পেলে না ম্যারাডোনা, মেসি না রোনালদো - সর্বকালের সেরা আসলে কে?

১৯৭০ বিশ্বকাপে পেলে। ছবি: রয়টার্স
১৯৭০ বিশ্বকাপে পেলে। ছবি: রয়টার্স

শুধু লিওনেল মেসি এদিক থেকে বাকি তিনজনের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম। সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে—এই প্রশ্নটায় পেলে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা বা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর উত্তর কী হবে, তা আর অনুমানের দরকার পড়ে না। তিনজনই বিভিন্ন সময়ে এই প্রশ্নে নিজ নামখানা বেশ গর্ব নিয়ে বলেছেন। স্বল্পভাষী মেসি বারবার উত্তরের ভার তুলে দিয়েছেন দর্শকের হাতে।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

কিন্তু তাঁরা দাবি করুন আর না-ই করুন, সর্বকালের সেরা ফুটবলারের তর্কটার সমাপ্তি তাতে হয় না। সম্ভবত কখনো হবেও না।

জিনেদিন জিদান, রোনালদো নাজারিও, ইয়োহান ক্রুইফ, আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, রোনালদিনহো, ইউসেবিও, মিশেল প্লাতিনি, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার... ফুটবল ইতিহাস রাঙিয়ে যুগে যুগে সেরাদের তালিকায় অনেকের নামই এসেছে। কিন্তু তর্কটা যখন সর্বকালের সেরার, শেষ পর্যন্ত এই চারটি নামেই বারবার এসে ঠেকে ভোটের মনোনয়ন।

এক হাতেই আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। ছবি: সংগৃহীত
এক হাতেই আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। ছবি: সংগৃহীত

১৭ বছর বয়সেই বিশ্বমঞ্চ মাতানো পেলে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের গর্ব নিয়ে। সঙ্গে তাঁর দাবি অনুযায়ী ১২৮৪ গোলও করেছেন (সংখ্যাটা গিনেস রেকর্ডে থাকলেও এটি নিয়ে বিতর্ক আছে। ফুটবলের পরিসংখ্যান বিষয়ক ওয়েবসাইট আরএসএসএসএফের তথ্য, জাতীয় দল ও ক্লাব মিলিয়ে পেশাদার ক্যারিয়ারে পেলের গোলের সংখ্যা ৭৬৭টি)। ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার ছিয়াশি বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক, বহুল প্রচলিত কথাটা এই—আর্জেন্টিনাকে সেবার বিশ্বকাপটা একাই জিতিয়েছেন ম্যারাডোনা। ফিফার ভোটে ম্যারাডোনা ও পেলে দুজনই গত শতাব্দীর সেরা নির্বাচিত হয়েছেন। ম্যারাডোনা জনসাধারনের ভোটে, পেলে ফিফা নির্ধারিত বিচারক-সাংবাদিক-কোচদের ভোটে।

এদিকে বছর পনের ধরে দুজনের ধারাবাহিক ঔজ্জ্বল্যই মেসি ও রোনালদোকে সর্বকালের সেরার মনোনয়নে নিয়ে এসেছে। কদিন আগে ক্যারিয়ারে ৭০০তম গোল পাওয়া মেসির বয়স ৩৩ চলছে, দুবছরের বড় রোনালদো এই বয়সেও কী দারুণ উজ্জ্বল। মেসির ৭০৩টির তুলনায় রোনালদোর গোল ৩২টি বেশি। জুভেন্টাসের পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড মেসির চেয়ে ম্যাচও অবশ্য খেলেছেন বেশি – রোনালদোর ম্যাচ ১০১৩টি, মেসির ৮৬৭টি। কিন্তু রোনালদোকে এগিয়ে রাখে ২০১৬ ইউরোতে পর্তুগালকে নিজেদের ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা এনে দেওয়ার গৌরব আর তিনটি ভিন্ন ক্লাবের হয়ে নিজেকে প্রমাণের গর্ব। সঙ্গে ব্যক্তিগত অর্জন হয়ে জ্বলজ্বল করছে পাঁচটি ব্যালন ডি’অর। রেকর্ড ছয়বার জেতা মেসি এদিক থেকে রিক্ত—ক্লাব ক্যারিয়ারের পুরোটাই এখন পর্যন্ত কেটেছে বার্সেলোনায়, আর্জেন্টিনার জার্সিতে একটি বিশ্বকাপ ফাইনালসহ তিনটি ফাইনাল খেলেও ফিরেছেন শূন্য হাতে। (পেলে-ম্যারাডোনার সময়ে ব্যালন ডি’অর ইউরোপের বাইরের ফুটবলারদের দেওয়া না হলেও ২০১৬ সালে পুরস্কারটির ষাট বছর পূর্তিতে ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিনের পুনর্মূল্যায়ন, পেলে সাতটি ব্যালন ডি’অর জিততেন, ম্যারাডোনা জিততেন দুটি)।

তা দলীয় শিরোপা দিয়ে যতই একজন খেলোয়াড়কে মাপা হোক, দিন শেষে সেটি দলীয় পুরস্কারই। তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডার যাঁকে মাপা হয়, সেই পাওলো মালদিনি কখনো বিশ্বকাপ জেতেননি। পেলের তিনটি বিশ্বকাপের মধ্যে দ্বিতীয়টি অর্থাৎ ১৯৬২ বিশ্বকাপে পেলে গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে চোট পেয়ে পুরো টুর্নামেন্টেই আর খেলতে পারেননি। ব্রাজিলকে সেই বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন গারিঞ্চা। ২০১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ফাইনালে উঠলেও সেবার নকআউট পর্বে মেসি কোনো গোলই পাননি, করিয়েছেন মাত্র একটি।

কিন্তু ক্রিকেটের মতো পরিসংখ্যান দিয়ে তো ফুটবলকে বিচার করা যায় না। শিরোপার পথে একজন খেলোয়াড়ের প্রভাব সংখ্যা দিয়ে নিখুঁতভাবে মাপার কোনো উপায় নেই। ৭-৮ ম্যাচের একটা টুর্নামেন্টে ভাগ্যও অনেক বড় একটা নির্ধারক। তবে বিশ্বকাপ যেহেতু একজন খেলোয়াড়ের অমরত্বের পথে সবচেয়ে বড় ধাপ, সেখানে পেলেই সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবেন। তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছেন, যার দুটিতে তাঁর দারুণ অবদান। বিশ্বকাপ একটি জিতলেও দৌড়ে পেলের খুব কাছেই থাকবেন ম্যারাডোনা। সেটি শক্তির নিক্তিতে পেলের সময়ের ব্রাজিলের তুলনায় ম্যারাডোনার সময়ের আর্জেন্টিনা পিছিয়ে ছিল বলে। পেলের সে সময়ের দলে গারিঞ্চা-ভাভাসহ অনেক তারকা ছিলেন, ম্যারাডোনার ছিয়াশি বিশ্বকাপের দলে এক হোর্হে ভালদানো ছাড়া তেমন নামডাকেরই কেউ ছিলেন না। চারজনের মধ্যে মেসি থাকবেন এরপর, তাঁর সময়ে দল একবার অন্তত ফাইনালে উঠেছে। মেসির মতোই কখনো বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে গোল না পাওয়া রোনালদোর পর্তুগালকে নিয়ে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ অর্জন বলতে ২০০৬ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলা। এরপর কখনো কোয়ার্টার ফাইনালেই ওঠা হয়নি পর্তুগালের।

২০১৪ বিশ্বকাপ জয়ের খুব কাছে চলে গিয়েছিলেন লিওনেল মেসি। ছবি: এএফপি
২০১৪ বিশ্বকাপ জয়ের খুব কাছে চলে গিয়েছিলেন লিওনেল মেসি। ছবি: এএফপি

ফুটবলার- বিশ্লেষকরা কী বলেন?
বিশ্বকাপ, মহাদেশীয় শিরোপা, গোল করা বা করানো, বর্ষসেরা কতবার—সেসব তো বিবেচনায় আসেই। তবে তাঁদের নিয়ে ফুটবলার-বিশ্লেষকদের মতও হয়তো সেরার বিতর্কে বড় প্রভাব ফেলে। যদিও সেখানেও এককভাবে কাউকে এগিয়ে রাখা যাচ্ছে না।

এখানে অবশ্য বিতর্কটাকে দুভাগে ভাগ করে নিলেই ভালো। বেশির ভাগ বিশ্লেষকের কাছেই প্রশ্নটা থাকে হয় মেসি-রোনালদো বিতর্ক নিয়ে, নতুবা পেলে-ম্যারাডোনাকে ঘিরে। চারজনকে একই সঙ্গে রেখে প্রশ্নটা হয়েছে কমই।

সর্বকালের সেরা কে—সে প্রশ্নে কদিন আগে ফিফার ওয়েবসাইটে সাক্ষাৎকারে ব্রাজিলের সত্তর বিশ্বকাপজয়ী দলের তারকা টোস্টাও দিয়েছেন বিশদ উত্তর। তাঁর বিশ্লেষণ, ‘পেলে এঁদের সবার চেয়ে ভালো ছিলেন। আমার কাছে এটা কোনো তুলনাই নয়। পেলে পরিপূর্ণ ফুটবলার ছিলেন। ম্যারাডোনার খেলা দেখতে দারুণ ছিল, কিন্তু শারীরিকভাবে সে পেলের পর্যায়ে ছিল না। পেলের মতো গোল করতে পারেনি। মেসির খেলাও দেখতে দারুণ, কিন্তু ও পেলের মতো বলে হেড করতে পারে না। পেলের মতো দুই পায়ে শট নিতে পারে না। পেলে যেরকম কারিকুরি দেখাতে পারতেন, সেটা পারে না। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো দারুণ একজন খেলোয়াড়, কিন্তু পেলের বল পায়ে যে দক্ষতা ছিল, সেটা ওর নেই। পেলে যেরকম দারুণ পাসগুলো দিতে পারতেন, সেটা ও পারে না। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও মেসির দক্ষতা নিয়ে সেগুলো যোগ করলে হয়তো পেলের সঙ্গে তুলনা করার মতো একজন খেলোয়াড় পাওয়া যাবে।’

ইতালির ২০০৬ বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ফাবিও কানাভারো আবার এগিয়ে রাখছেন ম্যারাডোনাকে, ‘আমি মেসিকে অনেক সম্মান করি। এই প্রজন্মের খেলোয়াড়দের মধ্যে ও সর্বকালের সেরাদের একজন। কিন্তু ম্যারাডোনা অন্যরকম, কারণ সে সময় ফুটবলই অন্যরকম ছিল। প্রতিপক্ষ তাঁকে অনেক লাথি মারত, কিন্তু তিনি সব সময়ই বলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতেন।’

২০১৬ ইউরো ট্রফি হাতে রোনালদো। ছবি: এএফপি
২০১৬ ইউরো ট্রফি হাতে রোনালদো। ছবি: এএফপি

ফরাসি কিংবদন্তি এরিক ক্যান্টোনাও পেলের চেয়ে ম্যারাডোনাকেই এগিয়ে রাখেন, ‘অনেকে বলেন পেলে সর্বকালের সেরা, কিন্তু আমার কাছে তা মনে হয় না। ম্যারাডোনা সব সময়ই সেরা থাকবেন। পেলে ও ম্যারাডোনার মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্যটা ছিল ম্যারাডোনার আশপাশে এত দারুণ সব খেলোয়াড় ছিল না। দলটাকে তিনিই একা বয়ে নিয়ে গেছেন। যদি আপনি ম্যারাডোনাকে ওই আর্জেন্টিনা দল থেকে বের করে নিতেন, তাহলে ওরা বিশ্বকাপ জিততে পারত না। কিন্তু পেলেকে ছাড়াও ব্রাজিল জিতত বলেই আমার মনে হয়।’

ইতালিয়ান কোচ ফাবিও কাপেলো চারজনের মধ্যে রোনালদোকেই শুধু পিছিয়ে রাখছেন, ‘রোনালদো অসাধারণ একজন ফুটবলার, কিন্তু মেসি জিনিয়াস। ফুটবলের ইতিহাসে তিনজনই জিনিয়াস আছেন—পেলে, ম্যারাডোনা ও মেসি।’

ছিয়াশি বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনার ‘শতাব্দীর সেরা গোল’ ও ‘ঈশ্বরের হাতে’র সাক্ষী ইংলিশ স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকার আবার মেসিকেই দিচ্ছেন ভোট, ‘আমার চোখে, জীবনে কোনো এক সময়ে ফুটবল বুটজোড়া পায়ে দিয়েছে, এমন সবার মধ্যেই ও সর্বকালের সেরা। অনেকে গোল করার হার দেখে সেরা নির্ণয় করে। সেখানে দেখুন, ও ম্যাচপ্রতি গোল করে। কিন্তু ও আমার দেখা সর্বকালের সেরা ড্রিবলারও মেসি। মাঠে কল্পনার ছাপ রাখতে জানে, এমন খেলোয়াড়দের মধ্যেও আমার দেখা সবার সেরা। পাসিংয়ের দিক থেকে খেলাটার ইতিহাসেরই সেরা। সব একসঙ্গে মিলিয়ে নিলে এমন একজনকে পাবেন যে আসলে অতিমানব।’


আসলে কে সেরা? আদৌ কেউ সেরা?
বিতর্কটাই এমন, এর কোনো একটি উত্তর হয় না। সাবেকদের মতামত দেখলেই তা বোঝা যায়। সময়ের অন্যতম সেরা কোচ পেপ গার্দিওলাকেই দেখুন না! ২০০৯ সালে সর্বকালের সেরার প্রশ্নে ভোটটা দিয়েছিলেন ম্যারাডোনার বাক্সে, ‘আমার প্রজন্মের কাছে ম্যারাডোনাই সর্বকালের সেরা। আমার মনে হয় না এটা আর বদলাবে।’ কিন্তু বার্সেলোনাতে মেসিকে চার বছর কোচিং করানোর পর ২০১২ সালে গার্দিওলাই বলেছিলেন, ‘মেসিই সর্বকালের সেরা। আমি ওকে পেলের সঙ্গে তুলনা করি।’

কিন্তু আসলে কে সেরা? তাঁদের খেলার কিছু দিক বিশ্লেষণ করলে কী পাওয়া যায়?

যদি প্রতিভা হয় বিবেচ্য, সে ক্ষেত্রে হয়তো কাপেলোই ঠিক বলেছেন। পেলে, ম্যারাডোনা ও মেসিকে এক ব্র্যাকেটে রাখতে হয়। রক্ষণচেরা পাস দেওয়ায় মেসি আর ম্যারাডোনা এগিয়ে থাকবেন। বল পায়ে বা বল ছাড়া কারিকুরিতে আবার পেলে সবার চেয়ে এগিয়ে, ম্যারাডোনা আসবেন এরপরই। প্রতিপক্ষকে কাটিয়ে যাওয়াতে পেলে-ম্যারাডোনা-মেসি সমমানেরই।

তাহলে রোনালদো? বাকি তিনজনের কাতারে আসবেন না? ব্যাপারটা টেনিসে অনেকটা ফেদেরার-নাদাল তুলনার মতো। ফেদেরারের টেনিস যদি হয় বীণার সুর, নাদালের টেনিস হবে গিটারের ঝনঝনানি! রোনালদোর ফুটবলে পেশিশক্তির প্রদর্শনী আছে, মেসি-ম্যারাডোনার ফুটবলে বলকে আলতো ছোঁয়ায় নিয়ন্ত্রণের জাদু আছে। পেলে দুটির মিশেল।

ড্রিবলিং রোনালদোও করেন, তবে মেসি-ম্যারাডোনার কাটিয়ে যাওয়ায় যেমন সাপের মতো আঁকাবাঁকা শরীরের নাচন আছে, বলকে পায়ের সঙ্গে সেঁটিয়ে রাখার জাদু আছে, রোনালদোর ড্রিবলিং তেমন নয়। তাতে স্টেপওভারের বিদ্যুচ্চমক আছে, গতির ঝলক আছে। আর পেলে? ব্রাজিলের কোপাকাবানা বিচে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার আনন্দের ছাপ সেখানে। প্রতিপক্ষের মাথার ওপর দিয়ে বল উঠিয়ে নেওয়া, পায়ের নাচন, শরীরের এদিক-ওদিক ঝাঁকুনি—ব্রাজিলে যেটি ‘জিঙ্গা’নামে পরিচিত...। কোনো একটির চেয়ে অন্যটি কম কি বেশি সুন্দর, সেটি তো দর্শকচোখের বিবেচনা।

গোল করার ক্ষমতা যদি হয় বিবেচ্য, ম্যারাডোনা বাকি তিনজনের চেয়ে পিছিয়ে পড়বেন। বক্সের ভেতরে প্রতিপক্ষকে এড়িয়ে ঠিক জায়গায় যাওয়া (অফ দ্য বল রানিং) যদি হয় শিল্প, রোনালদো সে শিল্পের পিকাসো। গোল করার হারে মেসি-পেলেও রোনালদোর চেয়ে পিছিয়ে নন মোটেই। বরং গোল করার পাশাপাশি করানোর দক্ষতায় রোনালদোকে পেছনে ফেলে যাবেন দুজন। পার্থক্যটা গোল করানোর (অ্যাসিস্ট) সংখ্যার চেয়েও বেশি ধরনে। গোলপোস্টের সামনে বল পেয়ে পাশে ফাঁকায় দাঁড়ানো সতীর্থকে পাস দিয়েও অ্যাসিস্ট হয়, আবার মাঝমাঠে বল পেয়ে দু-তিনজনকে কাটিয়ে পোস্টের দিকে দৌড়াতে থাকা সতীর্থকে দারুণ থ্রু-পাসেও অ্যাসিস্ট হতে পারে। গুরুত্বে কোনোটি কম নয়, দেখার আনন্দে যা পার্থক্য।

কে কোন পজিশনে খেলেন, সেটিও একটা ব্যাপার। ম্যারাডোনা ছিলেন প্রথাগত ‘নাম্বার টেনে’-র মতো। নাপোলিতে ম্যারাডোনা খেলতেন দুই স্ট্রাইকারের পেছনে। রোনালদো ক্যারিয়ারের শুরুটা করেছিলেন উইংয়ে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বক্সের দিকে আরও ঝুঁকেছেন। মেসি কাগজে-কলমে রাইট উইংয়ে রাইট উইংয়ে খেলেন বটে, কিন্তু বল নিয়ে ডানদিক থেকে মাঠের ভেতরেই ঢোকেন বেশি (ইনওয়ার্ড ফরোয়ার্ড)। বয়স বাড়ার সঙ্গে তিনি যাচ্ছেন রোনালদোর উল্টো দিকে, মাঝমাঠের দিকে ঝুঁকছেন। ওই যে, খেলার ধরনে পার্থক্য বলে! পেলে প্রথাগত নাম্বার নাইন বা স্ট্রাইকার ছিলেন না বটে, তবে খেলতেন স্ট্রাইকারের ভূমিকাতেই। ম্যারাডোনার গোল কম হওয়াই স্বাভাবিক। ফুটবল গোলের খেলা বটে, কিন্তু গোল করার চেয়ে করানো কম গুরুত্বপূর্ণ – এমন দাবি কে করবে?

আবার মেসির মতো তিন-চারজনকে কাটিয়ে, বা পেলের মতো ডিফেন্ডারের মাথার ওপর দিয়ে বল নিয়ে গিয়ে তাঁকে বোকা বানিয়ে গোল করার চেয়ে রোনালদোর মতো বক্সে ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে জোরাল শটে গোল করা বা পাল্টা আক্রমণে সতীর্থদের সঙ্গে দারুণ বোঝাপড়ার পর গোল এনে দেওয়ার গুরুত্ব কম—এমন দাবিই বা কে করবে? দেখার সৌন্দর্যের প্রশ্ন আসতে পারে, কিন্তু সৌন্দর্য তো আপেক্ষিক। দর্শক চোখ ও মনের রায়ই এখানে শেষ কথা।

হেডিং, দুই পায়ে শট নেওয়ার ক্ষমতা বিবেচনায় মেসি ও ম্যারাডোনাকে কয়েক মাইল পেছনে ফেলে এগিয়ে যান পেলে ও রোনালদো। কিন্তু এখানেও পালটা যুক্তি আসে, মেসি ও ম্যারাডোনার উচ্চতা কম, সেটা তো তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নয়!

তবে একটা জায়গায় দৃশ্যত বাকি তিনজনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে মেসি। বড় ম্যাচে দল পিছিয়ে পড়লে, বা চাপের মূহুর্তে দলকে উজ্জীবিত করার শক্তিতে। আর্জেন্টিনার হয়ে ২০১৪ বিশ্বকাপ আর আগে-পরে দুবছরে দুটি কোপা আমেরিকা—তিন বছরে তিনটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে চাপের মূহুর্তে মেসি ভেঙে পড়েছেন বলে তাঁর সমালোচনা হয়। বার্সেলোনার হয়ে সর্বশেষ দুই মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে লজ্জার হারে দলের বিদায়ের ক্ষণগুলোতেও মেসি স্বমহিমায় আলো ছড়াতে পারেননি। রোনালদো বিশ্বকাপে তেমন ঝলক না দেখাতে পারলেও ২০১৬ ইউরো জয়ের পথে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দলের প্রয়োজনের মুহূর্তে গোল করে-করিয়ে দলকে উদ্ধার করেছেন। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে গত কয়েক বছরে চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট পর্বে ঝলসে উঠেছেন বারবার। পেলে-ম্যারাডোনা বিশ্বকাপের মঞ্চে কী করেছেন, তা ইতিহাস বলবে চিরকাল।

হালের ‘মেসি না রোনালদো’ বিতর্কে মেসির শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে আরেকটি সমালোচনা হয় আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডের—রোনালদো যেখানে ইংল্যান্ড, স্পেনের পর ইতালিতেও নিজেকে কমবেশি প্রমাণ করেছেন, মেসি পুরো ক্যারিয়ার কাটিয়েছেন বার্সেলোনাতেই। সেটি তাঁর বেড়ে ওঠায় বার্সেলোনার অবদানের কারণে ক্লাবটার প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা থেকে ঠিকই, কিন্তু সে অন্য বিবেচনা। অন্য দেশের ক্লাবে যাওয়া মানে তো শুধু ক্লাব বদলানোই নয়, ফুটবলের সংস্কৃতি, ভাষা, সতীর্থ, এমনকি আবহাওয়াও বদলানো। সর্বকালের সেরার বিতর্কে এ দিকটায় রোনালদো ও ম্যারাডোনা অনেক এগিয়ে যান, মেসি ও পেলের ক্যারিয়ার তো বলতে গেলে এক ক্লাবেই কেটেছে।

পেলের শ্রেষ্ঠত্বের বিতর্কেও এই প্রশ্নটা কাঁটা হয়ে আসে। যুগে যুগে সেরা খেলোয়াড়রা ইউরোপেই খেলেছেন। যে যুগে আলফ্রেডো ডি স্টেফানো রিয়াল মাদ্রিদ মাতিয়েছেন, সে যুগে পেলেও ইউরোপে খেললে—তা যদি হতো স্টেফানোর রিয়াল ভিন্ন অন্য কোনো ক্লাবে—কে জানে, মেসি-রোনালদোর মতো আরেকটি দ্বৈরথ হয়তো ষাটের দশকেই দেখা যেত। ব্রাজিলের ফুটবল সে সময়ে জমজমাট ছিল, কিন্তু পেলে যে দলগুলোর বিপক্ষে খেলেছেন, সেগুলোর কয়টি ইউরোপের সেরা দলগুলোর বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় টিকবে?

মেসি-রোনালদো ইউরোপের সেরা মঞ্চে ১২-১৫ বছর ধরে টানা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। মেসি বার্সেলোনায় আর রোনালদো রিয়ালে থাকার সময়টা তো ফুটবল ইতিহাসেই কোনো দুই ফুটবলারের সেরা দ্বৈরথের স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিদার। মেসি চারবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন, রোনালদো পাঁচবার—এর মধ্যে টানা তিনবার। কিন্তু রোনালদো রিয়ালে থাকার নয় বছরে স্প্যানিশ লিগ মেসি জিতেছেন ছয়বার, রোনালদো দুবার। গৌরবে, শৌর্যে চ্যাম্পিয়নস লিগ এগিয়ে, ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের টুর্নামেন্ট বলে কথা। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগ ১৩ ম্যাচের টুর্নামেন্ট, যার ৭টি নকআউট। আর লিগ ৩৮ ম্যাচ শেষে জয়ী নির্ধারণ করে। কোনটিকে এগিয়ে রাখবেন?

সর্বকালের সেরার বিতর্কে আসবে দুই ভিন্ন সময়ের ফুটবলের ধরনও। পেলে-ম্যারাডোনার সময়ে তাঁদের যেমন কড়া ফাউলের শিকার হতে হয়েছে, মেসি-রোনালদোকে তেমন সইতে হয়নি। পিচের অবস্থা এখনকার মতো মখমল-মসৃণ ছিল না। আবার এখন যেমন প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে, মেসি-রোনালদোকে যেভাবে পড়ে ফেলা হচ্ছে, পেলে-ম্যারাডোনা এ যুগে ততটাই সফল হতেন কি না, তা কল্পনাই জানে।

আগের চেয়ে এখন অনেক গতি বেড়েছে ফুটবলে। খেলোয়াড়দের ফিটনেসে আমুল বদল এসেছে। ৭-৮ বছর আগেও একজন ফুটবলার গড়ে যেখানে ম্যাচে ৮-৯ কিলোমিটার দৌড়াতেন, এখন সেটি ১১-১২ কিলোমিটার। খেলার গতি বাড়া মানে বল পায়ে কারিকুরির সময় কম পাওয়া। বল পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিতে ম্যারাডোনা-পেলেদের চেয়ে মেসি-রোনালদো সময় পাচ্ছেন কম। আর সময়ের সুতোর ব্যাপারটি তো আছেই। পেলের সময়ে যেসব উদ্ভাবন এসেছে, সেসব থেকে ম্যারাডোনারা শিখেছেন। মেসি-রোনালদোরা শিখেছেন পেলে-ম্যারাডোনার ভিডিও দেখে।

ভিন্ন ভিন্ন যুগের তুলনা, সর্বকালের সেরার আলোচনা তাই সংবাদমাধ্যমে মুখরোচক খবরেরই জোগান দেয়। আদতে সেটির মীমাংসা কখনো সম্ভব নয়। দিনশেষে প্রশ্নটার উত্তর ব্যক্তি পছন্দের ওপরই নির্ভর করবে।

সর্বকালের সেরা কে? উত্তরে তাই কখনোই কোনো একটা নাম আসবে না।

হয়তো বিতর্কটার সৌন্দর্যই এটি।