মিলে গেল ডব্লিউ, ডব্লিউ, ডব্লিউ

স্যার এভারটন উইকস। ৯৫ বছর বয়সে যোগ দিলেন ওরেল-ওয়ালকটের সঙ্গে। ছবি: টুইটার
স্যার এভারটন উইকস। ৯৫ বছর বয়সে যোগ দিলেন ওরেল-ওয়ালকটের সঙ্গে। ছবি: টুইটার

অন্যলোকে ওভাল পার্কের মতো কোনো জায়গা আছে? নিশ্চয়ই আছে। যাঁদের যেখানে মানায় সেখানেই তো রাখার কথা শোনা যায়। সে হিসেবে থ্রি ডব্লিউজ ওভাল পার্কের মতো একটা মাঠ, ব্যাট-বল...আর এক সেট তাস হলেই তো তাঁদের দিব্যি চলে যাওয়ার কথা। দীর্ঘ ৫৩ বছর পর 'থ্রি ডব্লিউজ'দের পুর্নমিলনী। সাজ সাজ রব তো পড়বেই।

প্রয়াত কিংবদন্তি ধারাভাষ্যকার টনি কোজিয়ার হয়তো এই পুর্নমিলনী উৎসবের সঞ্চালক। হয়তো কী, তাঁকে ছাড়া এই উৎসব তো আবৃত্তিহীন কবিতা পাঠ! ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের কণ্ঠস্বর হয়তো মাইক্রোফোন হাতে প্রশ্নটা না করে থাকতে পারেননি, কী হে সেঞ্চুরিটা শেষ পর্যন্ত পেলে না! পাশ থেকে উঠতে পারে হাসির দমক। স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল ও স্যার ক্লাইড ওয়ালকট।

দুই ডব্লিউ-রঝে মেঝ ডব্লিউ (সতীর্থ) স্যার এভারটন উইকস এখন ওখানকার বাসিন্দা। দুজন মিলে কোথায় উইকসের মন ভালো রাখা চেষ্টা করবেন তা না, চলছে মশকরা। ৫টা রান করে আসলেই পারতে! হোক না তা জীবনের উইকেট, বেঁচে থাকাটা তো এক অর্থে ব্যাটিং করাই।ওই কয়টা রান করে আসলেই সেঞ্চুরিটা হয়ে যেত। তখন বেঁচে থাকতে টানা ছয় ইনিংসে সেঞ্চুরি না পাওয়ার আক্ষেপটা ঘুচত একটু হলেও। সেই প্রস্তুতি-ও তো তোমার ছিল। কিন্তু এমন এক স্কোর (বয়স) গড়ে আউট হলে যা কি না তোমার কোনো টেস্ট ইনিংসে নেই। এই ৯৫ দিয়ে হবে-টা কী!

ওরেল-ওয়ালকট কি এসব প্রশ্নে কান ঝালাপালা করছেন উইকসের? চির নম্র উইকস কি মাথা নিচু করে স্মরণ করছেন নিজের সে সব চেষ্টা, যেগুলো তিনি ৮০ তে পা রেখেই শুরু করেছিলেন। এই যেমন ধরুন, সুমদ্রে সাঁতার কাটা, রান্না করা, গাড়ি চালানো, মাঠে গিয়ে ক্রিকেট ম্যাচ দেখা আর তাস পেটানো তো আছেই। এসব চেষ্টা-চরিত্রের সাক্ষী হিসেবে উইকস হয়তো ডাক দেবেন কোজিয়ারকে। বলবেন, ওখানে থাকতে তুমি তো এসব নিয়ে লিখেছ! দয়া করে ওদের বলো।

কোজিয়ার নিজে বলবেন কী, ওসব ওরেল-ওয়ালকটদের জানা থাকার কথা। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের ভক্ত কোজিয়ারকে শুনবে না পড়বে না তা হয় না। উইকস জীবনের উইকেটে ৯০ তে (বছর) পা রাখার পর তাঁকে কোজিয়ার লিখেছিলেন 'স্যার এভারটন উইকসের ক্যারিয়ারে সব স্কোরের মধ্যে ৯০ দূর্ভাগ্যজনক।' সেই লেখাতেই উইকসের বলা গোপন কথাটা ফাঁস করেন কোজিয়ার। তার ৫ বছর আগে এক সিরিজের সাক্ষাৎকারে উইকস তাঁকে বলেছিলেন, এই বছরটা পার করে দিতে পারলে জীবনের তিন অঙ্কে পা রাখার চেষ্টা করবেন, যে সংখ্যাটা তাকে মাদ্রাজ (চেন্নাই) থেকে তাড়া করছে।'

ওরেল-ওয়ালকটদের এসব জানা বলেই হয়তো রসিকতায় কাটা পড়বে। নষ্টালজিয়া? সে তো বটেই। কী সব দিন ছিল! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটকে দাঁড় করানো তিন কারিগর, ওরেল, ওয়ালকট, উইকস। ক্রিকেটের বিখ্যাত 'থ্রি ডব্লিউজ'। আরেকটু খোলাসা করা যায়। পঞ্চাশের দশকে তর্কযোগ্যভাবে ক্রিকেট বিশ্বের সেরা মিডলঅর্ডার এই তিন ব্যাটসম্যান।

অভিজাত, চোখ ধাঁধানো ওরেল, স্ট্রোকে সিদ্ধহস্ত ওয়ালকট ছিলেন ধীরলয়ের ঝড়। আর উইকস?  উইজডেনের ভাষায়, 'সেরা ব্যাটসম্যানদের যেসব হলমার্ক থাকে সব ছিল। দুর্দান্ত চোখের সঙ্গে পা দুটো ভীষণ ক্ষিপ্র।' স্কয়ার কাট, পুল, হুক, ড্রাইভ ছিল চোখ ধাঁধানো। পেছনের পায়ে খুব শক্তিশালি। কিন্তু গলায় রুমাল পেচিঁয়ে ব্যাটিং করতেন নিরীহ মুখে। পেটা পেশীর শরীর অবশ্য অন্য আভাস দিত। যদিও পরিসংখ্যানের একটি বিশেষ জায়গায় ওটা আবার ভুল প্রমাণিত।

মাত্র ১০ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে খেলেছেন ৪৮ ম্যাচ। ৫৮.৬১ গড়ে ৪৪৫৫ রান। ১৫ সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ ইনিংসে ব্যাট করেছেন চারে। এ পজিশনে তাঁর গড় ছিলে ৬০-এর ওপরে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং নক্ষত্রপুঞ্জে তাঁর চেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় শুধু 'ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান' জর্জ হ্যাডলির (৬০.৮৩)। উইকসের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে এ কথা স্মরণ করে হ্যাডলির কি বেশ গর্ব হবে? সঙ্গে ওই রহস্যটাও নিশ্চয়ই তাঁকে ভাবাবে, এমন ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ারে ছক্কা মাত্র একটি!

ক্রিকইনফোয় উইকসের নামের পাশে লেখা ২ ছক্কা। কোজিয়ার সেখানেই তাঁর লেখায় ব্যাখ্যা করেছেন। ১৯৫৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপকে কুইন্স পার্ক ওভাল টেস্টে বিল জনস্টনকে লং অন দিয়ে ছক্কা মেরেছিলেন উইকস। একবার ভারত সফরে এক পরিসংখ্যানবিদ কোজিয়ারকে দেখালেন, ১৯৪৮ কলকাতা টেস্টে উইকসের নামের পাশে ১ ছক্কা। বার্বাডোজে ফিরে উইকসের কাছে ওই ছক্কা নিয়ে জানতে চান কোজিয়ার। 'হ্যাঁ, মনে আছে। ওটা ওভারথ্রো থেকে। আমরা দৌড়ে দুই রান নেই। থ্রো খুব বাইরে ছিল। বাউন্ডারি হয়ে যায়' উইকস মনে করেন।

কোজিয়ারকে দেখে উইকসের নিশ্চয়ই মনে পড়বে সেই কথাটাও, 'গোটা টেস্ট ক্যারিয়ারে একটা ছক্কা মারলে তা মনে রাখা উচিত।' কিন্তু কেন মাত্র এক ছক্কা? উইকসের নিশ্চয়ই কোজিয়ারকে দেওয়া জবাবটাও মনে পড়বে। কেনসিংটন ওভাল থেকে একটু দূরে ভীষণ গরীব পরিবারে জন্মেছিলেন উইকস। পিকউইক ক্লাব সে সময় কেনসিংটন ওভাল পরিচালনা করে। ক্লাবটিতে সাদাদের আধিক্য থাকায় সদস্যপদ পাননি উইকস। শৈশবে মাঠ পরিচর্যা করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়েছে, মাঠে ঢুকতে হতো সূর্যোদয়ের আগে। ১৩ বছর বয়সে গ্রামের লিগ দিয়ে তাঁর প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট শুরু। এরপর বার্বাডোজ রেজিমেন্ট দল ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে গোটা কয়েক ম্যাচে জাতীয় দলে। তাঁর ব্যাটিং কৌশলের ভিত্তি ছিল শৈশবের দর্শন। এক ছক্কা মারার রহস্যটাও সম্ববত সেখানে লুকোনো। উইকস তা ভেঙে কোজিয়ারকে বলেছিলেন, 'তুলে মারলে হয়তো কারও জানালা ভাঙবে, বলটা ফেরত পাওয়া যাবে না। এ কারণে নিচে খেলতে হতো।'

স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল, স্যার এভারটন উইকস ও স্যার ক্লাইড ওয়ালকট। ছবি: টুইটার
স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল, স্যার এভারটন উইকস ও স্যার ক্লাইড ওয়ালকট। ছবি: টুইটার

সেসব স্মৃতি এই ত্রয়ীর একসঙ্গেই মনে পড়ার কথা। তাঁরা অদৃশ্যভাবেই এক সূত্রে গাঁথা। ১৮ মাসের ব্যবধানে ওরেল, উইকস, ওয়ালকটের জন্ম। তাও বলতে গেলে একই এলাকাতেই। ১ কিলোমিটার অঞ্চলের মধ্যে। জাতীয় দলে তিনজনের অভিষেকও একই সিরিজে ১৯৪৮ সালে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই সিরিজের শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন উইকস। এরপর সে বছরের নভেম্বরে ভারত সফরে টানা চার ইনিংসে এল আরও চার সেঞ্চুরি। এর মধ্যে সেই কলকাতা টেস্টও আছে। জ্যাক ফিঙলেটন ও অ্যালান মেলভিলের রেকর্ড ভেঙে টানা পাঁচ ইনিংসে সেঞ্চুরির নতুন রেকর্ড গড়েন উইকস। তা আজও কেউ ভাঙতে পারেনি। হয়ে যেত ষষ্ট সেঞ্চুরিও। মাদ্রাজ (চেন্নাই) টেস্টে ৯০ রানে থাকতে রান আউট হন। বলা হয়, ওটা আম্পায়ারের ভুলের মাশুল। শুধু তাই নয়, ১২ ইনিংসে তাঁর দ্রুততম ১ হাজার রানের যুগ্ম রেকর্ডও কেউ ভাঙতে পারেনি। এ প্রসঙ্গ উঠতেই পুর্নমিলনীতে 'গুরুস্থানীয়' কেউ একজন হয়তো মুচকি হাসবেন। সে কথায় পরে আসছি। আগে 'ডব্লিউজ'দের মিলগুলো দেখুন।

আদ্যক্ষর তো ডব্লিউ, তিনজনের জন্মই বার্বাডোজের ব্রিজটাউনে। কেনসিংটন ওভাল থেকে ১ কিলোমিটার অঞ্চলের মধ্যে বসত করত তিনজনের পরিবার। জন্ম একই ধাত্রীর হাতে। তিনজনই দেশের নেতৃত্ব ও 'নাইটহুড' পেয়েছেন। শুধু কী তাই, ওরেল-ওয়ালকটের টেস্ট ছক্কাও সমান ১১। উইকস যেন এখানে আলাদা হয়েও আছেন দুজনের মধ্যে (১)! আর ব্যাটিংয়ের ছোঁয়াটা ছিল সেই গুরুস্থানীয় বেঁটেমতো লোকটির, টেস্টে যিনি হাজার রান ছুঁয়েছেন ১৩ ইনিংসে। রিচি বেনোর ভাষায়, উইকসের ব্যাটিং 'তাঁর খুব কাছাকাছি'। আর সেই বেঁটেমতো লোকটির স্ত্রীর ভাষায়, তাঁর পেছনের পায়ে ড্রাইভ ও স্কয়ার কাটের সঙ্গে মিলে যায়। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান!

থ্রি ডব্লিউজদের এই পুর্নমিলনীর ফিতাটা ডনকেই কাটতে হবে। ১৯৬৭ তে চলে যান ওরেল। এরপর থেকেই তো মর্ত্যলোকে তিনজনের আর একসঙ্গে দেখা হয়নি। ২০০৬ সালে চলে যান ওয়ালকট। থ্রি ডব্লিউজ ওভাল পার্কে দুজনে সমাহিত। এবার ওখানে তাঁদের সঙ্গে উইকস যোগ দেওয়ায় মিলে গেল থ্রি ডব্লিউ।

ওখানে এখন তাই পুর্নমিলনী উৎসবের আবহ। এদিকে বিরহ দহনের কষ্ট।