বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে যদি একটা জাদুঘর থাকত...

কত ঘটনার সাক্ষী এই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। অথচ, এই মাঠে স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগই নেই। ছবি: শামসুল হক
কত ঘটনার সাক্ষী এই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। অথচ, এই মাঠে স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগই নেই। ছবি: শামসুল হক
>বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম বাংলাদেশের ঐতিহাসিক এক ক্রীড়া নিদর্শন। অথচ, এ মাঠে ইতিহাস সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই।

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে এলাকায় গেলে এটিকে এটিকে বাণিজ্যকেন্দ্র ভাবলে মোটেও ভুল হবে না। চারদিকে দোকান আর দোকানির ভিড়। বিকিকিনির ব্যস্ততা। গোটা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এলাকাটাই যেন বিক্রি-বাট্টার বিরাট বড় এক হাট। এটি যে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র, সেই ধারণাটাই পাল্টে যায় স্টেডিয়ামের আশপাশে গেলে। খেলার মঞ্চে খেলাই যেন আড়ালে চলে যায় এখানে। অথচ, বাংলাদেশের খেলাধুলাই কেবল নয়, দেশের ইতিহাসেও বড় একটা জায়গাজুড়ে আছে এই স্টেডিয়াম। কত ঘটনা, কত স্মরণীয় খেলার সাক্ষী এই মাঠ। কত বড় বড় তারকার পদধূলি পড়েছে এই মাঠে। মেসি-জিদান-মোহাম্মদ আলী কিংবা বিশ্বসেরা ক্রিকেট তারকাদের পদচারণার স্মৃতি যে মাঠে ছড়িয়ে আছে, সেটিকে নিয়ে কী অবহেলাই না আমাদের!

লর্ডসের লংরুম নিয়ে আমরা কথা বলি। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মাঠের অনার্স বোর্ড নিয়ে কত আলোচনা। আমাদের তামিম ইকবালরাই ক্রিকেটের সবচেয়ে মর্যাদার মাঠের অনার্স বোর্ডে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন। কিন্তু দেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করে রেকর্ড বুকে স্থান করে নিলেও যে মাঠে আমিনুল ইসলামের এ কীর্তি, সেখানে সে ঐতিহাসিক ঘটনার কোনো নিদর্শনই নেই। আমিনুলের সে সেঞ্চুরিটি মাঠে বসে দেখা কোনো বাবা তাঁর সন্তানকে সেখানে নিয়ে গিয়ে দেখাতে পারেন না সেই সেঞ্চুরির কোনো স্মারক। আচ্ছা, সবকিছু বাদ দিন, যে মাঠে মোহাম্মদ আলী হেঁটেছেন, লিওনেল মেসি, অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া, হাভিয়ের মাচেরানো কিংবা জিনেদিন জিদান খেলেছেন, সেখানে তাদের একটা ছবি পর্যন্ত থাকবে না! ২০১১ বিশ্বকাপের দুর্দান্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি যেখানে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে, তার কোনো চিহ্ন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে নেই। তিনটি সাফ গেমসের আয়োজনের স্মৃতিরও কোনো নমুনা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ মাঠে অজস্র ম্যাচ খেলা দেশের কিংবদন্তিতুল্য ফুটবল তারকা কাজী সালাউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান, আশরাফউদ্দিন চুন্নুদের নাম পর্যন্ত লেখা নেই এখানে। আবাহনী-মোহামেডানের আগুনঝরা ম্যাচগুলোর স্মৃতির কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল।

১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এ স্টেডিয়ামে খেলেছেন হানিফ মোহাম্মদ, ফজল মাহমুদ, বাসিল ডি’ অলিভেরা,ওয়েসলি হল, গ্লেন টার্নারদের মতো ক্রিকেট ইতিহাসের বড় বড় নাম। হানিফ মোহাম্মদ সেঞ্চুরি জোড়া সেঞ্চুরি করেছেন ১৯৬২ সালে। ডি’অলিভেরা, গ্লেন টার্নারদেরও সেঞ্চুরি আছে। স্যার ওয়েসলি হল ১৯৫৯ সালে এ মাঠেই পাকিস্তানের বিপক্ষে এক টেস্টে ৭ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার রিচি বেনোর ৮ উইকেট আছে এ মাঠে। ক্রিকেটের এই কিংবদন্তিদের কীর্তি হারিয়ে যাবে ইলেকট্রনিকসের ভিড়ে! ভাসমান মাদকসেবী আর সমাজবিরোধীরা ম্লান করে দেবে এ মাঠের ঐতিহাসিক তুল্যমূল্য! এটা তো যেকোনো খেলাপ্রেমীর কাছেই অসহনীয়!

বিশ্ব ক্রিকেটের কিংবদন্তিদের কথা বাদ দিন। আগেই বলেছি আমিনুল ইসলামের কথা। টেস্টে তিনি বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিটিও তো এ মাঠেই—মেহরাব হোসেনের কী মনে হয় না, তাঁর সেই কীর্তির স্মারকটি এই স্টেডিয়ামের কোনো এক স্থানে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে স্মৃতিমেদুর করে তুলুক তাঁকে! সেঞ্চুরি করে বাংলাদেশকে প্রথম টেস্ট সিরিজ জেতানো নাফিস ইকবালও দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারেন ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত শেষ টেস্ট ম্যাচটিতে তাঁর সেই ঘাম ঐতিহাসিক ইনিংসটির কথা চিন্তা করে। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম ৫ উইকেট নিয়েছিলেন নাঈমুর রহমান—সেটিও এ মাঠেই। সবচেয়ে বড় কথা যে মাঠে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট ম্যাচের স্মৃতি, সে মাঠ কীভাবে এত অবহেলিত হতে পারে!

ফুটবলেরও কত ঘটনা এই মাঠে! বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মাঠেই বাংলাদেশ ২০০৩ সালে জিতেছিল এখনো পর্যন্ত একমাত্র সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। আরও পেছনে ফিরে যান, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে বড় জয়টি পেয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৮৫ সালে দ্বিতীয় সাফ গেমসে মালদ্বীপ বাংলাদেশের কাছে হেরেছিল ৮-০ গোলে। ১৯৮৫ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ইন্দোনেশিয়াকে হারানো এ মাঠেই। ’৮৫ আর ১৯৮৯ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই থাইল্যান্ডকে হারিয়েছিল। ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে আশরাফউদ্দিন চুন্নুর সেই বাঁকানো ফ্রিকিকের গোল, কিংবা ’৮৯-তে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বিরের সেই ম্যারাডোনা স্টাইলের গোল—এখনো তো নাড়া দেয় ফুটবলপ্রেমীদের। কিন্তু সে সব কীর্তির কোনো নিদর্শন আমরা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের কোথাও রাখিনি।

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মাঠে একবার হেঁটে দেখুন। খেলাপ্রেমী হলে আর ইতিহাসটা জানলে আপনি শিহরিত হবেনই। পল্টন প্রান্তের দিকে তাকিয়ে দেখুন, দৃশ্যপটে অনেকেই ভেসে উঠবেন। খোদা বক্স মৃধা কিংবা তওফিক আজিজ খান বা আবদুল হামিদরা ধারাভাষ্যে ‘পল্টন প্রান্তে’র কথা উচ্চারণ করতেন। ...‘পল্টন প্রান্ত থেকে দৌড় শুরু করেছেন....’! বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের এক প্রান্তের নাম যে এটি, সে তথ্যটি জেনে রাখার দায়িত্ব তো এ প্রজন্মের নয়। নানা উদ্যোগ নিয়েই, নানা স্মারক গড়েই এ ধরনের তথ্য ছড়িয়ে দিতে হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে—কিন্তু তেমনটি তো কখনোই দেখা গেল না এ দেশের খেলাধুলার ইতিহাসে।

সবকিছু বাদ দিন, এ প্রজন্ম কি জানে এ বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় অর্জন করে ১৬ ডিসেম্বর সকালে ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন ঢাকায় প্রবেশ করা মুক্তিবাহিনীর প্রথম দলটি। মেজর (পরবর্তীকালে) মেজর জেনারেল মঈনুল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি সেনাদল স্টেডিয়ামের পশ্চিম গ্যালারিতে তাঁবু খাটিয়েছিল। দেশের জন্ম স্মৃতিও জড়িয়ে যে মাঠের সঙ্গে সেটিকে আমরা ইলেকট্রনিক পণ্য, ফার্নিচার আর অন্যান্য দ্রব্যের বিশাল মার্কেটে পরিণত করেছি। ভাবা যায়! বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গার্ড অব অনার দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ফিরে গিয়েছিল ভারতীয় বাহিনী। এ মাঠের প্যাভিলিয়ন প্রান্তের স্থাপিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে যুদ্ধফেরত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিয়েছিলেন স্বাধীনতার স্থপতি—আমরা সে সব ঐতিহাসিক মুহূর্তের কোনো ছবিই এখানে সংরক্ষণ করিনি—এ লজ্জা তো জাতি হিসেবে আমাদেরই।

ক্রিকেটের পীঠস্থান লর্ডসে রয়েছে আটটি গ্যালারি—দ্য প্যাভিলিয়ন, ওয়ার্নার স্ট্যান্ড, গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড কম্পটন স্ট্যান্ড এমন কত নামেই না সেখানে গ্যালারির নামকরণ হয়েছে। আমাদের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে কোনো এক কালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ক্রিকেটার আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ও ক্রিকেট সংগঠন মুশতাক হোসেনের নামে দুটি গ্যালারির নামকরণ করা হয়েছিল। কিন্তু এ মাঠ থেকে ক্রিকেট সরে যাওয়ার পর ওই নামকরণও আমরা বেমালুম ভুলে গিয়েছি। পৃথিবীর অনেক বড় বড় ও বিখ্যাত স্টেডিয়ামে তো বটেই, আমাদের প্রতিবেশী দেশ গুলিতেও স্টেডিয়ামের গেট বা গ্যালারি সাবেক কিংবদন্তি খেলোয়াড়দের নামে নামকরণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে এমন কিছু করার কোনো উদ্যোগই সেভাবে দেখা যায়নি।

মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম অন্তত এই একটি জায়গায় কিছুটা এগিয়ে আছে। সেখানে অন্তত জাতীয় ক্রিকেট দলের সব অধিনায়কদের ছবি আর দেশের ক্রিকেটের কিছু সাফল্যের স্মারক রাখা হয়েছে। কিন্তু মিরপুর স্টেডিয়ামের চেয়েও অনেক পুরোনো, অনেক ঐতিহাসিক অনেক বেশি বিশ্বসেরা তারকাদের পদভারে মুখরিত বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম অনাদর, অবহেলার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে।

আমরা কী পারি না, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ঐতিহাসিক মূল্যের সমাদর করতে! আমরা কী পারি না, এ মাঠের সব ঐতিহাসিক খেলা আর কীর্তির সাক্ষী হিসেবে এখানে একটা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করতে! দেশের কিংবদন্তি তারকাদের নামে এই স্টেডিয়ামের একেকটি গ্যালারি বা গেটের নামকরণ করা কী খুব কঠিন-অসম্ভব কাজ? একটা অনার্স বোর্ড স্থাপন তো কর্তাদের ইচ্ছাতেই হতে পারে! বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে চারদিকে ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোর ছবি সাজিয়ে একটা কফি শপ—খুব কী বড় চাওয়া!

ইতিহাস সংরক্ষণে দৈন্যের মূল্য কিন্তু অনেক!