বন্ধুদের পাশে শান্তিতে ঘুমান, প্রিয় এভার্টন উইকস

ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান এভার্টন উইকস-ফাইল ছবি
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান এভার্টন উইকস-ফাইল ছবি

যেকোনো মৃত্যুই বেদনার। সেটি ৯৫ বছরে হলেই বা কি! এভার্টন উইকসের চলে যাওয়ার খবরটা পেয়েও মনে তাই বিষণ্নতার আঁকিবুঁকি। তাঁর সঙ্গে কোনো দিন দেখা না হলে কি এতটা হতো? মনে হয় না। দেখা হয়েছে একবারই। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের সময়। বারবাডোজে আনন্দমুখর এক সন্ধ্যা আরও রঙিন হয়ে উঠেছিল উইকসের আমুদে চরিত্রের কারণে। উইকসকে নিয়ে লিখতে বসার আগে সেই লেখাটা আবার পড়তে গিয়ে মনে হলো, দুয়েকটা জায়গায় একটু এদিক-ওদিক করে এটা তুলে দিলেই তো হয়! তাঁর ক্রিকেটীয় কীর্তি নিয়ে অনেক লেখাই হয়তো পড়ে ফেলেছেন এরই মধ্যে। নতুন আর কি-ইবা বলার আছে! মানুষ উইকসকে চেনার কাজটা বরং হয়ে যাবে এটি পড়লে। যেটির শিরোনামটাই বলে দেবে এভার্টন উইকসের জীবনদর্শন।

                                 *******

বারবাডোজ, ২০০৯
আনন্দধারা বহিছে উইকসের ভুবনে

—বাংলাদেশে নাকি খুব ভালো চিংড়ি পাওয়া যায়?
হ্যাঁ, তা পাওয়া যায়। কিন্তু আপনি তা জানলেন কীভাবে?
—গর্ডন গ্রিনিজ বলেছে।
এভার্টন উইকসের বয়স সাড়ে চুরাশি। দেখে তা বোঝার উপায় নেই। এখনো শক্তসমর্থ। চিংড়ি-টিংড়িও খাওয়া-নিষিদ্ধ তালিকায় ওঠেনি। কথাবার্তায় বুড়ো বয়সের অনিবার্য তিক্ততার বিন্দুমাত্রও অনুপস্থিত। বরং কথায় কথায় রসিকতা করেন।
ইন্টারভিউ পেতে সুবিধা হবে ভেবে বলেছি, ‘আমি আপনার ফ্যান’, চারপাশের হইচইয়ে উইকস ‘ফ্যান’—এর বদলে শুনলেন ‘ফ্রেন্ড’।
‘ফ্রেন্ড, তাহলে কি আমাকে বিয়ে করবে?’

কেউ কারও ফ্যান হলে বিয়ে করতে হবে কেন—এটা ভেবে আমি যখন হতচকিত, টেবিলের উল্টো দিকে বসা আরেক সাবেক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যান সিমুর নার্স শুধরে দিয়ে বললেন, ‘ও ফ্রেন্ড বলেনি, বলেছে ও তোমার ফ্যান।’
‘ও ফ্যান! মানে ওইটা’—বলে আঙুল ঘুরিয়ে ফ্যান আঁকলেন বাতাসে।

এভার্টন উইকসের সঙ্গে এই কথোপকথন একটা ডিনার পার্টিতে। যেটির উপলক্ষ স্যার গ্যারি সোবার্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল টুর্নামেন্টের উদ্বোধন। স্যার গ্যারিও আছেন। উইকসের টেবিলে সিমুর নার্স ছাড়াও সাবেক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলার চার্লি গ্রিফিথ। বাকিরাও সবাই টেস্ট ক্রিকেটার। বয়সে উইকসই সবার বড়। তারপরও তিনিই আড্ডার মধ্যমণি।

৪৮ টেস্টে ৫৮.৬১ গড়ে ৪৪৬৫ রান। এক হাজার রান হয়ে গিয়েছিল ১২ ইনিংসেই। টেস্ট ক্রিকেটে যা দ্রুততম এক হাজার রান করার রেকর্ড। যেটিতে অংশীদার ইংল্যান্ডের হার্বার্ট সাটক্লিফ। টেস্টের রান চার অঙ্কে নিয়ে যেতে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের একটা ইনিংস বেশি লেগেছিল।
একটা রেকর্ড অবশ্য এখনো শুধুই এভার্টন উইকসের। টেস্টে তাঁর ১৫টি সেঞ্চুরির ৫টি চার টেস্টের টানা পাঁচ ইনিংসে। টানা সেঞ্চুরির রেকর্ডটা ছয় ইনিংস হতো, হয়নি ষষ্ঠ ইনিংসে ৯০ রানে রান আউট হয়ে যাওয়ায়। সেটি ১৯৪৮ সালে ভারতের বিপক্ষে চেন্নাই টেস্টে। ক্রিকেট ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত রান আউট। ক্রিজের কোথায় চলে গিয়েছিলেন, হাত দিয়ে বাতাসে ছবি এঁকে তা দেখানোর পর উইকস হেসে বললেন, ‘আম্পায়ার ছাড়া মাঠের আর কারও কাছে ওটা রান আউট মনে হয়নি।’

এমন একটা কীর্তির দুয়ার থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে যে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, উইকস যেটিকে নিশ্চিত নট আউট বলে জানেন, তা নিয়ে কথা বলার সময়ও উইকসের কথায় তিক্ততার কোনো ছাপ নেই। বরং মুখে হাসি। সেটি কি ঘটনার পর এত বছর পেরিয়ে গেছে বলে?
মুখের হাসিটা আরেকটু বিস্তৃত করে উইকস বললেন, ‘না, না, আমি কখনোই এসব মনে পুষে রাখি না।’

২০০৯ সালে বাংলাদেশের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের সময় এভার্টন উইকসের সঙ্গে লেখক।-ফাইল ছবি
২০০৯ সালে বাংলাদেশের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের সময় এভার্টন উইকসের সঙ্গে লেখক।-ফাইল ছবি

ওই আম্পায়ারের সঙ্গে আর দেখা হয়নি?
‘হয়েছে কয়েকবার। নাইস জেন্টেলম্যান।’
সেই টেস্টে আম্পায়ার ছিলেন অনন্ত জোশি আর বালকৃষ্ণ মোহিনী। রান আউটটা কে দিয়েছিলেন, সেটি পর্যন্ত মনে করতে পারলেন না উইকস।
নিজের এত সব কীর্তি, অথচ ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় বলে মানেন যে অর্জনটাকে, সেটি ব্যক্তিগত কিছু নয়। তা হলো ১৯৫০ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডকে হারানো। এই সেই সফর, যাতে এর আগে অখ্যাত আলফ ভ্যালেন্টাইন ও সনি রামাধিন নামে দুই স্পিনারের ঘূর্ণিজাদুতে লর্ডসে একদা ‘প্রভু’দের বিপক্ষে জয় পেয়েছিল একদা ‘ক্রীতদাস’রা। রামাধিন-ভ্যালেন্টাইনকে নিয়ে বাঁধা হয়েছিল অমর ক্যালিপসো—দৌস টু লিটল প্যালস অব মাইন, রামাধিন অ্যান্ড ভ্যালেন্টাইন। উইকসের কাছে ওই জয়ের আসল তাৎপর্য অবশ্যই অন্য। ‘এর আগ পর্যন্ত সবাই ভাবত, আমরা বিভিন্ন দ্বীপের হ্যাপি গো লাকি চরিত্রের কিছু ক্রিকেটার একসঙ্গে মাঠে নামি, মজা করি, এ পর্যন্তই। ওই সফরেই প্রথম আমরা একটা দল হয়ে উঠলাম।’

সেই দল হয়ে ওঠায় আর সবার মতো উইকসও সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেন স্যার ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের নেতৃত্বগুণকে। আঠারো মাসের মধ্যে বারবাডোজের এক-দেড় মাইলের মধ্যে জন্মানো তিন ডব্লিউর মধ্যে তিনিই একমাত্র বর্তমান। ওরেল-ওয়ালকট-উইকস নাম তিনটি এমনই অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা যে, প্রতিদিনই কেউ না কেউ উইকসকে প্রয়াত দুই সতীর্থের কথা মনে করিয়ে দেয়। ‘আমার নিজেরও ওদের কথা খুব মনে পড়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলা শুরু করার অনেক আগে থেকেই তো আমরা খুব ভালো বন্ধু’—সতীর্থদের মধ্যে আরও কতজনকে বিদায় দিতে হলো, সেই নামগুলো বলার সময় এতক্ষণের আমুদে সুরে বিষণ্নতার ছোঁয়া লাগে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের গ্রেট ব্যাটসম্যানদের তালিকা করতে গেলে উইকসের নামটি তাতে রাখতেই হয়। জর্জ হেডলিকে দিয়ে শুরু, তালিকার পরের নামগুলো এমন—এভার্টন উইকস, গ্যারি সোবার্স, ভিভ রিচার্ডস, ব্রায়ান লারা। উইকস খুব মন দিয়ে নামগুলো শুনে বললেন, ‘হ্যাঁ, বিভিন্ন সময়কালের সেরা নির্বাচন করলে তালিকাটা হয়তো এমনই হবে।’ কিন্তু বলার পরই আরও অনেক নাম যোগ করতে শুরু করলেন, ‘রোহানকেও (কানহাই) রাখতে হবে। ক্লাইভ লয়েড, গর্ডন গ্রিনিজ....।’ ২৯ টেস্ট খেলা সিমুর নার্সকে দেখিয়ে বললেন, ‘৪০-৫০টা টেস্ট খেললে সে-ও এই তালিকায় থাকত।’

ক্রিকেট গ্রেটদের মধ্যে অন্যের প্রশংসায় এমন অকাতর লোক আর দেখিনি। তাঁর সময়ের অন্য অনেক ব্যাটসম্যানদের নিয়ে যেমন, তেমনি তাঁর পরের অনেককে নিয়েও একই রকম মুগ্ধতা। টেন্ডুলকার-লারা-পিটারসেন সবারই গুণমুগ্ধ তিনি। কে সেরা, এই আলোচনাতেই যেতে রাজি নন, ‘আসলে ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এ এক নম্বর-ও দুই নম্বর, এভাবে বলাটা কঠিন। একেকজনের একেক স্টাইল, কে কোন স্টাইলটা পছন্দ করে, সেটিই হলো কথা।’

বারবাডোজের থ্রি ডব্লিউস ওভাল মাঠের পাশে তিন বন্ধু ফ্র্যাঙ্ক ওরেল, ক্লাইড ওয়ালকট ও এভার্টন উইকসের আবক্ষ মূর্তি। -ফাইল ছবি
বারবাডোজের থ্রি ডব্লিউস ওভাল মাঠের পাশে তিন বন্ধু ফ্র্যাঙ্ক ওরেল, ক্লাইড ওয়ালকট ও এভার্টন উইকসের আবক্ষ মূর্তি। -ফাইল ছবি

তাঁর সময়ে ক্রিকেট খেলে টাকা-পয়সা তেমন পাওয়াই যেত না। এখন বছর না ঘুরতেই অনেক ক্রিকেটারকে কোটিপতি হয়ে যেতে দেখেও তাঁর কোনো আফসোস হয় না। বরং তিনি তাঁদের আনন্দেই আনন্দিত। নিজের সময়টাই ভালো ছিল, এখন সব উচ্ছন্নে যাচ্ছে—সাবেক খেলোয়াড়দের প্রায় অনিবার্য এই রোগ থেকে একেবারেই মুক্ত এভার্টন উইকস। টেন্ডুলকার সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত (‘ইতিহাসে ওর চেয়ে ভালো ব্যাটিং কেউ করেছে কি না সন্দেহ’)। লারা তাঁর কাছে রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা (‘ওর ব্যাটিংয়ে অন্যরকম একটা মাদকতা ছিল’)। উইকসের কাছে টি-টোয়েন্টি যুগের ক্রিকেটও সুন্দর, সুন্দর বদলে যাওয়া পৃথিবীটাও।

মুগ্ধ হলাম, কিন্তু প্রশ্নটা না করে পারলাম না।
কারও বিরুদ্ধেই দেখি আপনার কোনো অভিযোগ নেই, কোনো কিছু নিয়েই তিক্ততা নেই, রহস্যটা কী?
মুখে হাসি ফুটিয়ে উইকস কী বললেন, জানেন?
‘এই পৃথিবীটা এত সুন্দর! এই সুন্দর পৃথিবীর বাতাসে কেন আমি বিষ ছড়াব!’

                                 *******

ঢাকা, ২০২০
প্রিয় এভার্টন উইকস,

‘প্রিয়’ বলে সম্বোধন করার মতো ঘনিষ্ঠতা আপনার সঙ্গে হয়নি। দেখাই তো হয়েছে মাত্র একবার। কিন্তু আপনার আমুদে চরিত্র প্রথম দেখাতেই এমন আপন করে নিয়েছিল যে, প্রিয় সম্বোধন করতে একটুও বাঁধছে না।
আপনি অনন্তলোকে চলে যাওয়ার প্রায় সব খবরের সঙ্গে যে ছবিটা ছাপা হচ্ছে, সেই কুঞ্চিত মুখটাও যে কারণে আমি মনে রাখতে চাই না। মনে রাখতে চাই সেই ছবিটা, খবরটা পাওয়ার পর থেকেই যেটি আমার চোখে ভাসছে। প্রায় এগারো বছর আগে দেখা আপনার সেই আমুদে মুখচ্ছবি। স্লাইড শোর মতো একের পর এক আরও কয়েকটা ছবি আসছে এরপর। পাশাপাশি তিনটি স্তম্ভের ওপর তিনটি আবক্ষ মূর্তি। শ্বেতপাথরে বাঁধানো দুটি সমাধি। নরম সবুজ ঘাসে ছেয়ে থাকা মাঠের এক পাশের ওই উঁচু জায়গাটা। যেটিতে ছোট ছোট গাছ, যার কয়েকটি ফুলও ফুটিয়েছে।

আপনাদের তিন বন্ধুর নামেই ওই মাঠের নাম। থ্রি ডব্লিউস ওভাল। ওই আবক্ষ মূর্তি তিনটিও আপনাদের তিন বন্ধুর। বারবাডোজের উপকণ্ঠে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্ট ইন্ডিজের কেভ হিল ক্যাম্পাসের ওই মাঠে আপনি অনেকবারই তো গিয়েছেন। ২০০৭ বিশ্বকাপের সময় আমি যেমন ওই দুটি সমাধির সামনে গিয়ে নীরব হয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, আপনিও তো অমন কতই থেকেছেন। অস্ফুটে কি এটাও বলেছেন, ‘বন্ধু, অপেক্ষা করো, আমিও আসছি।’ শেষ ঠিকানাটা তো আপনি নিজের চোখেই দেখেছেন অনেকবার। ফ্র্যাঙ্ক ওরেল আর ক্লাইড ওয়ালকটের সমাধির পাশেই আপনার শেষ শয্যার বন্দোবস্ত। সেখানেই তো আছেন এখন, তাই না?
প্রিয় দুই বন্ধুর পাশে শান্তিতে ঘুমান, প্রিয় এভার্টন উইকস। শান্তিতে ঘুমান।