রিয়ালের প্রথম 'গ্যালাকটিকোস', গুটমানের 'অভিশাপ' ও টোটাল ফুটবল

রিয়ালের সর্বজয়ী সে দল। ছবি: রিয়াল মাদ্রিদ
রিয়ালের সর্বজয়ী সে দল। ছবি: রিয়াল মাদ্রিদ
>কোনো দলের রাজত্ব ছিল দেশের ফুটবলে, কোনো দল আবার দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে মহাদেশীয় পর্যায়ের পরাশক্তি, জায়গা করে নিয়েছে ফুটবল ইতিহাসেও। ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে তেমন কিছু দলের গল্প।


তিরিশ বছরের আক্ষেপ ঘুচিয়েছে লিভারপুল, কয়েক সপ্তাহ আগে। গত বছর চ্যাম্পিয়নস লিগ, চলতি মৌসুমের শুরুতে উয়েফা সুপার কাপ ও ক্লাব বিশ্বকাপ জেতা দলটা সাফল্যের ষোলোকলা পূর্ণ করেছে ইংলিশ লিগ জেতার মাধ্যমে, যে শিরোপা অধরা ছিল তিন দশক ধরে। ইয়ুর্গেন ক্লপের দলটাকে দশকের সময়ের অন্যতম সেরা বলছেন অনেকেই। কারও কারও মতে, ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে এই লিভারপুল হতে পারে ইতিহাসের অন্যতম সেরাও। পারবে কি না, সেটা সময়ই বলবে।
ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে বিভিন্ন সময় ঘরোয়া কিংবা মহাদেশীয় পর্যায়ে রাজত্ব করা এমন কিছু দলের গল্প নিয়ে এই ধারাবাহিক। প্রথম পর্বে থাকছে দিগ্বিজয়ী সাত ক্লাবের কীর্তির কথা-

তুরিনো ১৯৪৫-১৯৪৯
উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় : ভ্যালেন্তিনো মাজোলা, পিয়েত্রো ফেরারিস, গিউলিয়েলমো গাবেতো, রোমেও মেন্তি, ভার্জিলিও মারোসো
উল্লেখযোগ্য শিরোপা : ইতালিয়ান লিগ (৪)
আপনাকে যদি বলা হয়, নিজেদের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের পথে পেলে-গারিঞ্চা, ভাভা কিংবা মারিও জাগালোদের অনুপ্রেরণা ছিল তুরিনো, বিশ্বাস করবেন? অথচ এটাই হয়েছিল। সিরি 'আ'তে তখন তুরিনোর জয়জয়কার। টানা চারবার লিগ জিতেছেন মাজোলা, ফেরারিস, মেন্তিরা। সমর্থকেরা ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন 'গ্রান্দে তুরিনো' (দ্য গ্রেট তুরিনো)। সে দলটা খেলত ৪-২-৪ ছকে, যে ছকটাই ব্রাজিল পরে আত্মস্থ করে নেয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বেনফিকার সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ খেলে ফেরার সময় বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে দলটা। সুপারগার সেই দুর্ঘটনায় তুরিনোর যে ১৮ জন ফুটবলার মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের ১০ জনই তখন খেলেন ইতালির জাতীয় দলে!

বিশ্ব ফুটবলকে নতুন কিছু উপহার দিয়েছিল আয়াক্স। ছবি: টুইটার
বিশ্ব ফুটবলকে নতুন কিছু উপহার দিয়েছিল আয়াক্স। ছবি: টুইটার

বুদাপেস্ট হোনভেদ ১৯৫০-১৯৫৫
উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় : ফেরেঙ্ক পুসকাস, স্যান্দর ককসিস, জোলতান জিবোর, জিউলা গ্রোসিকস, জোসেফ বোজসিক
উল্লেখযোগ্য শিরোপা : হাঙ্গেরিয়ান লিগ (৫)
পেলে-গারিঞ্চাদের অনুপ্রেরণাদায়ী দলের নাম বলতে গেলে তুরিনোর পাশাপাশি আরেকটা দলের নাম বলতেই হবে। সেটা পঞ্চাশের দশকের সেই বিখ্যাত হাঙ্গেরি দল - 'ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স' নামেই যাদের পরিচিতি সবচেয়ে বেশি। হাঙ্গেরির ওই জাতীয় দলটা আবার ছিল বুদাপেস্ট হোনভেদের প্রতিচ্ছবি। দেশীয় লিগে তখন বুদাপেস্টের জয়জয়কার, পুসকাস-ককসিসরা লিগ জিতেছেন পাঁচবার। নতুন নতুন ফুটবলীয় কৌশলের আঁতুড়ঘর ছিল তখন ক্লাবটা। নিজের পজিশন ছাড়াও যে খেলোয়াড়েরা মাঠের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে প্রতিপক্ষকে তাক লাগিয়ে দিতে পারেন, ব্যাপারটা পুসকাসরাই প্রথম দেখিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য, এই দলের অনেক খেলোয়াড় নিয়েও হাঙ্গেরির ১৯৫৪ বিশ্বকাপ জেতা হয়নি। ফাইনালে ওরা হেরে গিয়েছিল জার্মানির কাছে।

রিয়াল মাদ্রিদ ১৯৫৫-১৯৬০
উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় : আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, পাকো গেন্তো, ফেরেঙ্ক পুসকাস, রেমন্ড কোপা, দিদি
উল্লেখযোগ্য শিরোপা : ইউরোপিয়ান কাপ (৫), স্প্যানিশ লিগ (৩), ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ (১)
রিয়ালের এই দলটা ফুটবলীয় রূপকথার অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর হবে না-ই না কেন? কটা দল টানা পাঁচবার ইউরোপিয়ান কাপ (এখনকার চ্যাম্পিয়নস লিগ) জেতে? তবে ফুটবলীয় কৌশলের কথা বাদ দিলে, এ দল আরেকটা দিকে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বিশ্বের বড় বড় তারকাকে এক ছাদের তলায় এনে ক্লাবকে যে একটা বৈশ্বিক ব্র্যান্ডে রূপ দেওয়া যায়, সেটা এই দলই দেখিয়েছিল। বিশ্ব দেখেছিল 'গ্যালাকটিকোস' বা 'মহাতারকা মেলা'র প্রথম অধ্যায়।

বেনফিকা ১৯৫৯-১৯৬৮
উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় : ইউসেবিও, মারিও কোলুনা, হোসে আগুয়াস, মারিও হোয়াও, অ্যানহেলো মার্তিনস
উল্লেখযোগ্য শিরোপা : পর্তুগিজ লিগ (৮), পর্তুগিজ কাপ (৪), ইউরোপিয়ান কাপ (২)
হাঙ্গেরির প্রভাব ছিল এ দলেও। প্রজ্ঞাবান হাঙ্গেরিয়ান কোচ বেলা গুটমান বেনফিকায় এসেই খেলোয়াড়দের বলেছিলেন, 'মানুষজন টাকা দিয়ে তোমাদের খেলা দেখতে এসেছে, তাঁদের আনন্দ দাও।' সে কাজটাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন ইউসেবিও, কোলুনারা। কথিত আছে, পরে বেতন বৃদ্ধি সংক্রান্ত জটিলতায় এই গুটমান ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার সময় বেনফিকাকে অভিশাপ দেন, পরের এক শ বছরেও বেনফিকা ইউরোপসেরা হতে পারবে না। সেটাই হচ্ছে! গুটমান যাওয়ার পর এখনো ইউরোপসেরা হয়নি পর্তুগালের দলটা।

ইন্টার মিলান ১৯৬২-১৯৬৭
উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় : লুইস সুয়ারেজ, সান্দ্রো মাজোলা, জাইর, মারিও করসো, আরমান্দো পিচ্চি, জিয়াচিন্তো ফাচেত্তি
উল্লেখযোগ্য শিরোপা : ইতালিয়ান লিগ (৩), ইউরোপিয়ান কাপ (২), ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ (২)
বিশ্ববিখ্যাত রক্ষণাত্মক কৌশল 'কাতেনাচ্চিও'র স্বর্ণযুগ তখন। আর্জেন্টিনার কোচ হেলেনিও হেরেরা যেভাবেই হোক জিততে চাইতেন। দলের খেলা দেখতে বাজে লাগুক, ব্যাপার না। হেরেরাই ছিলেন ইন্টারে কাতেনাচ্চিও আনার মূল কারিগর। জনমনে ইতালির ফুটবল নিয়ে এখনো যে ধারণাটা কাজ করে, সেটা এই হেরেরাই গড়ে দিয়ে গেছেন। দমবন্ধ করা রক্ষণ করতে করতে সুযোগ পেলেই বিদ্যুৎগতির প্রতি আক্রমণ, ইন্টারের সাফল্যের রেসিপি ছিল এটাই।

বেকেনবাওয়াররা ক্লাবের সাফল্য জাতীয় দলেও টেনে নিয়েছিলেন। ছবি: টুইটার
বেকেনবাওয়াররা ক্লাবের সাফল্য জাতীয় দলেও টেনে নিয়েছিলেন। ছবি: টুইটার

আয়াক্স আমস্টারডাম ১৯৬৫-১৯৭৩
উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় : ইয়োহান ক্রুইফ, ইয়োহান নিসকেন্স, আরি হান, জেরি মুহরেন, ভেলিবোর ভাসোভিচ
উল্লেখযোগ্য শিরোপা : ডাচ লিগ (৬), ডাচ কাপ (৪), ইউরোপিয়ান কাপ (৩), ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ (১), উয়েফা সুপার কাপ (১)
৪-৩-৩ ছক হলেও সব খেলোয়াড় করতে পারবে সব কাজ। অবস্থান হবে ক্রমশ পরিবর্তনশীল। কোচ রাইনাস মিশেলসের এই অব্যর্থ টোটকা মাঠে কাজে লাগাতেন ক্রুইফ-নিসকেন্সরা। পরে মিশেলস চলে গেলেও স্টেফান কোভাৎস দলের নির্যাস একই রেখেছেন। ফলাফল? টানা তিনটি ইউরোপিয়ান কাপ। ১৯৭৪ বিশ্বকাপের ফাইনালেও উঠেছিল হল্যান্ড। কিন্তু হাঙ্গেরির মতো তাঁদের সঙ্গী হয়েছে হতাশা।

বায়ার্ন মিউনিখ ১৯৬৭-১৯৭৬
উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় : ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, জার্ড মুলার, সেপ মাইয়ার, উলি হোয়েনেস, পল ব্রাইটনার
উল্লেখযোগ্য শিরোপা : জার্মান লিগ (৪), জার্মান কাপ (৩), ইউরোপিয়ান কাপ (৩), কাপ উইনার্স কাপ (১), ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ (১)
জার্মানি তো দূর, মিউনিখের সেরা ক্লাবই তখন ছিল না বায়ার্ন। ১৮৬০ মিউনিখের দিকেই তখন সব আলো, এদিকে লোকচক্ষুর আড়ালে বায়ার্ন পরিচর্যা করতে থাকল দুই তরুণ বেকেনবাওয়ার আর মাইয়ারকে। ১৮৬০ মিউনিখে জায়গা না পেয়ে বায়ার্নে কিছুদিন পর যোগ দিলেন জার্ড মুলার। পরের গল্পটা নিজেদের ইতিহাস নতুন করে লেখার। ক্লাবের তো বটেই, জার্মান জাতীয় দলেরই খোলস বদলে দিয়েছিলেন বেকেনবাওয়াররা। তিনবার ইউরোপিয়ান কাপ জয়ের পর বেকেনবাওয়ার-মুলাররা জার্মানিকে এনে দিয়েছেন ১৯৭৪ বিশ্বকাপও।
(চলবে)