্টা করা হয়েছে তিন পর্বের ধারাবাহিকে। আজ পড়ুন শেষ পর্ব 

'ডালগ্লিশ! ডালগ্লিশ!'

এককালে এই শ্লোগান শুনলে রক্ত টগবগিয়ে উঠত কেনি ডালগ্লিশের। পেতেন আরও ভালো খেলার অনুপ্রেরণা। প্রতিপক্ষও বুঝতে পারত, স্কটিশ কিংবদন্তিকে আটকে রাখা সম্ভব হবেনা। খেলায় নিজের ছাপ রাখবেনই, গোল করে বা গোলে সহায়তা করে!

এই শ্লোগান ডালগ্লিশকে পরে অনুপ্রাণিত করে কোচ হিসেবেও। পাঁচ বছর লিভারপুলের কোচ ছিলেন, যার মধ্যে তিন বছরেই জিতেছেন লিগ। আর জয়ের এই ধারার পেছনে অন্যতম ভূমিকা তো দর্শকদেরই, যারা ডালগ্লিশ, ডালগ্লিশ করে চিৎকার করছেন!

দায়িত্ব ছাড়ার ঠিক দুই দশক পর অ্যানফিল্ডে ডালগ্লিশের কানে যখন এই শ্লোগান এল, অনুপ্রাণিত হওয়ার চেয়ে বিব্রত হলেন বেশি। খেলোয়াড় বা ম্যানেজারের নামে শ্লোগান না দিয়ে সাবেক খেলোয়াড়ের নামে এভাবে উচ্চগ্রামে শ্লোগান দেওয়ার অর্থ, মাঠের খেলায় কী হয় না হয়, তাতে দর্শকদের কিছু আসছে যাচ্ছে না। বর্তমান ম্যানেজার রয় হজসনের কাছেও এ ঘটনাটা বিব্রতকর।

লিভারপুল সেদিন নিজের মাঠে উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে ১-০ গোলে হারছিল। ততদিনে ২০১০-১১ মৌসুমের ১৮ ম্যাচে আটবার হেরে ও চারবার ড্র করে লিভারপুল সমর্থকদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে গিয়েছে। হজসনের হাত থেকে প্রিয় ক্লাবের মুক্তি চান তাঁরা। শোনা যাচ্ছিল, পরবর্তী ম্যানেজার হিসেবে ক্লাবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান কেনি ডালগ্লিশ ফিরতে পারেন। তাই এই শ্লোগান।

কিন্তু কী এমন হয়েছিল যাতে হজসনের ওপর এত বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন লিভারপুলের সমর্থকরা? পিছিয়ে যাওয়া যাক ছয় মাস!

মানহীন সব খেলোয়াড়দের পেয়েছিলেন হজসন। ছবি : এএফপ
মানহীন সব খেলোয়াড়দের পেয়েছিলেন হজসন। ছবি : এএফপ

ফুলহামের মতো ক্লাব থেকে নতুন ম্যানেজার আনা হচ্ছে, অনেক লিভারপুল সমর্থক এমনিতেও খুশি ছিলেন না। হোক সে ফুলহাম কয়েকদিন আগেই ইউরোপা লিগের ফাইনাল খেলেছে, টুর্নামেন্টে হারিয়েছে জুভেন্টাসের মতো দলকে–তাতে কী? লিভারপুলের মতো ক্লাবের ম্যানেজার হবেন আরও নামীদামি কেউ।

নতুন ক্লাবের অধিকাংশ সমর্থকের এমন মনোভাবের মাঝেই প্রথম দিনে গুবলেট পাকিয়ে ফেললেন ইংলিশ ম্যানেজার রয় হজসন। জিজ্ঞেস করা হল, ম্যানেজার হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কে?স্বাভাবিকভাবেই, উত্তরে প্রশ্নকর্তা আশা করছিলেন বিল শ্যাঙ্কলি, পাইসলি, জো ফাগান কিংবা কেনি ডালগ্লিশের মতো কোনো লিভারপুল কিংবদন্তির নাম।

হজসন হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, 'আমার প্রিয় কোচ ডেভ সেক্সটন (সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ম্যানেজার) ও ডন রেভি (সাবেক আর্সেনাল ম্যানেজার)।' ব্যস, লিভারপুল সমর্থকদের হজসন-বিদ্বেষের শুরুটা সেখান থেকেই।

বড় ক্লাবে এলেই যে রাতারাতি দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত হয় না, তার উজ্জ্বল উদাহরণ হজসন। লিভারপুলের মতো ক্লাবের সমর্থকদের মন জুগিয়ে চলার কাজটা করতে পারলেন না। অ্যানফিল্ডে দর্শকদের সামনে দলকে খেলানোর অভিজ্ঞতা কেমন, এমন প্রশ্নের জবাবে বলে বসেন, 'সান সিরো (এসি ও ইন্টার মিলানের স্টেডিয়াম) ও ওল্ড ট্রাফোর্ড (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড)ও চমৎকার!'

যখন এসেছিলেন, ক্লাবের অবস্থা টালমাটাল। দেনায় দেনায় জর্জরিত লিভারপুল, নতুন মালিক খোঁজা হচ্ছে পাগলের মতো। নতুন আসা হজসন দল সাজানোর জন্য তেমন টাকা পয়সা পেলেন না। নিয়ে এলেন মাঝারি মানের অনেক খেলোয়াড়। আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার হাভিয়ের মাচেরানো বুঝতে পেরেছিলেন, এই লোকের অধীনে খেলে সময়ক্ষেপণ করার মানে নেই। পাড়ি জমালেন বার্সেলোনায়। দলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিয়ান পার্সলো (যার সঙ্গে ঝগড়া করে বেনিতেজ চাকরি খুইয়েছিলেন) হজসনের আমলেও দলবদল নিয়ে অযাচিত নাক গলানো শুরু করলেন। মাচেরানোর জায়গায় জুভেন্টাসে সুযোগ না পাওয়া মিডফিল্ডার ক্রিস্টিয়ান পোলসেনকে দলে আনলেন।

সাবেক ক্লাব ফুলহাম থেকে এলেন লেফটব্যাক পল কনচেস্কি। তবে আগের ম্যানেজার রাফায়েল বেনিতেজের 'পাপ' এর কিছু বোঝা বইতে হলো হজসনকেও। মিলান ইয়োভানোভিচ, ড্যানি উইলসন, জনজো শেলভি নামের বেশ কিছু অখ্যাত খেলোয়াড়কে দলে আনার কাজ শেষ করে ছাঁটাই হয়েছিলেন বেনিতেজ, ফলে সেসব খেলোয়াড়ে হজসন আসার পর লিভারপুলে যোগ দেন। নিজের পছন্দমতো শুধু দুই মিডফিল্ডার চেলসির জো কোল আর পোর্তোর রাউল মিরেলেসকে পেয়েছিলেন হজসন। ২৮ বছর বয়সী চোটজর্জর কোলকে বিশাল বেতন দিয়ে এনেছিল লিভারপুল। এক রাউল মিরেলেস ছাড়া কেউ সফলতার মুখ দেখেননি।

বোর্ডরুমের অস্থিতিশীলতা স্পর্শ করেছিল মাঠের পারফরম্যান্সকে। বিভিন্ন সময়ে ফর্মহীনতা ও চোটে ভুগেছেন জেরার্ড-তোরেসরা। খেলোয়াড়েরা কোচের কাছে তেমন প্রেরণা পেতেন না। কোচ আর বোর্ডের ওপর সমর্থকেরা এতটাই অসন্তুষ্ট ছিলেন যে, সে 'সুযোগ'টা নিলেন খেলোয়াড়েরা। তাঁরা ভাবতেন, বাজে খেললেও তো দোষ কোচের ওপরেই পড়বে! ফলে এমনও দেখা গেল, স্টোক সিটির মতো দল, যাদের খেলার ধরণ জঘন্য হিসেবে সুবিদিত, তাদের সঙ্গেও খেলতে নেমে হাঁসফাঁস করছে লিভারপুল, বলের দখল রাখতে পারছে মাত্র ৩৬ শতাংশ। একের পর এক ম্যাচ ড্র আর হারের কারণে এক পর্যায়ে দেখা গেল, অবনমনের শঙ্কা পেয়ে বসেছে ক্লাবটাকে।

তাও হয়তো সমর্থকেরা ম্যানেজারের পাশে দাঁড়াতেন, যদি হজসন ক্ষণে ক্ষণে বেফাঁস কথা না বলতেন। বলে বসলেন, 'লিভারপুল এমন কোনো বড় ক্লাব না যারা অবনমনের জন্য লড়াই করবে না!' জানা গেল, হজসনের সহধর্মিণী আবার পাঁড় এভারটন ভক্ত!

ব্যস। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল সমর্থকদের। ততদিনে নতুন মালিক এসে গেছে ক্লাবে। নতুন মালিক এসে প্রথম ম্যাচে ভিআইপি বক্সে বসে দেখলেন নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী এভারটনের বিপক্ষে ২-০ গোলে দলের পরাজয়। 'তুমি মার্সিসাইডের ভুল ক্লাবটা কিনেছো হেনরি,' এক এভারটন সমর্থক চিৎকার করে লিভারপুলের নতুন মালিক জন হেনরিকে জানালেন কথাটা।

আর কয়েকদিনের মধ্যেই ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল হজসনের।

ছয় বছরের ট্রফিখরা কাটালেও চাকরি বাঁচাতে পারেননি ডালগ্লিশ, লিগ ব্যর্থতার কারণে। ছবি : এএফপি
ছয় বছরের ট্রফিখরা কাটালেও চাকরি বাঁচাতে পারেননি ডালগ্লিশ, লিগ ব্যর্থতার কারণে। ছবি : এএফপি

দুই দশক পর দ্বিতীয় দফায় লিভারপুলের কোচ হওয়ার পর ডালগ্লিশের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল রাতারাতি ক্লাবের ভেতর ও বাইরের পরিবেশটা বদলে দেওয়া। খেলোয়াড়দের মধ্যে আবারও উন্নতি করার স্পৃহা দেখা গেল, সমর্থকদের সঙ্গে কোচের সম্পর্ক ভালো হয়ে গেল। ক্লাবের খেলার ধরণও আগের চেয়ে ভালো হলো। তবুও ডালগ্লিশ আমলের সবচেয়ে বড় সাফল্য-ব্যর্থতায় জড়িয়ে আছে লুইস সুয়ারেজের নাম।

ক্লাবের পরিবেশ বদলানোর অপেক্ষা করেননি বহুদিনের যোদ্ধা ফার্নান্দো তোরেস। ২০১১ সালের জানুয়ারির একদম শেষ দিনে চেলসির জার্সি হাতে কোচ কার্লো আনচেলত্তির সঙ্গে যখন ছবির জন্য পোজ দিচ্ছেন, চোখেমুখে অবশেষে ট্রফি জেতার স্বপ্ন। ওদিকে তোরেস-বেচা টাকা দিয়ে দলকে মেরামত করার কাজে নেমে পড়লেন ডালগ্লিশ। আয়াক্স থেকে সুয়ারেজের আসার কথা আগেই পাকা ছিল, এবার তোরেস বিক্রির টাকার ৭০ শতাংশ খরচ করলেন নিউক্যাসলের অ্যান্ডি ক্যারলের পেছনে। সে মৌসুমে অবনমনের হাত থেকে উদ্ধার পেয়ে ষষ্ঠ অবস্থানে লিগ শেষ করা লিভারপুলের উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে ছিলেন সুয়ারেজ। তোরেসের বিকল্প পেয়ে গেছে লিভারপুল, এমন আশা করা হলেও, সুয়ারেজ তাঁর আসল 'খেলা' দেখানো শুরু করলেন পরের মৌসুম থেকে।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্যাট্রিস এভরাকে বর্ণবাদী গালি দিয়ে আট ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হন সুয়ারেজ। ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা না করে সতীর্থের পাশে দাঁড়ান লিভারপুলের খেলোয়াড়েরা, সুয়ারেজের নাম লেখা টি-শার্ট পরে অনুশীলন করেন। আর এই কাজের পেছনে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল কোচ ডালগ্লিশের। তুমুল সমালোচনা শুরু হলো চারদিকে। সুয়ারেজ ফিরে আসার পর আবারও ইউনাইটেডের বিপক্ষে খেলতে নামেন। সবাই ভেবেছিলেন, হয়তো ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন উরুগুয়ের এই তারকা। কিন্তু কীসের কী! এভরার সঙ্গে হাত মেলাতে অস্বীকৃতি জানালেন। ক্লাবের ভাবমূর্তি ঠিকভাবে দেখভাল না করার দায় বর্তালো ডালগ্লিশের ওপরেই। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল লিগের ব্যর্থতা। কিংবদন্তির অধীনে কার্লিং কাপ জিতে শিরোপাখরা কাটলেও লিগ অবস্থানের উন্নতি হচ্ছিল না।

২০১১-১২ মৌসুমে দলকে অষ্টম করা ডালগ্লিশ যখন মালিকপক্ষের তলবে বোস্টনের উড়োজাহাজে চেপে বসলেন, ততক্ষণে ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে তাঁর।

দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলিয়েও হতাশ হতে হয়েছে রজার্সকে। ছবি : সংগৃহীত
দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলিয়েও হতাশ হতে হয়েছে রজার্সকে। ছবি : সংগৃহীত

'ওরা নিশ্চয়ই ভাবছিল, এই দলটাকে নিয়ে যে এত কথা হচ্ছে, এরা আসলেই কী অত ভালো খেলে? আজ ওরা সেটা চোখের সামনে দেখেও নিল। আমরা আসলেই অসাধারণ খেলেছি।'

সাধারণত এমন কথা একজন ম্যানেজার কখন বলেন? যখন তাঁর দল সুন্দর ফুটবল খেলে প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দেয়, তাই তো?

ভুল। এই কথাটা যিনি বলেছিলেন, তাঁর দল সোয়ানসি সিটি তখন মাত্র স্যান্ডারল্যান্ডের মাঠে গিয়ে ২-০ গোলে হেরে এসেছিল। হারা ম্যাচেও দলের খেলা দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন কোচ।

ব্রেন্ডান রজার্স মানুষটা এমনই ছিলেন। দলকে অসাধারণ খেলাতেন তো বটেই, মাঝে মাঝে নিজের দলের খেলা দেখে এমন মুগ্ধ হয়ে যেতেন, গর্ব লুকিয়ে রাখতে পারতেন না। দল জিতল কী হারল তাতে তাঁর তেমন একটা মাথাব্যথা ছিল না। ব্রিটিশ হয়েও দলকে খেলানোর দিক দিয়ে চূড়ান্তমাত্রায় ডাচ বা স্প্যানিশ ছিলেন এই ম্যানেজার। সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন বার্সার যুবদলের খেলা দেখতে, সেভিয়া-ভিয়ারিয়াল বা আয়াক্স-পিএসভির ম্যাচ দেখতে। ম্যাচ দেখে দেখে স্প্যানিশ ও ডাচ ফুটবলের খুঁটিনাটিগুলো মাথায় গেঁথে নিতেন। যার প্রভাব পড়ত সোয়ানসির খেলায়।

নিজেদের ভক্ত তো বটেই, প্রতিপক্ষকেও মুগ্ধ করে দিতেন রজার্স। লিভারপুলের মাঠ অ্যানফিল্ডে এমন এক ম্যাচ শেষে লিভারপুলের দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে রজার্সকে সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন হাততালির মাধ্যমে। তা দেখে লিভারপুলের মালিকপক্ষ এফএসজি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, পরবর্তী কোচ রজার্সই হচ্ছেন।

প্রথম মৌসুমে লিগে সপ্তম হলেও রজার্সের 'স্টাইল' দেখে আশাবাদী হলেন দলটার সমর্থকেরা। বেছে বেছে এমন কয়েকজন খেলোয়াড়কে নিয়ে আসলেন, যারা বল পায়ে রেখে খেলায় বিশ্বাসী। এদের মধ্যে ছিলেন ইতালির স্ট্রাইকার ফাবিও বোরিনি, সোয়ানসির মিডফিল্ডার জো অ্যালেন। পরে আসেন ইংলিশ স্ট্রাইকার ড্যানিয়েল স্টারিজ ও ইন্টার মিলানের বেঞ্চ খেলোয়াড় ফিলিপ কুতিনহো। তবে সবচেয়ে বড় উন্নতি করেন সেই লুইস সুয়ারেজ। স্টারিজের সঙ্গে জুটি বেঁধে আবারও লিভারপুল সমর্থকদের স্বপ্ন দেখানো শুরু করেন পাগলাটে এই তারকা।

এই দুজনের প্রভাবে ভালো খেলা শুরু করেন কুতিনহো আর নবাগত রাহিম স্টার্লিং। ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে চলে এসে যেন নতুন জীবন ফিরে পান দলের কিংবদন্তি অধিনায়ক স্টিভেন জেরার্ড। পাশে তরুণ জর্ডান হেন্ডারসনকে নিয়ে মাঝমাঠ থেকে জাদু দেখানো শুরু করলেন বর্ষীয়ান এই তারকা। দুই স্ট্রাইকারকে একই একাদশে খেলানোর জন্য প্রায়ই বিদঘুটে ছকের সাহায্য নিতেন রজার্স। ফলে সমস্যা হত বাকীদের। ভিক্টর মোজেস, জর্ডান হেন্ডারসন, ফিলিপ কুতিনহোর কেউই এক পজিশনে স্থির থাকতে পারেননি। তবে সুয়ারেজ ও স্টারিজের ফর্ম এতটাই ভালো ছিল, সেগুলো তখন চোখে পড়ত না।

নিরপেক্ষ সমর্থকদের কাছে লিভারপুলের ম্যাচগুলো হতো বিনোদনের অন্যতম প্রধান উৎস। গোল যেমন দিতে পারত, খেতও অনেক। অধিনায়ক জেরার্ডকে ঠিকমতো ব্যবহার করার জন্য তাঁকে পুরোদস্তুর নতুন এক মিডফিল্ডারে পরিণত করলেন রজার্স। আগে জেরার্ড সারা মাঠ দাপিয়ে খেলে বেড়াতেন, এখন আর অতটা পারতেন না। সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থাকার অভ্যাসেও চিড় ধরল। রজার্স বুঝতে পারলেন সেটা। ততদিনে আরেক বয়সী মিডফিল্ডার আন্দ্রেয়া পিরলো জুভেন্টাসে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে সবার মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছিলেন। রজার্স অধিনায়ককে পিরলো বানাতে চাইলেন, যাকে অত বেশি দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না, ট্যাকল বা বল কেড়ে নেওয়ার কাজ করতে হবে না, ও কাজ করার দায়িত্ব রজার্স দিলেন হেন্ডারসন ও লুকাস লেইভাকে। বিনিময়ে জেরার্ড দুই সেন্টারব্যাকের একটু সামনে থেকে তাঁর নিখুঁত পাস দেওয়ার ক্ষমতা কাজে লাগাবেন।

জেরার্ডের এই পুনরুত্থান একইসঙ্গে হলো লিভারপুলের সবচেয়ে বড় আনন্দের ও দুঃখের কারণ।

অবশেষে ইয়ুর্গেন ক্লপ লিভারপুলকে গড়ে তুলেছেন এক পরিবারের মতো। ছবি : এএফপি
অবশেষে ইয়ুর্গেন ক্লপ লিভারপুলকে গড়ে তুলেছেন এক পরিবারের মতো। ছবি : এএফপি

লিভারপুল গোলের পর গোল করতে থাকল। মৌসুমের শেষ ভাগে ১৬ ম্যাচে অপরাজিত থাকল, জিতল ১৪ বার। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার সিটিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে আশার পারদ বাড়িয়ে দিল। জেরার্ডের নতুন ভূমিকার সঙ্গে সুয়ারেজ-স্টারিজের গোলবন্যা, কুতিনহো-স্টার্লিংয়ের আগুনে ফর্ম সব কিছু মিলিয়ে লিভারপুলের সমর্থকেরা আশায় বুক বাঁধলেন, দুই যুগ পর লিগ জেতার।

সিটির বিপক্ষে ম্যাচটায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল ম্যাচের একদম শেষে, লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লেন হেন্ডারসন। লিভারপুলের সমর্থকেরা এই ঘটনার মাহাত্ম্য তখন সুখের আতিশয্যে না বুঝলেও, পরের তিন ম্যাচে টের পেলেন হাড়ে হাড়ে।

শেষ চার ম্যাচে দশ পয়েন্ট পেলেই লিগ জিতত লিভারপুল। প্রতিপক্ষ ছিল নরউইচ সিটি, চেলসি, ক্রিস্টাল প্যালেস ও নিউক্যাসল। চেলসি ছাড়া বাকি তিন ম্যাচে জিতলে আর চেলসির বিপক্ষে ড্র করলেই পাওয়া যাবে মোক্ষধাম, ভাবলেন লিভারপুলের খেলোয়াড়েরা।

কিন্তু জর্ডান হেন্ডারসন না থাকার কারণে মিডফিল্ডে একা হয়ে গেলেন জেরার্ড। হেন্ডারসন এতদিন বল কেড়ে নেওয়া, দৌড়ানো কিংবা ট্যাকলের কাজ করতেন। নিখুঁত পাস দেওয়ার জন্য জেরার্ডকে যেন কেউ 'জ্বালাতে' না পারে সেটা নিশ্চিত করতেন। মৌসুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সে সুবিধাটা পেলেন না জেরার্ড। হেন্ডারসনের অভাবটা বুঝিয়ে দিলেন চেলসির স্ট্রাইকার দেম্বা বা। সঠিক জায়গায় থাকার অভ্যাসে চিড় ধরেছিল অনেক আগেই, বিপজ্জনক দেম্বাকে দেখে তাড়াতাড়ি নিজের জায়গায় আসতে গিয়ে পিছলে পড়লেন জেরার্ড। ফলে ফাঁকা মাঠে গোল করলেন বা। সে ধাক্কা কাটিয়ে লিভারপুল ফিরে আসতে পারেনি, হারে ২-০ গোলে।

পরের ম্যাচেও একই কাণ্ড। সে ম্যাচে জেরার্ড অসাধারণ খেললেও মাঝমাঠ থেকে হেন্ডারসনের বাড়তি নিরাপত্তা না থাকায় বিশ্বাসঘাতকতা করে লিভারপুলের রক্ষণভাগ। প্যালেস ও নিউক্যাসলের বিপক্ষে শেষ দুই ম্যাচে জিতলেও গোল ব্যবধানে নয় গোলে পিছিয়ে থাকতে হতো লিভারপুলকে। শেষ দুই ম্যাচে সেই নয় গোলের ঘাটতি পোষাতে পাগল হয়ে গেলেন সুয়ারেজরা। প্যালেসের বিপক্ষে তিন গোল দেওয়ার পর রক্ষণের কাজ ভুলে আরও গোল করতে চাইলেন। ফলে হলো হিতে বিপরীত। তিন গোল খেয়ে এই ম্যাচেই পাকাপাকিভাবে শিরোপাদৌড় থেকে ছিটকে যায় লিভারপুল। পরের ম্যাচে হেন্ডারসনও ফিরে আসেন, লিভারপুলও ফেরে জয়ের ধারায়। কিন্তু ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে। আবারও শেষ মূহুর্তের হতাশাকাব্যে ম্লান হয় অ্যানফিল্ডের ক্লাবটা।

ওদিকে মাঠের বাইরে আরেক 'খেল' দেখাচ্ছিলেন সুয়ারেজ। বর্ণবাদী গালি গিয়ে, কাউকে কামড় দিয়ে প্রায়ই নিষিদ্ধ থাকতেন এই তারকা। ফলে শিরোপাদৌড়ে সমস্যা হতো লিভারপুলের। কিন্তু সুয়ারেজ সেটা বুঝতে চাইলেন না। চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলতে চাইলেন, জিততে চাইলেন শিরোপা। ২০১২ সালে একবার জুভেন্টাসে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। পরের মৌসুমের শেষদিকে আর্সেনালে যাওয়ার বায়না ধরলেন। তখন অধিনায়ক স্টিভেন জেরার্ড আর কোচ রজার্স মিলে সুয়ারেজকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বললেন, এক বছর ভালো খেলার জন্য। ভালো খেললে সুয়ারেজকে নেওয়ার জন্য রিয়াল-বার্সার মতো ক্লাবই ছুটে আসবে।

২০১৪ বিশ্বকাপে সুয়ারেজ আরেক কাণ্ড করে বসেন। ইতালির বিপক্ষে গ্রুপপর্বের ম্যাচে কামড়ে দেন ডিফেন্ডার জর্জো কিয়েল্লিনিকে। ফলে আবারও নিষিদ্ধ হন সুয়ারেজ। চার মাসের জন্য সুয়ারেজকে ফুটবলীয় বিভিন্ন কর্মকাণ্ড থেকে নিষিদ্ধ করে ফিফা।

এবার আসলেই ধৈর্যচ্যুতি ঘটে লিভারপুলের। বর্ণবাদ কাণ্ডে এই স্ট্রাইকারের পাশে দাঁড়িয়ে সমালোচনা কামানো ক্লাবটা চেলসির ব্রানিস্লাভ ইভানোভিচকে কামড়ে দশ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হওয়ার সময়ও পাশে ছিল। ফলে যে স্ট্রাইকারের দাম ১০ কোটি পাউন্ডেরও বেশি ধরে রেখেছিল লিভারপুল, তাঁকে বার্সার কাছে 'মাত্র' সাড়ে সাত কোটি পাউন্ডে বিক্রি করে দেয়।

এর আগে বেনিতেজ বা হুলিয়েরের আমলে যে ধারাটা বজায় ছিল, সেটা 'সফলভাবে' বজায় রাখলেন রজার্সও। কোনোরকমে দ্বিতীয় হওয়ার পরের মৌসুমেই ধস নামল লিভারপুলে। সুয়ারেজ-বিক্রির টাকায় একাধিক খেলোয়াড় কিনলেও সুয়ারেজের মতো কেউই ছিলেন না। অ্যালেক্সিস সানচেজকে দলে চাইলেও লিভারপুলের মতো ক্লাবে আসতে চাননি তিনি, ফলে রিকি ল্যাম্বার্ট আর মারিও বালোতেলি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাঁকে। পরের মৌসুমে ষষ্ঠ হলো তারা, ক্লাব ছাড়লেন রজার্স।

ততদিনে এফএসজি'র নেতৃত্বে মাঠের বাইরের লিভারপুল অনেকটা গোছালো হয়েছে। দলবদলের দিক দিয়ে ধাক্কা খেতে খেতে শিখেছে অনেক। 'মানিবল' পদ্ধতির সঠিক প্রয়োগ ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এনএফএলের দল বোস্টন রেড সক্সকে ৮৬ বছর পর শিরোপা জেতানো এই মালিকপক্ষ একই পদ্ধতির সফল প্রয়োগ করা শিখে গেছে লিভারপুলেও। ড্যামিয়েল কমোলি, ইয়ান আয়রে কিংবা ক্রিস্টিয়ান পারস্লোর মতো অকার্যকর নির্বাহীদের হটিয়ে দলে আনা হয়েছে মাইকেল এডওয়ার্ডসকে। যিনি নতুন খেলোয়াড় ও কোচ নিয়োগ দেওয়ার আগে আধুনিক প্রক্রিয়ায় কার সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু, সেটা মাথায় রাখতেন। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই দলে আসলেন জার্মান লিগে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডকে নিয়ে বায়ার্ন মিউনিখের আধিপত্য ভাঙ্গা জার্মান ক্গেন ক্লপ।

'খেলোয়াড় বা সমর্থকদের দেখে মনে হয় তাঁরা বেশ ভয়ে আছে। মাঠে আসলে খেলা দেখে তাঁরা উপভোগ করতে পারি না। আমি এই জিনিসটা বদলাতে চাই, সবকিছু নতুন করে শুরু করতে চাই। আমি চাই, যারা আমাদের ওপর এখন সন্দেহ করছেন, তাঁরা যেন আমার এই কথায় বিশ্বাস রাখেন। সকল সন্দেহবাদীদের বিশ্বাসীতে পরিণত করতে হবে।'

এই এক লাইনই যথেষ্ট ছিল লিভারপুল ভক্তদের সমর্থন পাওয়ার জন্য।

পরের বছরগুলোতে লিভারপুল স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পোড়েনি, তা নয়। ক্লপ দায়িত্বে আসার দেড় বছরের মাথায় কারাবাও কাপের পেনাল্টিতে হেরেছে সিটির কাছে। ইউরোপা লিগের ফাইনালে প্রথমে এগিয়ে গিয়েও হেরেছে সেভিয়ার কাছে। পরের বছরেই চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠেছে, কিন্তু হেরেছে মাদ্রিদের কাছে। কমিউনিটি শিল্ডে হেরেছে ওই সিটির কাছে। পয়েন্টের দিক দিয়ে নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল মৌসুম কাটানোর পরেও এক পয়েন্টের জন্য লিগ হাতছাড়া করেছে।

এসব স্বপ্নভঙ্গের হতাশাকাব্যের মাঝেও ক্লপ আস্তে আস্তে গড়ছিলেন নিজের সাম্রাজ্য।

কীভাবে? সাফল্যের সে গল্প না হয় আরেকদিনের জন্য তোলা থাক!