যেভাবে ক্লপের হাতে লিভারপুলের ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়ানো

দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে বন্ধন বাড়িয়েছেন ক্লপ। ছবি : এএফপি
দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে বন্ধন বাড়িয়েছেন ক্লপ। ছবি : এএফপি
>তিরিশ বছরের লিগখরা তো মিটেছেই, অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও লিভারপুল এখন একইসঙ্গে লিগ, চ্যাম্পিয়নস লিগ ও ক্লাব বিশ্বকাপজয়ী একটা ক্লাব। কিন্তু কীভাবে ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগালেন ক্লপ?

মেলউডের অনুশীলন কমপ্লেক্সের দোতলার করিডর দিয়ে হাঁটার সময় একটা জিনিস চোখে পড়তে বাধ্য। 

দেয়ালে একটা বিশাল ছবি। এই কমপ্লেক্সে যাঁরা কাজ করেন, কোচ থেকে শুরু করে খেলোয়াড়, ক্লাবকর্তা থেকে শুরু করে রাঁধুনি পর্যন্ত, সবাই মিলেমিশে মৌসুমের শুরুতে একটা ছবি তোলেন। ছবির নিচে বড় বড় করে লেখা থাকে, 'ক্লাস অফ মেলউড।' ক্লাবের প্রত্যেকে যে একই সুতায় গাঁথা, ছবিটা যেন সেটারই প্রমাণ দেয় অনুচ্চারে।

ছবিটা দেখতে দেখতে একটু সামনে এগোলে উল্টোদিকে একটা অফিস পাওয়া যাবে। অফিসকক্ষটার দরজা খোলা থাকে বছরের বারোমাস। অফিসের কর্তা যিনি, তিনি যে সবার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে অভ্যস্ত, খোলা দরজাটা যেন সেটাই বলে। যখন যাঁর প্রয়োজন, কোনো সংকোচ ছাড়াই তিনি ওই কক্ষে ঢুকে যেতে পারবেন, কথাবার্তা বলতে পারবেন ঘরের অফিসারটার সঙ্গে, নির্ভয়ে।

সেই ঘরেই মাথায় বড় একটা চিন্তার ভাঁজ নিয়ে নিজের বিশ্বস্ত ল্যাপটপে কাজ করে যাচ্ছেন কক্ষের কর্তাটি। পাশে ধূমায়িত কফির কাপ। সেই কফি কখন যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল, কেউ বলতে পারবে না। কর্তার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি ল্যাপটপে যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের কাজে ব্যস্ত। যে সংখ্যাতত্ত্বের প্রেমে পড়েছিলেন ছোটবেলায়, যে সংখ্যাতত্ত্বের ওপর ভরসা করে এসেছেন এতদূর, আবারও সেই সংখ্যাতত্ত্বের ওপরেই আস্থা রাখছেন তিনি।

সংখ্যা কখনও মিথ্যা বলে না।

কর্তার ল্যাপটপে তখন কার্লো আনচেলত্তি, এডি হাউ, ফ্রাঙ্ক ডি বোর ও ইয়ুর্গেন ক্লপ নামের চারজন কোচের ক্যারিয়ারের বিস্তারিত তথ্যাদি। লিভারপুলের পরবর্তী কোচ কে হবেন, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এতদিনের গবেষণা শেষে লিভারপুলের নিয়োগপ্রক্রিয়া সংক্রান্ত কমিটি চূড়ান্ত বাছাই করেছে এই চারজনকে। এই চারজনের মধ্যে এখন বেছে নিতে হবে একজনকে।

কার্লো আনচেলত্তি বিশ্বের বড় বড় অনেক লিগে বলতে গেলে সবকিছুই জিতেছেন। অভিজ্ঞতায় অনন্য। ইউরোপীয় প্রতিযোগীতায় পারফরম্যান্স দুর্দান্ত। কিন্তু অধিকাংশ সময়ে ছাব্বিশ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী খেলোয়াড়দের দলে এনেছেন। লিভারপুল চায় এমন খেলোয়াড়দের দলে আনতে, যাঁদের বয়স কম। তিন-চার বছর পরেও যাঁদের বিক্রি করলে ভালো মূল্য পাওয়া যায়। আর এদিকেই আনচেলত্তি পিছিয়ে গেলেন।

ঘরোয়া লিগে আয়াক্সের ফ্রাঙ্ক ডি বোরের রেকর্ড দুর্দান্ত হলেও অসাধারণ কৌশলী এই কোচ ইউরোপে অচেনা। একই কথা প্রযোজ্য বোর্নমাউথের এডি হাউয়ের ক্ষেত্রে। পিছিয়ে পড়লেন তাঁরাও।

একমাত্র ইয়ুর্গেন ক্লপই প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকলেন। ঘরোয়া লিগে এর আগে বায়ার্নের কর্তৃত্ব ভেঙেছেন, চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালেও নিয়ে গেছেন দলকে, তরুণ খেলোয়াড় গড়ে তোলায় বিশ্বাসী ও দুর্দান্ত কৌশলী।

সন্তুষ্ট চিত্তে সারাদিনের কাজ শেষ করে ল্যাপটপ বন্ধ করলেন লিভারপুলের স্পোর্টিং ডিরেক্টর মাইকেল এডওয়ার্ডস। তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে।

এডওয়ার্ডস, ক্লপ ও গর্ডন। ছবি : লিভারপুল এফসি ওয়েবসাইট
এডওয়ার্ডস, ক্লপ ও গর্ডন। ছবি : লিভারপুল এফসি ওয়েবসাইট


ইচ্ছে করেই বোস্টনে না করে মিটিংটা করা হচ্ছে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানে। দুই জায়গার মধ্যে মোটামুটি সাড়ে তিন ঘন্টার যাত্রাপথ।

কারণ একটাই, বোস্টনে মিটিং করলে সবাই জেনে যাবে, বোস্টন রেড সক্সের মালিক ফেনওয়ে স্পোর্টস গ্রুপ (এফএসজি) লিভারপুলের কোচ করার জন্য কথাবার্তা বলছে ইয়ুর্গেন ক্লপের সঙ্গে।

সামনাসামনি বসে আছেন মাইকেল গর্ডন ও ক্লপ। ক্লপের পাশে তাঁর মুখপাত্র মার্ক কোসিচকে।

এমনিতে পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির গর্ডন কখনও নিজেকে সেভাবে মেলে ধরেন না সবার সামনে। চুপচাপ এই লোকটা মুখের চেয়ে মাথা চালাতেই বেশি আগ্রহী। মিটিংয়ের দশ মিনিটের মাথায় নিজের খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসতে বাধ্য হলেন গর্ডন। সামনের লোকটার খেলা নিয়ে পরিকল্পনা, ক্ষুরধার মস্তিষ্ক, পারিপার্শ্বিক-রাজনৈতিক-সামাজিক চিন্তাধারার মধ্যে নিজের প্রতিফলন দেখতে পেলেন। তিন বছর আগে যে ব্রেন্ডান রজার্সকে ম্যানেজার করার জন্য বলতে গেলে হাতেপায়ে ধরতে হয়েছিল, এ লোকের সেই বালাই নেই। ক্লাবের এমন হতোদ্যম অবস্থা দেখেও তিনি নিজেই লিভারপুলের কোচ হতে উন্মুখ।

এফএসজির সভাপতি গর্ডনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলো না।

নতুন নতুন উপায়ে অনুশীলন করিয়ে চমক লাগিয়ে দিতেন ক্লপ। ছবি : এএফপি
নতুন নতুন উপায়ে অনুশীলন করিয়ে চমক লাগিয়ে দিতেন ক্লপ। ছবি : এএফপি


'টেরিবল!'

ইংরেজিতে আট অক্ষরের শব্দটা বোর্ডে দেখে খটকা লাগলো জর্ডান হেন্ডারসন-জেমস মিলনারদের। কোচের সঙ্গে খেলোয়াড়দের প্রথম পরিচয়ের দিন, তাতে কোচ শুরুতেই এই জিনিস বোর্ডে লিখলেন কেন?

ইয়ুর্গেন ক্লপ নিজেই নতুন শিষ্যদের বিভ্রান্তি পরিষ্কার করলেন। বুঝিয়ে দিলেন, লিভারপুলের খেলোয়াড়েরা এখন থেকে যখনই ম্যাচ খেলতে নামবেন, প্রতি মূহুর্তে প্রতিপক্ষ যেন 'টেরিবল' বা 'ভীতিজনক' পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

দুই দিন পরেই টটেনহামের বিপক্ষে 'অ্যাওয়ে' ম্যাচ। ড্র করলেও, সে ম্যাচেই লিভারপুলের খেলোয়াড়েরা বুঝিয়ে দিলেন, কোচের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে সমস্যা হচ্ছে না তাঁদের।

কিন্তু কীভাবে এই 'টেরিবল' পরিস্থতি সৃষ্টি করতেন লিভারপুলের খেলোয়াড়েরা? উত্তর রয়েছে একটা শব্দে – 'জেজেনপ্রেসিং'।

ক্লপের ডর্টমুন্ড যারা দেখেছেন, এই শব্দটার সঙ্গে তাঁদের পরিচিতি আছে আগে থেকে। ক্লপ মনে করতেন, প্রতিপক্ষ যখনই বল কেড়ে নেয়, ঠিক ওই সময়েই সে বল পায়ে সবচেয়ে বেশি নড়বড়ে থাকে। কারণ বল কেড়ে নেওয়ার পর তাঁকে মূহুর্তের জন্য হলেও বলের ওপর থেকে মনোযোগ সরিয়ে আশেপাশে দেখতে হয়, কাকে পাস দেওয়া যায় সেটা নির্ধারণ করতে হয়। তাই বল হারানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে দ্রুতগতিতে পাল্টা আক্রমণে যেতে হবে। প্রতিপক্ষের পায়ে যখনই বল যাবে, তখনই আশপাশ থেকে তাঁকে ঘিরে ধরতে হবে, 'প্রেস' করতে হবে।

সোজা বাংলায় এটাই ক্লপের সেই বহুলচর্চিত 'জেজেনপ্রেসিং' বা 'কাউন্টারপ্রেসিং'। ৪-২-৩-১ ছকে যে 'জেজেনপ্রেসিং' দিয়ে বায়ার্নের আধিপত্য ভেঙেছিলেন বুন্দেসলিগায়, হয়ে যাচ্ছিলেন 'প্রায়' ইউরোপসেরা। শুরুর দিকে নিজের পরীক্ষিত সেই ছক আর কৌশল দিয়েই লিভারপুলকে গড়ে তুলতে চাইলেন ক্লপ। অনুশীলন সেশনগুলো হতো একেকটা ম্যাচের মতো, প্রচণ্ড দৌড়াদৌড়ি-পরিশ্রম করতে হত খেলোয়াড়দের। ক্লপ দেখলেন, খেলোয়াড়েরা যে কাপড় পরে অনুশীলন করেন সে কাপড় ঘাম ঠিকমতো শুষে নেয় না। ফলে খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সর্বোচ্চটুকু পাওয়া যায় না।

ব্যস। পরিবর্তন করা হল জার্সির উপাদান।

দলে আস্তে আস্তে এলেন নতুন পুষ্টিবিদ, অনুশীলন বিশেষজ্ঞ। অনুশীলন শেষ করেই যেন সঙ্গে সঙ্গে খেলোয়াড়েরা নিজেদের 'রিচার্জ' করতে পারেন, সে লক্ষ্যে কাপড় বদলানোর জায়গাতেই জুসের বার বসানো হল। সেখানে চিনিজাতীয় কোনো জুস নয়, বরং হালকা ক্যাফেইন মিশ্রিত আপেলের জুস সরবরাহ করা হল। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের জন্য আলাদা আলাদা খাদ্যতালিকা বানানো হল। আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগেও যেখানে লিভারপুলের পুষ্টিবিদ খেলোয়াড়দের একটা অতিরিক্ত ডিমভাজা বা সসেজ খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করতেন, দুই দশক পর সেসব অভ্যাসকে মনে হলো রূপকথার কোনো গল্প।

হাজার বোঝানোর পরেও কুতিনহো থাকেননি লিভারপুলে। ছবি : এএফপি
হাজার বোঝানোর পরেও কুতিনহো থাকেননি লিভারপুলে। ছবি : এএফপি

ধীরে ধীরে ক্লপ বুঝলেন, তাঁর হাতে যে খেলোয়াড় আছে, তাঁদের দিয়ে ৪-২-৩-১ ছকে 'কাউন্টারপ্রেস' করা বেশ কঠিন।

স্ট্রাইকার হিসেবে ছিলেন ড্যানিয়েল স্টারিজ, ড্যানি ইংস, ক্রিস্টিয়ান বেনটেকে ও ডিভক অরিগি। স্টারিজ আর ইংস অধিকাংশ সময়ে চোটেই পড়ে থাকতেন, বেনটেকে-অরিগি গোল করতে পারলেও তাঁদের দিয়ে সফলভাবে কাউন্টার প্রেস করা সম্ভব হতো না। সমস্যা সমাধানে রবার্তো ফিরমিনোকে স্ট্রাইকার বানিয়ে ফেললেন ক্লপ। এত দিন আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার ও ডানপ্রান্তের উইঙ্গার হিসেবে খেলা ফিরমিনো সেভাবে নিজের প্রতিভার প্রকাশ করতে পারছিলেন না। ব্রাজিলের এই তারকা যাতে আক্রমণভাগে খেলা গড়তে পারেন, সে জন্য উইঙ্গারদের ফিরমিনোর আরেকটু কাছাকাছি থাকতে বললেন ক্লপ। ফলে ছক বদলে ৪-২-৩-১ থেকে ৪-৩-৩ এ রূপ নিলো। সবার ওপরে ফিরমিনো, আর পরের মৌসুমে, অর্থাৎ ক্লপের প্রথম পূর্ণ মৌসুমে ফিরমিনোর একটু ডানে এলেন সাদিও মানে। পরের মৌসুমে মোহামেদ সালাহ আসার আগ পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন মানে।

এখানেও আরেকটা সমস্যায় পড়লেন ক্লপ। এর আগে ৪-২-৩-১ ছকে স্ট্রাইকারের পেছনে খেলা কুতিনহো ৪-৩-৩ ছকে লেফট উইঙ্গার হিসেবে খেলতে পারতেন না সেভাবে। তাঁকে তিন মিডফিল্ডারের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রসরমান মিডফিল্ডার হিসেবে খেলানোর চেষ্টা করা হল। কিন্তু সেখানে খেলালে কুতিনহো খেলা গড়তে পারলেও, দল বল হারিয়ে ফেললে পেছনে থাকা লেফটব্যাককে সেভাবে সাহায্য করতে পারতেন না। কুতিনহোর নিজেরও ইচ্ছে ছিল সবসময় ৪-২-৩-১ ছকে স্ট্রাইকারের পেছনে খেলার।

এর মধ্যে দলে চলে এসেছিলেন মোহাম্মদ সালাহ। সালাহ এর জায়গায় বায়ার লেভারকুসেনের ইউলিয়ান ব্রান্ট কিংবা লেস্টারের রিয়াদ মাহরেজকে পছন্দ হয়েছিল ক্লপের। ওদিকে লিভারপুলের সভাপতি জন হেনরি সালাহকে নিয়ে সংশয়ে ছিলেন, হাজার হোক, এর আগে প্রিমিয়ার লিগে চেলসির হয়ে খেলতে এসে সফল হননি এই মিসরীয় তারকা।

দৃশ্যপটে এলেন সেই মাইকেল এডওয়ার্ডস। যুক্তি, সংখ্যাতত্ত্ব ও সালাহের ক্যারিয়ারের উন্নতির গ্রাফ দিয়ে বোঝালেন, ব্রান্ট বা মাহরেজের চেয়ে সালাহ অনেক বেশি কার্যকরী হবেন। এর মধ্যেই এডওয়ার্ডের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা ক্লপ তাই বিশ্বাস রাখলেন বন্ধুর ওপর। ফলাফল এখন দেখতেই পাচ্ছেন!

সালাহকে জায়গা করে দিতে কুতিনহোর লেফট উইং পজিশনে চলে এলেন মানে। দুই পা দিয়েই সমানভাবে খেলতে পারলেও ডান পা দিয়ে এই সেনেগাল তারকার শট নেওয়ার প্রবণতা একটু বেশি ছিল। বাম উইংয়ে আসায় তাঁর গোলসংখ্যাও তাই তরতর করে বাড়তে লাগল।

সালাহ-মানে-ফিরমিনো; বর্তমান সময়ের অন্যতম ভীতিজাগানিয়া আক্রমণভাগের জন্ম হল এভাবেই।

আক্রমণভাগের সেই ত্রয়ী। ছবি : সংগৃহীত
আক্রমণভাগের সেই ত্রয়ী। ছবি : সংগৃহীত

দক্ষিণ আমেরিকায় জন্ম নেওয়া খেলোয়াড়দের ছোটবেলা থেকেই একটা ইচ্ছে থাকে।

সব সময় দেখে এসেছেন, নিজের মহাদেশের রোনালদো, রেদোন্দো, রিকেলমে, রোনালদিনহো, মেসি, সাভিওলা, হিগুয়াইন, রিভালদো, রোমারিও, সানচেজ, জামোরানোরা ক্যারিয়ারের কোনো না কোনো পর্যায়ে রিয়াল বা বার্সেলোনায় খেলে গেছেন। আইডলদের পথ ধরে তাই তাঁদেরও সুপ্ত বাসনা থাকে এই দুই ক্লাবের কোনো একটিতে যাওয়ার।

কুতিনহোও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। ফলে বার্সা যখন তাঁর দিকে হাত বাড়ালো, দুনিয়ার বাকি সব চিন্তা মাথা থেকে দূর হয়ে গেল ব্রাজিলিয়ান প্লেমেকারের। বার্সায় যাওয়ার আগ্রহ এতটাই বেশি ছিল।

ওদিকে ক্লপ ৪-৩-৩ ছকে আস্তে আস্তে সালাহ-মানে-ফিরমিনো-কুতিনহোর চারজনকে একই একাদশে খেলানোর টোটকা মোটামুটি বের করে ফেলেছেন। ততদিনে লিভারপুলের লেফটব্যাক হিসেবে অ্যান্ডি রবার্টসন নিজের ঝলক দেখানো শুরু করে দিয়েছেন। রবার্টসনের পেছনে দুর্দান্ত একজন সেন্টারব্যাক থাকলেই কুতিনহোর ওপর থেকে রক্ষণ করার বাড়তি চাপটা চলে যাবে। যে কারণে ক্লপ ততদিনে সাউদাম্পটনের ডাচ সেন্টারব্যাক ভার্জিল ফন ডাইককে আনার জন্য চেষ্টা শুরু করে দিয়েছেন। কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসবেন ডাচ তারকা। বল হারানোর সঙ্গে সঙ্গে পেছনে আসতে কুতিনহোর যে অনীহা, সে সমস্যারও সমাধান হবে। নির্ভারচিত্তে মাঝমাঠ থেকে আক্রমণভাগ সংযোগকারী মিডফিল্ডার হিসেবে নিজের জাদু দেখাতে পারবেন কুতিনহো - ক্লপের পরিকল্পনা ছিল এ-ই।
কিন্তু সব পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিলেন কুতিনহো নিজেই। বার্সায় যে তাঁকে যেতেই হবে!

লিভারপুলও নাছোড়বান্দা। সবার সামনে ক্লাবটা তখন প্রমাণ করতে উন্মুখ, যে লিভারপুলকে কেউ উন্নতির ধাপ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। বরং লিভারপুলই হবে বিশ্বের খেলোয়াড়দের আসার চূড়ান্ত লক্ষ্য। কুতিনহোকে ছেড়ে দিলে ম্যাকমানামান-ওয়েন-সুয়ারেজ-আলোনসো-তোরেস-মাচেরানো কাণ্ডের পর মানুষের মধ্যে আবারও ওই ধারণা পোক্ত হবে, যে লিভারপুল খেলোয়াড় বিক্রি করা ক্লাব। খেলোয়াড় ধরে রাখার মতো বড় নয়।

ক্লাবের সভাপতি জন হেনরি সাফ জানিয়ে দিলেন, কুতিনহোকে ছাড়া হবে না। এদিকে কুতিনহোও এককাঠি সরেস, জানিয়ে দিলেন, তাঁর পিঠে চোট, লিভারপুলের হয়ে খেলতে পারবেন না। বার্সাও চোটের কথা শুনে একটু পিছে হটল, ভাবল, চোট সারলেই ছোঁ মেরে নিয়ে আসা হবে 'ইনিয়েস্তার উত্তরসূরি' হওয়ার সব রকম যোগ্যতা থাকা এই খেলোয়াড়টিকে।

কিন্তু ক্লপ ও তাঁর অত্যাধুনিক চিকিৎসক দল তো জানেন, চোট-ফোট কিছু নয়। বার্সায় না যেতে দেওয়ার জন্য এই অভিনয়টা করছেন কুতিনহো। পিঠে বারবার স্ক্যান করেও চোটের লেশমাত্র পাওয়া গেল না।

খেপে গেলেন ক্লপ। সভাপতিকে বললেন, যে খেলোয়াড় তাঁর হয়ে খেলতে চায় না, তাঁকে দলে রেখে পরিবেশ নষ্ট করার মানে নেই। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূণ্য গোয়াল ভালো। সভাপতি মানলেন সে কথা। ছয়মাস পর জানুয়ারি দলবদলে কুতিনহোকে আরও বেশি দামে বিক্রি করার সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন তাঁরা। 'পিঠে চোট' থাকা খেলোয়াড়ের পেছনে একটা ক্লাব আগ্রহী থাকলে সে খেলোয়াড়টা যখন পুরোপুরি সুস্থ হবে, তখন আগ্রহের মাত্রাটা আরও বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।

ফলাফল, বার্সা পেল তাঁদের 'ইনিয়েস্তার উত্তরসূরি'কে। লিভারপুলের অ্যাকাউন্টে জমা পড়ল ১৪ কোটি ২০ লাখ পাউন্ড। চার বছর আগে মাত্র পঁচাশি লাখ পাউন্ড দিয়ে কেনা খেলোয়াড়েরকে দিয়ে প্রায় সাড়ে তেরো কোটি পাউন্ড লাভ করল লিভারপুল!

রক্ষণভাগের সবচেয়ে বড় দুই ভরসা। ছবি : এএফপি
রক্ষণভাগের সবচেয়ে বড় দুই ভরসা। ছবি : এএফপি

দলের অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসনের একটা গুণ তাঁকে সবার চেয়ে আলাদা করে।
কোচ যখন তাঁর কাছ থেকে যা চান, বিনা বাক্যব্যয়ে সে কাজ করতে রাজি হয়ে যান। দলে আদর্শ রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার না থাকার কারণে ক্লপ যখন ওই ভূমিকায় হেন্ডারসনকে চাইলেন, রাজি হয়ে গেলেন অধিনায়ক। যদিও তাঁর পছন্দের পজিশন মিডফিল্ডের তিনজনের মধ্যে ডানদিকের জায়গাটা। যেখান থেকে ক্রমাগত ওঠানামা করে প্রতিপক্ষের আক্রমণ নস্যাত করার পাশাপাশি সুযোগ বুঝে ডিবক্সে ঢুকে গোল করা বা গোলে সহায়তা করা যাবে।

সেখান থেকে সরে মাঝখানে এলেন হেন্ডারসন, দুই সেন্টারব্যাকের একটু সামনে। দল একটা 'ইউনিট' হিসেবে যেহেতু দুর্দান্তভাবে কাউন্টারপ্রেস করছে, ওই জায়গায় মানিয়ে নিতে সমস্যা হলো না অধিনায়কের। ফলে তিনি যে আদর্শ রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার নন, সে খামতিটা ঢাকা পড়ে গেল।

কিন্তু ম্যাচের নব্বই মিনিট ধরে প্রত্যেকটা ম্যাচে সমানতালে প্রেস করতে যাওয়াটাও সমস্যার সৃষ্টি করছিল। প্রতিপক্ষের কাছে লিভারপুলের কৌশল অনুমেয় হয়ে গেল। অপেক্ষাকৃত বেশি গোল খাওয়া শুরু করল লিভারপুল।
আর এখানেই নিজের কৌশলে হালকা পরিবর্তন আনলেন ক্লপ। জেজেনপ্রেসিং থেকে সরে এলেন।

দুটো কারণে ক্লপের প্রথম দুই মৌসুমে অনেক সময় লিভারপুল নিজেদের অগ্রগামিতা ধরে রাখতে পারত না। এক – বিশ্বমানের কোনো সেন্টারব্যাক না থাকা, দুই – সব সময় প্রেস করতে চাওয়া। একজন খেলোয়াড়কে দলে এনে দুই সমস্যারই সমাধান করলেন ক্লপ।

ভার্জিল ফন ডাইক। এ পর্যায়ে এসে ফন ডাইক কে, তাঁর ক্ষমতা-ভূমিকা কি, সে নিয়ে সম্ভবত ইউরোপিয়ান ফুটবলের অনুসারীমাত্রই বিদিত। ফন ডাইক আসায় রক্ষণভাগে স্থিতিশীলতা এল। রবার্টসন পেলেন সামনে যাওয়ার অনিঃশেষ অধিকার, কারণ রবার্টসনের ফেলে রাখা জায়গা সামাল দেবেন ফন ডাইক। জোয়েল মাতিপ পেলেন পাশে খেলার মতো একজন নেতা। জো গোমেজ পেলেন সামনে গিয়ে প্রতিপক্ষকে চার্জ করতে পারার নিশ্চিন্ত সুযোগ, কারণ বাতাসে ভেসে আসা বলগুলো সামলাতে পারবেন ফন ডাইক। নিজেদের রক্ষণভাগ ও রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডের দুর্বলতা ঢাকার জন্য ক্লপকেও এখন আর সব সময় প্রেস করে খেলানো লাগবে না। ফলে লিভারপুল শুধু তখনই প্রেস করা শুরু করল, যখন দরকার। ইচ্ছেমত প্রেসের মাত্রা বাড়াতে কমাতে পারল। গোল করে বাকী সময়টা চুপচাপ প্রতিপক্ষের আক্রমণ সামলানোর মতো রক্ষণভাগের বাড়তি নিরাপত্তা এসে গেল তাঁদের।

কিন্তু এভাবে খেলানোর জন্য দলে একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার দরকার। কারণ ওই যে, দল নিরন্তর প্রেস করলে রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে হেন্ডারসন কাজ চালাতে পারবেন, কিন্তু প্রেস না করলে তাঁর খামতিগুলো বেরিয়ে আসবে। হেন্ডারসনকে তাই তাঁর পছন্দের ডানদিকের জায়গাটা ফিরিয়ে দিলেন ক্লপ। রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে দলে এলেন ফাবিনহো।

ক্লপ দেখলেন, গোল করা বা গোলের সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য এখন আর শুধু সালাহ-মানে-ফিরমিনোর ওপর ভরসা করার দিন শেষ। রক্ষণভাগে এমন কিছু খেলোয়াড় চলে এসেছেন, যারা পেছন থেকে আক্রমণভাগে নিখুঁত পাস বা বাতাসে ভাসানো বল পাঠাতে পারদর্শী। রাইটব্যাকে আলেক্সান্ডার-আরনল্ড, লেফটব্যাক রবার্টসন। দুজনেই বল পায়ে দুর্দান্ত। অনেকের মতেই তাঁদের ক্ষমতা একজন 'প্লেমেকার' এর সমান, যাঁরা রক্ষণভাগ থেকেই খেলা গড়তে পারেন। একই কথা প্রযোজ্য ফন ডাইকের ক্ষেত্রেও। মাঝে মধ্যেই লম্বা বল দিয়ে নিখুঁতভাবে সালাহ নয়তো মানের কাছে পাঠান তিনি।
ফলে কুতিনহো চলে যাওয়ার কারণে উদ্ভূত সৃষ্টিশীলতার অভাব ক্লপ পূরণ করলেন দুই ফুলব্যাক দিয়ে। দুই ফুলব্যাকের ফেলে আসা জায়গায় হুট করে প্রতিপক্ষের আক্রমণ করার ভয় নেই, কারণ ফন ডাইক-গোমেজ আছেন। বাড়তি নিরাপত্তা হিসেবে আরনল্ডের জায়গায় চলে আসতেন হেন্ডারসন, একই কাজ বামদিকে করতেন ডাচ মিডফিল্ডার জর্জিনিও ভাইনালদাম।

ফলাফল? গত মৌসুমে লিগে দুই ফুলব্যাক মিলে গোলসহায়তা করলেন ২৩বার (আরনল্ড ১২ গোলে, রবার্টসন ১১টিতে)। এবারও অনেকটা তা-ই, শুধু রবার্টসনের কমেছে ৩টি। এমন আগ্রাসী ফুলব্যাক জুটি শেষ কবে দেখেছে প্রিমিয়ার লিগ?

প্রয়োজনে প্রেসিং দর্শন থেকে সরে এসে লং বলে খেলতে লাগল লিভারপুল। বায়ার্নের মাঠে ম্যাচটায় সাদিও মানের প্রথম গোলের আগে ফন ডাইকের উড়ন্ত পাস, এই মৌসুমে নিজেদের মাঠে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে একদম শেষ মূহুর্তে অ্যালিসনের লম্বা পাস ধরে সালাহর গোল, কিংবা আরনল্ড-রবার্টসনের লম্বা ক্রস ধরে সিটির বিপক্ষে হেড করে সালাহর গোল – সবকিছু কিন্তু জেজেনপ্রেসিং থেকে আস্তে আস্তে সরে আসারই প্রমাণ দেয়!

'আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমাদের প্রত্যাশা মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছি!'

কাঁদতে কাঁদতে গোলরক্ষক লরিস কারিয়াস যখন কিয়েভে ২০১৮ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল দেখতে যাওয়া সমর্থকদের সামনে ক্ষমা চাইছিলেন, দূরে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ক্লপ মাথাটা তুললেন খানিক। দেখলেন, গ্যালারিতে স্ত্রী উলা ক্লপ সান্ত্বনা দিচ্ছেন ক্রন্দনরত কারিয়াসের মা-কে। দূরে তখন রোনালদো-রামোসদের হ্যাটট্রিক শিরোপাজয়ের উচ্ছ্বাস।

লিভারপুলে আসার পর ৪৭ লাখ পাউন্ড দিয়ে লরিস কারিয়াসকে কিনলেও আস্তে আস্তে ক্লপ বুঝলেন, 'অলরাউন্ডার' গোলরক্ষক হওয়ার সামর্থ্য নেই তাঁর। তা-ও ভরসা রেখেছিলেন, ভেবেছিলেন হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ক্লপের এই ধারণাটা যে ভুল ছিল, সেটা বোঝানোর জন্য ফুটবল বিধাতা বেছে নিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচকেই। সে ম্যাচে কারিয়াসের পারফরম্যান্স নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই।

বহুদিন ধরেই দলের গোলরক্ষক কোচ জন আকটেরবার্গ রোমা থেকে ব্রাজিলের গোলরক্ষক আলিসনকে কেনার ব্যাপারে ক্লপকে বলে যাচ্ছিলেন। শুধু তাই নয়, ২০১৩ সালের দিকে লিভারপুলের বেঞ্চ গোলরক্ষক আরেক ব্রাজিলিয়ান, দোনি, তৎকালীন ম্যানেজার ব্রেন্ডান রজার্সকে বলেছিলেন, 'ইন্তারনাসিওনালে একটা ছেলে খেলে, ওর দিকে নজর রেখো।'

চ্যাম্পিয়নস লিগে রোমার হয়ে চেলসি বা অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে অ্যালিসনের খেলা দেখে ক্লপও মানলেন, কাউকে কিনলে একেই কিনবেন।

কিয়েভের সেই ফাইনালের পর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন ক্লপ। বারো মাস পর সেই অ্যালিসনই লিভারপুলের জার্সিতে উয়েফা ও ফিফার বর্ষসেরা গোলরক্ষক, ইউরোপসেরা ক্লাবের তারকা। পাশাপাশি ব্রাজিলের জার্সিতে কোপা আমেরিকার সেরা গোলরক্ষকও নির্বাচিত হলেন।

'আমরা ইউরোপিয়ান কাপ দেখলাম
মাদ্রিদের পক্ষেই ভাগ্য ছিল সহায়
প্রতিজ্ঞা করছি আমরা যেমন আছি তেমনই থাকব
লিভারপুলে ট্রফিটা আবারও নিয়ে আসব!'

কিয়েভে মাদ্রিদের কাছে ফাইনাল হারার পরেও বিয়ার খেয়ে মাঝরাতে সমর্থকদের সঙ্গে গলাগলি করে এভাবে উদযাপন করেছিলেন ক্লপ। কোনো সংশয়, হতাশা কিংবা বিষণ্ণতাকে মনের মধ্যে ঢুকতে দেননি। উল্টো সমর্থকদের কথা দিয়েছিলেন, কেবলই শুরু হচ্ছে দীর্ঘ এক জয়যাত্রা। এক বছর পর সেই ক্লপই নিজের কথা রাখলেন। মাদ্রিদের ওয়ান্দা মেত্রোপলিতানোতে টটেনহামকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে সমর্থকদের সঙ্গে গাইলেন,
'আমরা মাদ্রিদ থেকে শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছি,
আজ রাতে আমরা ছয় নাম্বারটা জিতেছি
আমরা ট্রফিটা লিভারপুলে ফিরে এনেছি
কারণ আমরা আনবোই, এমন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম!'

এক বছর পর আবারও আরেকটা উৎসবের উপলক্ষ এনে দিলেন ক্লপ। এবারের আনন্দ দীর্ঘ তিরিশ বছর পর লিগ জয়ের।

লিগ জয় নিশ্চিত হওয়ার পর ফোনটা নিয়ে সবার আগে দুজনকে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠালেন লিভারপুলের সভাপতি টম ওয়ার্নার। 'অভিনন্দন, অবশেষে আমরা পেরেছি!' - সভাপতির ছোট্ট টেক্সট মেসেজ দেখে ক্লপ আর এডওয়ার্ডসের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছিল কি না, কে জানে!