ব্রাজিলিয়ানরা টাকা ছাড়া কিছুই বোঝে না, নেইমার সম্পর্কে আরেক ব্রাজিলিয়ান

২০১৭ সালের আগস্টে দলবদলের বিশ্বরেকর্ড ২২ কোটি ২০ লাখ ইউরোতে পিএসজিতে গেছেন নেইমার। ছবি: এএফপি
২০১৭ সালের আগস্টে দলবদলের বিশ্বরেকর্ড ২২ কোটি ২০ লাখ ইউরোতে পিএসজিতে গেছেন নেইমার। ছবি: এএফপি

নেইমার নিজে তখন বলেছিলেন, পিএসজিকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতাতে বার্সেলোনা ছেড়ে এসেছেন। অনেক বিশ্লেষকের চোখে, লিওনেল মেসির ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজের মতো করে একটা দলের প্রাণভোমরা হতেই ২০১৭ সালের আগস্টে বার্সেলোনা ছেড়ে প্যারিসে পাড়ি জমিয়েছিলেন নেইমার। অনেকে অর্থের প্রসঙ্গও তুলে আনেন। পিএসজিতে বেতনের অঙ্কটা ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডকে মেসির পর বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেতনভোগী ফুটবলার বানিয়ে রেখেছে, সঙ্গে নতুন নতুন অনেক স্পনসরশিপ চুক্তি তো এসেছেই!

ব্রাজিলের সাবেক মিডফিল্ডার ও ফ্রি-কিকের 'শিল্পী' জুনিনহো পেরনামবুকানোও দেখা যাচ্ছে এই ভাবনারই অনুসারী। তাঁর কথা, ব্রাজিলিয়ানদের ছোটবেলা থেকে শেখানোই হয় এমনভাবে যে, তাঁরা টাকা ছাড়া কিছু বোঝেন না। সেটির উদাহরণ টানতে গিয়েই বললেন, টাকার জন্যই নেইমার পিএসজিতে গেছেন!

ইংলিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টার সাক্ষাৎকারে মূলত ব্রাজিলের সংস্কৃতি, করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ব্রাজিলের চরম ব্যর্থতা, ব্রাজিলের বর্ণবাদ পরিস্থিতি আর বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডানপন্থী জেয়ার বোলসোনারোর অধীনে ব্রাজিলের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতির অবনতি নিয়েই কথা বলেছেন জুনিনহো। সাক্ষাৎকারে আধাঘন্টা পেরোতেই দেশের করুণ অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে কেঁদেও ফেলেছেন!

এক সময়ে ফ্রান্সের ক্লাব অলিম্পিক লিওঁতে আলো ছড়ানো জুনিনহো বর্তমানে ক্লাবটার ক্রীড়া পরিচালক। ব্রাজিলে দুবছর ধরে আর যাওয়া হয় না, ফ্রান্সেই থাকেন। দূর থেকেই দেখছেন ব্রাজিলের করোনা পরিস্থিতির দুর্দশা। যুক্তরাষ্ট্রের পর করোনা আক্রান্তের সংখ্যায় দ্বিতীয় ব্রাজিল এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হতে দেখেছে ১৬ লাখেরও বেশি, প্রতিদিন নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন ৫০ হাজারের মতো মানুষ। এর পেছনে অনেকে প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর ভুল পদক্ষেপের দায় দেখেন। গার্ডিয়ানে সাক্ষাৎকারে জুনিনহোও বলছিলেন, 'খুব হতাশ লাগে। আমরা সবকিছুই ভুল করছি। সারা বিশ্ব যা করছে, তার উল্টোটা করছি। আমি একজন ব্রাজিলিয়ান, জানি আমার দেশটা গরিব, খেয়ে-পরে বাঁচতে হলে মানুষকে কাজে নামতে হবে। কিন্তু আমরা যদি ঠিকঠাক লকডাউন আরোপ করতাম, হয়তো এই পরিস্থিতির (করোনাভাইরাসের সংক্রমণ) শেষের কাছাকাছি চলে আসতাম এতদিনে। দেশটার দিকে তাকালে এখন অসহায় লাগে।'

সাক্ষাৎকারে বারবারই ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো ও তাঁর অপরাজনীতির কথা বলছিলেন জুনিনহো। তাঁর চোখে, ফেসবুক-টুইটার-ইউটিউবে 'ফেইক নিউজ' বা ভুয়া সংবাদ ছড়িয়েই ২০১৮ সালের নির্বাচনে জিতেছেন বোলসোনারো। সেই নির্বাচনের সময় থেকেই আর দেশে যান না বলেও জানালেন। এমনকি বোলসোনারো ও তাঁর রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় মতবিভেদের কারণে আত্মীয়দের ৮০-৯০ শতাংশের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও নেই!

বোলসোনারোর সময়ে ব্রাজিলে ধনী-গরিবের ব্যবধান দিনে দিনে অনেক বাড়ছে, সে কারণে দিনে দিনে সহিংসতাও বাড়ছে জানিয়ে জুনিনহোর কথা, 'সংবাদমাধ্যম যদি সত্যি কথাটা তখন লিখত, বোলসোনারো কোনোদিনই নির্বাচিত হতো না। ৪ কোটি ২০ লাখ ভোটার ভোটই দেননি তখন!

সেখান থেকে আলোচনা গড়াল গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার অভিযোগ ও এরপর থেকে চলমান বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের দিকে। ব্রাজিলে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ অনেকই আছেন, কিন্তু বর্ণবাদের অভিযোগ সে দেশটিকেও ঘিরে আছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রিওর বস্তিতে আট বছরের ছোট্ট মেয়ে আগাথা ফেলিক্সকে গুলি করে মারে পুলিশ। গত মাসেই জোয়াও পেদ্রো নামের ১৪ বছরের এক কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর মারা গেছে পুলিশের হাতে। এর মধ্যে ব্রাজিলে বর্ণবাদ নেই বোঝাতে প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর ছেলে ও সাংসদ এদুয়ার্দো বোলসোনারো কিছুদিন আগে বলেন, ব্রাজিলে কোনো 'জর্জ ফ্লয়েড' নেই! সেটি নিয়ে জুনিনহোর কথা, 'ব্রাজিলে হাজারে হাজারে জর্জ ফ্লয়েড আছে!'

ব্রাজিলের এত সমস্যা তো আর একদিনে হয়নি। এসবের মূলে হয়তো আছে অর্থকেই সবকিছু মেনে বড় হওয়ার মনোভাব। জুনিনহোর কথা, খেলোয়াড়ি জীবনে ব্রাজিল ছেড়ে ইউরোপে এসেছিলেন বলেই অনেক কিছু শিখতে পেরেছেন। কী শিখেছেন? 'ব্রাজিলে আমাদের শেখানো হয়, অর্থই সবকিছু, অর্থ ছাড়া আর কিছু বোঝার দরকার নেই। কিন্তু ইউরোপে মনোভাবটা ভিন্ন। আমিও না ভেবেচিন্তেই ক্যারিয়ারের পরিকল্পনা সাজিয়েছিলাম, চেয়েছিলাম ব্রাজিলে আরেকটা বড় ক্লাবে যেতে। সেটা শুধু খেলার জন্যই নয়। আমাকে শেখানো হয়েছিল, যেখানে বেশি টাকা দেবে, সেই ক্লাবে যেতে। ব্রাজিলিয়ান চিন্তাভাবনাই এরকম' – বললেন জুনিনহো।

সে প্রসঙ্গেই নেইমারকে টেনে এনেছেন 'ফ্রি-কিক মাস্টার'খ্যাত সাবেক এই ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার, 'নেইমারকেই দেখুন। ও শুধু অর্থের লোভেই পিএসজিতে গেছে। পিএসজি ও যা চেয়েছে, ওকে সবকিছু দিয়েছে। কিন্তু এখন ও চুক্তি শেষ না করেই ক্লাব ছাড়তে চায়। অথচ এখন ওর সময় এসেছে ক্লাবকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার, কৃতজ্ঞতা দেখানোর। ব্যাপারটা তো দুই পক্ষের (ক্লাব ও খেলোয়াড়) দেওয়া-নেওয়ার, তাই না? নেইমারের উচিত মাঠে সবকিছু উজাড় করে দেওয়া। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে ব্রাজিলে সমাজব্যবস্থাটাই এমন, লোভের সংস্কৃতি সেখানে, সব সময় আরও বেশি অর্থ চায়। এটাই আমাদের শেখানো হয়, এটাই শিখি আমরা।'

তাহলে দোষটা নেইমারের, নাকি ব্রাজিলিয়ান ব্যবস্থার – সাক্ষাৎকারে এমন প্রশ্নে জুনিনহোর উত্তর, 'এখানে খেলোয়াড় নেইমার আর মানুষ নেইমারের পার্থক বুঝতে হবে। খেলোয়াড় হিসেবে ও বিশ্বের সেরা তিনের একজন, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও লিও মেসির সমপর্যায়ের। কিন্তু মানুষ হিসেবে ও দোষী, কারণ ওর নিজেকে নিজে এসব ব্যাপারে প্রশ্ন করা উচিত, বড় মানুষ হওয়া উচিত। এই মুহূর্তে ও শুধু তা-ই করে যাচ্ছে, যা ও শিখে এসেছে।'

জুনিনহো অর্থের কথা বললেও স্পেন ও ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যমে গুঞ্জন, নেইমার বার্সেলোনায় ফিরতে এতটাই উন্মুখ যে, প্রয়োজনে পিএসজিতে যে বেতন পান, বার্সেলোনায় তার চেয়ে কম নিতেও রাজি তিনি!