পত্রিকার একটি সংবাদ ও সেরা ফুটবল ব্যর্থতার গল্প

সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনেই মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল নেদারল্যান্ডস
সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনেই মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল নেদারল্যান্ডস

সংবাদপত্রের একটা শিরোনাম কী কোনো দলের ভাগ্য বদলে দিতে পারে? ধরুন, কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে নির্দিষ্ট কোনো দলের সমালোচনা কিংবা তাদের নিয়ে সত্য-মিথ্যে মিশিয়ে করা কোনো প্রতিবেদন কী নাড়িয়ে দিতে পারে সে দলটির আত্মবিশ্বাস। অনেকেই বলবেন, সেটি কীভাবে সম্ভব! কিন্তু সংবাদপত্র যদি বিশেষ কোনো দলের লক্ষ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার হয়, তাহলে! ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে জার্মানির সংবাদপত্র বিল্ড ঠিক সে ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হয়েছিল। বিল্ডে প্রকাশিত একটা সংবাদেই ‘সর্বনাশ’ হয়েছিল ইয়োহান ক্রুইফের কমলাবাহিনী নেদারল্যান্ডসের।

১৯৭৪ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডস ছিল এক বিস্ময়। কোচ রাইনাস মিশেলের মস্তিষ্কপ্রসূত ‘টোটাল ফুটবল’ সাড়া জাগিয়েছিল ফুটবল দুনিয়ায়। দুনিয়ার অনেক সেরা ফুটবল দলেরই মিশেল বা নেদারল্যান্ডসের ‘টোটাল ফুটবলে’র জুতসই উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। ’৭৪-এ পশ্চিম জার্মানিতে আয়োজিত বিশ্বকাপ অন্তত সেটিই বলে। পুরো টুর্নামেন্টে নেদারল্যান্ডস এমন দাপটের সঙ্গে খেলেছিল যে সেবার বিশ্বকাপের সম্ভাব্য শিরোপাধারী হিসেবে ফুটবল পণ্ডিতেরা ক্রুইফ, উইম হ্যানসেন, আরি হান, উইলিয়াম ফন হ্যানেগেন, ইয়োহান নিসকেনসদের নেদারল্যান্ডসকে ধরে নিয়েছিলেন। অথচ, সে দলটিই কিনা ফাইনালে ‘কাইজার’ ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার গার্ড মুলারদের পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে গেল। ফুটবল বিশ্লেষকেরা তো অনেকেই ’৭৪ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের বিশ্বকাপ জিততে না পারাকে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত ‘ব্যর্থ’তা হিসেবে মনে করেন। ফুটবল রোমান্টিকদের কাছে যে ব্যর্থতা বড় এক ট্র্যাজেডিই হয়ে আছে এত দিন। ফুটবলে অনেক সময় ‘সেরা দল’ হয়েও যে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য ধরা দেয় না—১৯৭৪ সালে নেদারল্যান্ডসের কাহিনি হতে পারে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

বিল্ডের সেই প্রতিবেদনটি ছিল নেদারল্যান্ডসকে ঠেকানোর বড় অস্ত্র। অন্তত জার্মানদের কাছে। খেলাধুলায় ‘মাইন্ড গেম’ বা স্নায়ুযুদ্ধের কথা বলা হয়। প্রতিপক্ষকে কাবু করতে অনেক দলই এ পদ্ধতি বেছে নেয়। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষের কোনো খেলোয়াড়কে (সেরা খেলোয়াড় অবশ্যই) নিয়ে আচমকা কোনো কটু মন্তব্য করা, প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া (অথচ, সেই বিশ্লেষণটি সঠিক নয়)—এমন স্নায়ুযুদ্ধের উদাহরণ। ধরুন গুরুত্বপূর্ণ একটি ম্যাচের আগে কোনো দলের কোচ প্রতিপক্ষের সেরা খেলোয়াড়টিকে নিয়ে বললেন, ‘অমুককে কীভাবে মাঠে স্তব্ধ করে রাখা হবে, সে পরিকল্পনা আমরা করে ফেলেছি’—ব্যস, এই একটি মন্তব্য দিয়েই তো প্রতিপক্ষের শিবিরে শঙ্কার ছায়া ফেলে দেওয়া যায়। লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া সেই খেলোয়াড়টির-ই বা কী দশা হতে পারে ভেবে দেখুন। ম্যাচের সময় সে খেলোয়াড়ের নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা নিয়ে দ্বিধায় ভোগা তখন খুবই সম্ভব। ’৭৪ বিশ্বকাপের ফাইনালের আগে ‘দুর্দমনীয়’ নেদারল্যান্ডস আর ক্রুইফ, হ্যানেসন, নিসকেনসদের মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দিতে এমনই এক কৌশল নিয়েছিল জার্মানি।

গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে ডাচ দলকে মানসিকভাবে ‘শেষ’ করে দেওয়ার সেই কৌশলটি অবশ্য ছিল বেশ নোংরাই। কিন্তু বিল্ড পত্রিকার সেই প্রতিবেদনের ‘সত্য-মিথ্যা’ বিশ্লেষণ করতে করতেই সে নোংরা কৌশলের বড় শিকার হয়েছিল ফুটবল ইতিহাসের সুন্দরতম ফুটবল খেলা একটি দল। এটা কেবল ডাচদের জন্যই নয়, ফুটবলপ্রিয় মানুষদের জন্যই বিরাট বড় ট্র্যাজেডি।

কী লিখেছিল বিল্ড?

ফাইনালের কয়েক দিন আগে বিল্ডে খুবই আপত্তিকর শিরোনামে একটি ‘বিশেষ’ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, তারা ‘বিশেষ সূত্র’ মারফত জেনেছেন বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচের আগে ডাচ খেলোয়াড়েরা নিজেদের হোটেলে উদ্দাম পার্টিতে মেতেছিলেন। সে পার্টিতে নারীদের সঙ্গে নাকি ক্রুইফ, নিসকেনসদের মদ খেয়ে মাতায় হয়ে নাচতে দেখা গেছে। এখানে বলে রাখা ভালো, বিল্ড পত্রিকার সেই প্রতিবেদনে কোনো সূত্রেরই নাম উল্লেখ করা হয়নি, কোনো পক্ষেরই মন্তব্য ছাপা হয়নি। সংবাদটির পড়তে পড়তে ছিল নিষিদ্ধ ব্যাপার-স্যাপারের সুড়সুড়ি। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোলপাড় শুরু হয় বিশ্বকাপের ময়দানে।

স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বকাপ উপলক্ষ বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকেরা হাজির ছিলেন জার্মানিতে। ফাইনালের আগে এই একটি প্রতিবেদনই ঝড় তুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় ডাচ ফুটবলারদের স্ত্রী ও বান্ধবীরাও রেগে মেগে তাদের ‘প্রিয়’দের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে সে প্রতিবেদনটির সঙ্গে কোনো ছবিও বিল্ড ছাপেনি। কিন্তু সেগুলো নেদারল্যান্ডসের খেলোয়াড়দের গ্লানি থেকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না।

ব্যাপারটা এত দূর গড়িয়েছিল যে ডাচ কোচ রাইনাস মিশেল পর্যন্ত সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিল্ডের প্রতিবেদনটির আদ্যোপান্ত অস্বীকার করেন। জানিয়ে দেন, এটা একটা বড় ষড়যন্ত্রের অংশ। পুরো ঘটনাই মিথ্যে। কিন্তু মিশেলের সেই সংবাদ সম্মেলনটিকে সাধারণ মানুষ সেভাবে গ্রহণ করেননি, যতটা তাঁরা গোগ্রাসে গিলেছিলেন বিল্ডের সেই সুড়সুড়ি মার্কা প্রতিবেদনটি। মানুষ সেই আপ্তবাক্যটিই বিশ্বাস করেছে—‘যা রটে তার কিছু তো ঘটেই।’

মানসিকভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েই ১৯৭৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলতে নেমেছিল নেদারল্যান্ডস। পশ্চিম জার্মানির মতো প্রতিপক্ষের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে যে ধরনের মানসিক স্বস্তি, ঝরঝরে মুড আর উদ্যম প্রয়োজন, সেটার দারুণ অভাব ছিল ফাইনালে। বেকেনবাওয়ার, মুলার, পল ব্রেইটনার, রেইনার বনহফ, ইয়ূপ হেইঙ্কস, বার্টি ফোকটসদের জার্মান দলটিও কিন্তু দুর্দান্ত ছিল।

এত কিছুর পরেও নিসকেনস ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে নেদারল্যান্ডসকে এগিয়ে দিয়েছিলেন। ক্রুইফের দুর্দান্ত এক আক্রমণে সে পেনাল্টিটি আদায় করে নিয়েছিল তারা। ইতিহাস গড়ার পথে হেঁটেছিল ডাচরা। কিন্তু ২৫ মিনিটে ব্রেইটনার ও ৪৩ মিনিটে মুলারের দুটি গোল ম্যাচের চেহারা বদলে দেয়। ব্রেইটনারের গোলটিও অবশ্য এসেছিল পেনাল্টি থেকে। ম্যাচের পরিসংখ্যান হয়তো একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কথাই বলছে।

কিন্তু নেপথ্য কাহিনি বলছে, পুরো বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের সাড়া জাগানো তারকারা সেদিন ঠিক নিজেদের মধ্যে ছিলেন না। ফাইনাল শুরুর আগেও তো আরেক কাণ্ড! সমাপনী অনুষ্ঠানের জন্য মাঠের কর্নার পতাকাগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোকে ম্যাচ শুরুর সময় জায়গামতো বসিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব যাঁদের ছিল, তাঁরা কেন যেন তা করতে ভুলে গিয়েছিলেন। কর্নার পতাকাগুলো ঠিক জায়গায় বসিয়ে ফাইনাল শুরুর বাঁশি বাজাতে বাজাতে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। বিল্ড পত্রিকাই শুধু নয়, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সেদিন এককাট্টা হয়েছিলেন মাঠকর্মীরাও। সেটি তো হবেই, তাঁরাও যে ছিলেন জার্মান।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফুটবল ইতিহাসে বিল্ড পত্রিকায় ছাপা হওয়া সেই ‘সুইংপুল পার্টি’ এখনো বড় রহস্য হয়ে আছে। নেদারল্যান্ডস যদি ফাইনালে সেবার জিততে পারত, তাহলে হয়তো বিল্ডের সেই প্রতিবেদনটি ভুলে যেতেন সবাই। আজ এত বছর পর সেটি নিয়ে লেখারও প্রয়োজন পড়ত না। কিন্তু ডাচ দল হেরে যাওয়াতেই সত্য মিথ্যা যা-ই হোক, বিল্ডের সেই প্রতিবেদনটি ফুটবল ইতিহাসেরই অংশ।

অনেকেই বলবেন, এমনটা তো না-ও করতে পারত জার্মান গণমাধ্যম বা বিল্ড! অথচ, এমন কোনো ঘটনা ঘটলে সেটি সাংবাদিকতার নীতি ও আদর্শ মেনেও তো করা যেত। এমন কিছুর উত্তরে জার্মানরা হয়তো বলবেন—যুদ্ধ ও প্রেমে যেকোনো অন্যায়ই সিদ্ধ। আর ১৯৭৪ বিশ্বকাপের ফাইনালটি তো জার্মানদের জন্য ছিল যুদ্ধই।