গার্দিওলার বার্সেলোনা, জিদানের রিয়াল এবং অপ্রতিরোধ্য আরও যারা

পাঁচ বছরে চারবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে দেখিয়েছিল জিদানের রিয়াল মাদ্রিদ। ছবি : টুইটার
পাঁচ বছরে চারবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে দেখিয়েছিল জিদানের রিয়াল মাদ্রিদ। ছবি : টুইটার
>

কোনো দলের রাজত্ব ছিল দেশের ফুটবলে, কোনো দল আবার দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে মহাদেশীয় পর্যায়ের পরাশক্তি, জায়গা করে নিয়েছে ফুটবল ইতিহাসেও। ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে তেমন কিছু দলের গল্প

তিরিশ বছরের আক্ষেপ ঘুচিয়েছে লিভারপুল, কয়েক সপ্তাহ আগে। গত বছর চ্যাম্পিয়নস লিগ, চলতি মৌসুমের শুরুতে উয়েফা সুপার কাপ ও ক্লাব বিশ্বকাপ জেতা দলটা সাফল্যের ষোলোকলা পূর্ণ করেছে ইংলিশ লিগ জেতার মাধ্যমে, যে শিরোপা অধরা ছিল তিন দশক ধরে। ইয়ুর্গেন ক্লপের দলটাকে দশকের সময়ের অন্যতম সেরা বলছেন অনেকেই। কারও কারও মতে, ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে এই লিভারপুল হতে পারে ইতিহাসের অন্যতম সেরাও। পারবে কি না, সেটা সময়ই বলবে।

ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে বিভিন্ন সময় ঘরোয়া কিংবা মহাদেশীয় পর্যায়ে রাজত্ব করা এমন কিছু দলের গল্প নিয়ে এই ধারাবাহিক। শেষ পর্বে থাকছে আরও ছয় ক্লাবের কীর্তির কথা-

জুভেন্টাস ১৯৯৪-৯৮
উল্লেখযোগ্য তারকা: আলেসসান্দ্রো দেল পিয়েরো, আন্তোনিও কন্তে, জিনেদিন জিদান, দিদিয়ের দেশম, অ্যানহেলো পেরুজ্জি
উল্লেখযোগ্য শিরোপা: ইতালিয়ান লিগ (৩), চ্যাম্পিয়নস লিগ (১), কোপা ইতালিয়া (১), উয়েফা সুপার কাপ (১), ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ (১)
স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের মতো কিংবদন্তি চাইতেন তাঁর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড যেন এই জুভেন্টাসের মতো খেলে। ইউরোপের বাকী দলগুলোর ওপর ইতালিয়ান চ্যাম্পিয়নদের প্রভাব তখন এতটাই ছিল। ভাগ্য আরেকটু সহায় হলে হয়তো টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠে তিনবারই শিরোপা জিততে পারতেন জিদান-দেল পিয়েরোরা। কিন্তু তাতে তাঁদের পরাক্রম কমেনি মোটেও। মার্সেলো লিপ্পির জাদুকরেরা নিজেদের নাম ঠিকই লিখে রেখেছেন ইতিহাসের পাতায়।

ইউনাইটেডের ট্রেবলজয়ী সে দলটাকে এখনও সেরা দল হিসেবে অনেকে বলে থাকেন। ছবি : বার্সেলোনা ওয়েবসাইট
ইউনাইটেডের ট্রেবলজয়ী সে দলটাকে এখনও সেরা দল হিসেবে অনেকে বলে থাকেন। ছবি : বার্সেলোনা ওয়েবসাইট

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ১৯৯৫-২০০১
উল্লেখযোগ্য তারকা: ডেভিড বেকহাম, পল স্কোলস, পিটার স্মাইকেল, রয় কিন, রায়ান গিগস
উল্লেখযোগ্য শিরোপা: ইংলিশ লিগ (৫), এফএ কাপ (২), কমিউনিটি শিল্ড (২), চ্যাম্পিয়নস লিগ (১), ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নিজের দেশে সেরা ক্লাব তো ছিলই, জুভেন্টাসের কাছে শিক্ষা নিয়ে ইউরোপেও হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। একটা দিক দিয়ে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের এই দলটার সঙ্গে সত্তরের দশকের বায়ার্নের একটু মিল পাওয়া যায়। সে দলটা যেমন লোকচক্ষুর আড়ালে আস্তে আস্তে বেকেনবাওয়ার, মাইয়ার, মুলারদের গড়ে তুলছিল, পরে হয়েছিল বিশ্বসেরা, একই কাজ ইউনাইটেডে করেছেন ফার্গুসন, তাঁর আনকোরা 'ক্লাস অফ ৯২' এর গ্র্যাজুয়েটদের নিয়ে। বেকহাম, গিগস, স্কোলস বা নেভিলদের শুরুটা সেখানেই।

বোকা জুনিয়র্স ১৯৯৮-২০০৩
উল্লেখযোগ্য তারকা: হুয়ান রোমান রিকেলমে, মার্টিন পালের্মো, ওয়াল্টার স্যামুয়েল, গিলের্মো ব্যারোস স্কেলোত্তো, নিকোলাস বুরদিসো
উল্লেখযোগ্য শিরোপা: কোপা লিবের্তাদোরেস (৩), আর্জেন্টাইন লিগ (৪), ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ
কোচ কার্লোস বিয়াঞ্চি যখন বোকার দায়িত্ব নিলেন, দেড় দশক ধরে বলতে গেল একরকম শিরোপাশূন্য সময় কাটাচ্ছিল আর্জেন্টিনার অন্যতম জনপ্রিয় এই ক্লাবটা। পরে হুয়ান রোমান রিকেলমে আর মার্টিন পালের্মোকে ঘিরে গড়ে তুললেন দুর্ধর্ষ এক স্কোয়াড। ষাট ও সত্তরের দশকে টানা তিনবার, চারবার করে কোপা লিবের্তাদোরেস জেতা এস্তুদিয়ান্তেস ও ইন্দিপেন্দিয়েন্তের স্মৃতি ফিরিয়ে আনলো বোকা। নিজেরা জিতল টানা তিনবার। ওদিকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে রিয়াল মাদ্রিদ ও এসি মিলানের মতো ক্লাবগুলো বশ মানল তাঁদের কাছে। আর রিকেলমে হয়ে গেলেন কিংবদন্তি!

আর্সেনাল ২০০৩-০৬
উল্লেখযোগ্য তারকা: থিয়েরি অঁরি, ডেনিস বার্গক্যাম্প, রবার্ট পিরেস, সল ক্যাম্পবেল, প্যাট্রিক ভিয়েরা
উল্লেখযোগ্য শিরোপা: ইংলিশ লিগ (১), এফএ কাপ (২), কমিউনিটি শিল্ড (১)
গোটা লিগ মৌসুম অপরাজিত থাকা, কয়টা ক্লাব পারে? আর্সেনাল সেই অসাধ্যটাই সাধন করেছিল ২০০৩-০৪ মৌসুমে। অঁরি-পিরেসের গতির সঙ্গে বার্গক্যাম্পের বুদ্ধিমত্তা, ক্যাম্পবেল-কোলদের দৃঢ় রক্ষণভাগ ও প্যাট্রিক ভিয়েরার নেতৃত্বগুণ–ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকার জন্য আর কী লাগে? নিজেদের ইতিহাসের সেরা সময়টা আর্সেনাল তখনই কাটিয়েছে। তাও আবার অপরাজিত হয়ে। দুর্দান্ত দলটা হয়তো কয়েক বছর পর চ্যাম্পিয়নস লিগও জিতত, বার্সেলোনা সেটা হতে দেয়নি।

গার্দিওলার সেই দুর্ধর্ষ বার্সেলোনা। ছবি : এএফপি
গার্দিওলার সেই দুর্ধর্ষ বার্সেলোনা। ছবি : এএফপি

বার্সেলোনা ২০০৮-১১
উল্লেখযোগ্য তারকা: লিওনেল মেসি, জাভি হার্নান্দেজ, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, থিয়েরি অঁরি, কার্লোস পুয়োল, স্যামুয়েল ইতো
উল্লেখযোগ্য শিরোপা: স্প্যানিশ লিগ (৩), কোপা দেল রে (১), স্প্যানিশ সুপার কাপ (৩), চ্যাম্পিয়নস লিগ (২), উয়েফা সুপার কাপ (২), ক্লাব বিশ্বকাপ (২)
ক্রুইফের সেই বিখ্যাত 'ড্রিম টিম'কে আদর্শ মানা পেপ গার্দিওলা প্রিয় ক্লাব বার্সেলোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০০৮ সালে। তখন আনকোরা এই কোচের ওপর কেউ বিশ্বাস না রাখলেও এক বছর পর সবাইকে চমকে দেন গার্দিওলা। একের পর এক জিততে থাকেন শিরোপা। মাঠের মধ্যে মেসি-জাভি-ইনিয়েস্তারা ফুটবল শিল্পের অনিন্দ্যসুন্দর পসরা সাজাতেন যেন। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের মতো ম্যানেজার দুবারের চেষ্টায় এই বার্সার কাছ থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা ছিনিয়ে নিতে পারেননি। 'আমি আমার জীবনে কোন দলকে দেখিনি যাদের খেলা দেখে আমার মনে হয়েছে লুকিয়ে পড়ি কোথাও', ফার্গুসনের এই এক কথাতেই ফুটে ওঠে কতটা পরাক্রমশালী ছিল গার্দিওলার সেই বার্সা।

রিয়াল মাদ্রিদ ২০১৪-১৮
উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড়: ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, টনি ক্রুস, লুকা মদরিচ, সার্জিও রামোস, করিম বেনজেমা
উল্লেখযোগ্য শিরোপা: চ্যাম্পিয়নস লিগ (৪), স্প্যানিশ লিগ (১), কোপা দেল রে (১), উয়েফা সুপার কাপ (৩), স্প্যানিশ সুপার কাপ (১), ক্লাব বিশ্বকাপ (৪)
এ যুগে যেখানে চ্যাম্পিয়নস লিগ পরপর দুবার জেতাই কষ্টকর, সেখানে রিয়াল মাদ্রিদই দেখিয়েছে কীভাবে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের হ্যাটট্রিক করা যায়! জিনেদিন জিদানের দলটা মনভোলানো ফুটবল খেলে, এ কথা বলার মতো তেমন মানুষ না পাওয়া গেলেও, তাঁদের খেলার ধরণ যে অত্যন্ত কার্যকরী ছিল এই সময়ে, সেটা অস্বীকার করার মানুষ পাওয়া যাবে খুব কম। সব মিলিয়ে পাঁচ বছরের সময়কালে চারবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা রিয়ালের এই কীর্তি কে কবে ভাঙবে, কেউ বলতে পারে না!