জিদান কী পারবেন রিয়ালকে কোয়ার্টারে তুলতে?

জিদানের কৌশলের ওপরেই নির্ভর করছে রিয়ালের ভাগ্য। ছবি : এএফপি
জিদানের কৌশলের ওপরেই নির্ভর করছে রিয়ালের ভাগ্য। ছবি : এএফপি

লিগ জেতা হয়ে গেছে আগেই। তাও শান্তিমতো দুদণ্ড ছুটি কাটাতে পারছেন কোথায় রিয়াল মাদ্রিদের কোচ জিনেদিন জিদান?

করোনাকালীন বিরতি শেষে আবারও মাঠে গড়িয়েছে ফুটবল। লিগ শুরু হয়ে শেষও হয়ে গেছে, আজ শুরু হতে যাচ্ছে চ্যাম্পিয়নস লিগ। আর চ্যাম্পিয়নস লিগের মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে আজ ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে মাঠে নামছে জিদানের দল। প্রথম লেগে নিজেদের মাঠে ২-১ গোলে হেরে আসা রিয়ালের কাছে এ ম্যাচটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওদিকে লিভারপুলের কাছে লিগ হাতছাড়া করা ম্যানচেস্টার সিটিও চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার জন্য মরিয়া। রিয়ালের মাঠে মহামূল্যবান দুটি অ্যাওয়ে গোল পাওয়ার পর পেপ গার্দিওলা কোনোভাবেই চাইবেন না চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের সুযোগটা আরেকটু উজ্জ্বল করার সুযোগ হাতছাড়া করতে। দুই দলের কৌশল আজ কেমন হতে পারেন? আসুন, অনুমান করা যাক!

রিয়ালের মাঠে প্রথম লেগে জেতার পেছনে গার্দিওলাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিল তাঁর সাবধানী কৌশল। সাধারণত বল পায়ে রেখে খেলোয়াড়দের আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে উদ্বুদ্ধ করা গার্দিওলা সেদিন একেবারেই ঝুঁকি নিতে চাননি। মাথায় হয়তো ছিল, এর আগে ঝুঁকি নিতে গিয়ে বারবার নকআউট পর্ব থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। তাই ঝুঁকি একদমই নেওয়া যাবে না। নিশ্চিত করতে হবে, মাঠের প্রত্যেক পর্যায়ে যেন পর্যাপ্ত পরিমাণ খেলোয়াড় থাকে রিয়ালের তুলনায়। যে কারণে ৪-৩-৩ ছকে খেলতে নামা রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে গার্দিওলা দলকে নামিয়েছিলেন ৪-৪-১-১ ছকে। ওপরে যে দুজন খেলেছেন, তাঁদের কেউই স্ট্রাইকার নন। বার্নার্দো সিলভা আর কেভিন ডি ব্রুইনা মিডফিল্ডার হলেও সেদিন খেলেছিলেন 'ফলস নাইন' বা ছদ্ম স্ট্রাইকার হিসেবে। ওদিকে প্রথাগত স্ট্রাইকার গ্যাব্রিয়েল জেসুসকে খেলানো হয়েছিল লেফট উইঙ্গার হিসেবে।

গার্দিওলা চাইবেন যেকোনো মূল্যে কোয়ার্টারে উঠতে। ফাইল ছবি
গার্দিওলা চাইবেন যেকোনো মূল্যে কোয়ার্টারে উঠতে। ফাইল ছবি

এখানেই ফাটকাটা কাজে লেগে যায়। মিডফিল্ডে বলের দখল পাওয়ার জন্য প্রায় সময়ই দুজন মিডফিল্ডারকে সাহায্য করতে নেমে যাচ্ছিলেন ডি ব্রুইনিয়া ও বার্নার্দো। আর তাঁদের ফেলে আসা জায়গাতে বামদিক থেকে উঠে যাচ্ছিলেন জেসুস। জেসুসের চলাফেরা ঠিকমতো দেখে রাখতে গিয়েই ঝামেলায় পড়েন রামোস, দেখেন লাল কার্ড। রামোসকে ছাড়াই আজ মাঠে নামবে রিয়াল।

রামোসের জায়গায় কাকে খেলানো হবে, সে নিয়ে বেশ চিন্তায় থাকার কথা জিদানের। খোলা চোখে, রামোসের জায়গায় সরাসরি ব্রাজিলের সেন্টারব্যাক এদের মিলিতাওকে খেলানোর কথা। কিন্তু এখানেও আছে ঝামেলা। প্রায়ই রাইটব্যাক হিসেবে খেলা ডান পায়ের মিলিতাও সেন্টারব্যাক হিসেবে খেললে ডানদিকেই খেলতে পছন্দ করেন। ওদিকে মূল দলে দুজন সেন্টারব্যাকের মধ্যে রামোস খেলেন বামদিকে, রাফায়েল ভারান ডানে। তাই এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে এদের মিলিতাও যাতে স্বচ্ছন্দভাবে খেলতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ভারানের কাঁধেই বেশি পড়বে। সে ক্ষেত্রে হয়তো ভারানকে দুই সেন্টারব্যাকের মধ্যে বামদিকে দেখা যাবে। ডানদিকে যথারীতি থাকবেন কারভাহাল।

মিডফিল্ডে জিদান কাকে কাকে খেলাবেন, তাঁর ওপর নির্ভর করবে কারভাহালের ভূমিকা। করোনা-পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, প্রায় সময়ই বেশি ওপরে উঠে না গিয়ে ছদ্ম-সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে টনি ক্রুস বা কাসেমিরোদের সহায়তা করছেন কারভাহাল। সে কৌশল যদি এই ম্যাচেও খাটানো হয়, তাহলে কারভাহালকে মাঝমাঠে জায়গা করে দেওয়ার জন্য ফর্মে ফেরা লুকা মদরিচ চলে আসবেন একটু ডানদিকে, সেখান থেকেই নিখুঁত পাসগুলো দিতে থাকবেন। রামোস যেহেতু নেই, সেহেতু রিয়ালের গোটা দলকেই রক্ষণভাগের সেই বাড়তি দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে দুই সেন্টারব্যাকের মাঝে ছদ্ম-সেন্টারব্যাক হিসেবে নেমে যেতে পারেন কাসেমিরো।

রক্ষণভাগের বামদিকে হয় মার্সেলো, অথবা ফরাসি লেফটব্যাক ফারলান্ড মেন্ডিকে খেলানো হবে। লকডাউনের পর মেন্ডি যেমন ফর্মে আছেন, এর পর তাঁকে এই ম্যাচে উপেক্ষিত রাখা বেশ কঠিনই হবে জিদানের জন্য। চোট থেকে ফেরা এডেন হ্যাজার্ড যদি ৪-৩-৩ ছকে লেফট উইঙ্গার হিসেবে খেলেন, সে ক্ষেত্রে জিদানের আদর্শ লেফটব্যাক হবেন মেন্ডি। কারণ মার্সেলোর চেয়ে রক্ষণকাজে মেন্ডির উপযোগিতা বর্তমানে যথেষ্ট বেশি। আর হ্যাজার্ডও ওপর থেকে বলতে গেলে তেমন নামতে চান না। আক্রমণ করার দিকেই থাকে তাঁর পূর্ণ মনোযোগ। তাই রক্ষণভাগের স্থিতি বজায় রাখার জন্য হ্যাজার্ড-মেন্ডি জুটি কার্যকরী হতে পারে।

রামোস নেই, মিলিতাওর কাঁধে তাই বাড়তি দায়িত্ব। ছবি : এএফপি
রামোস নেই, মিলিতাওর কাঁধে তাই বাড়তি দায়িত্ব। ছবি : এএফপি

কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে মার্সেলোর আক্রমণে সহযোগিতা করার কথাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কাজেই আক্রমণভাগে নিয়মিত উঠে মার্সেলোর নিখুঁত ক্রস, পাস দেওয়ার প্রবণতাকে যদি জিদান কাজে লাগাতে চান, সে ক্ষেত্রে মার্সেলোর সামনে জিদান এমন একজনকে চাইবেন, যে প্রয়োজন মতো নিচে নেমে রক্ষণকাজেও সহযোগিতা করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে মার্সেলোর সামনে আদর্শ লেফট উইঙ্গার হতে পারেন তাঁরই স্বদেশি ভিনিসিয়ুস জুনিয়র।

ম্যাচ জেতার জন্য রিয়ালের বামদিক, অর্থাৎ সিটির ডানদিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সিটির ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ফার্নান্দিনহোর বয়স বেড়ে গেছে, আস্তে আস্তে স্পেনের রদ্রিকে এই জায়গায় খেলাচ্ছেন গার্দিওলা, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই মৌসুমে রদ্রি ফার্নান্দিনহোর মতো তেমন সুশৃঙ্খল পারফরম্যান্স দিতে পারেননি। বামদিকের সেন্টারব্যাক আয়মেরিক লাপোর্তের আদর্শ সঙ্গী কে হবেন, গার্দিওলা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি। জন স্টোনস, নিকোলাস ওতামেন্দি এমনকি ফার্নান্দিনহোকেও এই ডানদিকের সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলিয়েছেন গার্দিওলা। শেষমেশ থিতু হয়েছেন তরুণ সেন্টারব্যাক এরিক গার্সিয়ার কাছে এসে।

ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে ফার্নান্দিনহো তেমন ওপরে উঠতে চান না। প্রতিপক্ষের আক্রমণ নস্যাৎ করে নিখুঁত পাস দেওয়াই তাঁর লক্ষ্য। ওদিকে রদ্রি তা না। ও দুটো কাজ করার পাশাপাশি গত মৌসুমে অ্যাটলেটিকো থেকে সিটিতে আসা এই তারকা প্রায় সময়েই ওপরে উঠে যান। ফলে মাঝমাঠে ফাঁকা জায়গা পেয়ে যায় প্রতিপক্ষ। যে কারণে রক্ষণভাগের সামনে এই ফাঁকা জায়গাটায় প্রায়ই বল হারিয়েছে সিটি, দূরপাল্লার শটে গোল খেয়েছে। রিয়ালের বিপক্ষে প্রথম লেগের কথাই ধরুন। ম্যাচ হারলেও, রিয়ালের হয়ে ইসকো যে এক গোল করেছেন, সে গোলটাও এসেছে মাঝমাঠে সিটির বল হারানোর ফলেই। আর এই জায়গাটার আদর্শ ব্যবহার করার জন্য ইডেন হ্যাজার্ডের চেয়ে ভালো খেলোয়াড় নেই জিদানের হাতে। তাই বয়সী ফার্নান্দিনহো, বা তরুণ রদ্রি-সিটির মাঝমাঠে রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে যে-ই থাকুক না কেন, হ্যাজার্ড হতে পারেন জিদানের তুরুপের তাস।

সিটির দুর্বলতা কাজে লাগাতে প্রস্তুত হ্যাজার্ড-বেনজেমা? ছবি : এএফপি
সিটির দুর্বলতা কাজে লাগাতে প্রস্তুত হ্যাজার্ড-বেনজেমা? ছবি : এএফপি

রিয়ালের বামদিকে হ্যাজার্ড/মেন্ডি কিংবা মার্সেলো/ভিনিসিয়ুসের পাশাপাশি সিটির এই দুর্বলতা কাজে লাগাবেন করিম বেনজেমা। স্ট্রাইকার হলেও, প্রায় সময়েই বামদিকে নেমে এসে খেলা গড়ে দেওয়ার কাজে সিদ্ধহস্ত এই স্ট্রাইকারকে সামলাতে গার্দিওলার ডানদিকের সেন্টারব্যাক (গার্সিয়া/ওতামেন্দি) ও রাইটব্যাক কাইল ওয়াকার কী করেন, সেটাই দেখার বিষয়। ওদিকে এরিক গার্সিয়া জানিয়ে দিয়েছেন, ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে চুক্তি নবায়ন না করে বার্সেলোনায় যাওয়ার ইচ্ছে তাঁর। যে খেলোয়াড় সিটির হয়ে খেলতেই চান না, তাঁকে গার্দিওলা এই ম্যাচে খেলান কি না, দেখার বিষয় সেটাও। না খেলালে, সে ক্ষেত্রে লাপোর্তের সঙ্গী হবেন ওতামেন্দি। যে ওতামেন্দি রিয়ালের বিপক্ষে প্রথম লেগেও মাঠে ছিলেন।

গার্দিওলা যদি সাবধানী খেলে কোনোভাবে এই লেগ পার করে কোয়ার্টারে উঠতে চান, সে ক্ষেত্রে প্রথম লেগের মতো এ ম্যাচেও জেসুস খেলতে পারেন বাম উইংয়ে, রিয়াল মাহরেজের জায়গায় দলে আসবেন বার্নার্দো সিলভা। মাহরেজের চেয়ে যিনি নিচে নেমে রক্ষণ করতেও আগ্রহী, আক্রমণের পাশাপাশি। কিন্তু নিজেদের মাঠে সাহসী হয়ে রামোস না থাকার সুবিধা কড়ায় গন্ডায় নিতে চাইলে যথারীতি ৪-৩-৩ ছকেই দেখা যাবে ম্যানচেস্টারের নীল দলকে, প্রথম লেগের মতো ৪-৪-২ ছকে নয়।

সব প্রশ্ন, সব ধাঁধার উত্তর মিলবে আজ রাত একটায়।

সম্ভাব্য লাইনআপ -
রিয়াল মাদ্রিদ : থিবো কোর্তোয়া ; দানি কারভাহাল, এদের মিলিতাও, রাফায়েল ভারান, ফারলান্ড মেন্ডি ; লুকা মদরিচ, কাসেমিরো, টনি ক্রুস ; ফেদেরিকো ভালভার্দে, করিম বেনজেমা, এডেন হ্যাজার্ড
ম্যানচেস্টার সিটি : এডারসন ; কাইল ওয়াকার, নিকোলাস ওতামেন্দি, আয়মেরিক লাপোর্তে, জোয়াও ক্যানসেলো ; ইলকায় গুন্দোগান, রদ্রি ; রিয়াদ মাহরেজ, কেভিন ডি ব্রুইনিয়া, রহিম স্টার্লিং ; গ্যাব্রিয়েল জেসুস