রিয়াল বুঝছে রোনালদোর অভাব, রোনালদোও বুঝছেন রিয়াল কী

এখন আর রিয়ালের আক্রমণ নিয়ে ভয়ে থাকতে হয় না প্রতিপক্ষকে। ছবি: এএফপি
এখন আর রিয়ালের আক্রমণ নিয়ে ভয়ে থাকতে হয় না প্রতিপক্ষকে। ছবি: এএফপি

পুনর্মিলনীর অপেক্ষায় ছিল সবাই। কিন্তু টানা দ্বিতীয়বারের মতো রিয়াল মাদ্রিদ-ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে মুখোমুখি দেখার আশা পূরণ হলো না। গতবার তবু নিজের কাজটা সেরে রেখেছিলেন রোনালদো, সবাইকে বঞ্চিত করার দায়টা পড়েছিল রিয়ালের ঘাড়ে। এবার জুভেন্টাস-রিয়াল দুদলই বাদ চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলো থেকে। একই দিনে, একই সময়ে। দায়টা এবার দুই পক্ষেরই।

কে জানে, ফুটবলই হয়তো চায় না এ দুই দল মুখোমুখি হোক! আবার দেখা হোক রোনালদো–রিয়ালে! হয়তো ইঙ্গিতে বলে দিতে চাইছে—যারা হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে, যাদের রত্ন চিনতে পারার ক্ষমতায় ঘাটতি আছে, তাদের কপালে এমন পুনর্মিলনীর সৌভাগ্য নেই।

ভিন্ন দুই মাঠে গতকাল রাতে একই লক্ষ্যে নেমেছিল দুই পক্ষ, গোল করতে হবে। রোনালদোর জন্য কাজটা সহজ। দারুণ ছন্দে থাকা রোনালদো করেছেনও দুই গোল। ওদিকে ম্যানচেস্টার সিটির মাঠে বেনজেমা একটি গোল এনে দিলেও রিয়ালকে করতে হতো আরও দুই গোল। কিন্তু দুই বছর আগে ক্লাব ছেড়ে দেওয়া রোনালদোর মতো কাউকে তো আর পায়নি রিয়াল যে পিছিয়ে পড়লেও প্রতিপক্ষের মাঠে তিন গোল করার মতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলতে পারবে। তাই রোনালদোবিহীন রিয়াল টানা দ্বিতীয়বারের মতো শেষ ষোলো থেকে ছিটকে পড়ল।

চিত্রপট অনুযায়ী এটুকু ঠিকই আছে। ২০১৮ সালে রোনালদো যখন রিয়াল ছাড়লেন, মনেই হয়েছিল ক্ষতিটা শুধু রিয়ালেরই হয়েছে। হাজার হলেও মৌসুমে ৫০ গোলের নিশ্চয়তা হারাচ্ছে রিয়াল। ওদিকে রোনালদো দেড়গুন বেশি বেতন পাচ্ছেন জুভেন্টাসে, আর জুভেন্টাসও পাচ্ছে রোনালদোর মতো মহাতারকা। এক লাফেই ক্লাবের ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ বেড়ে গেছে। আর সে সঙ্গে বেড়েছে ক্লাবের চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার সম্ভাবনা।

রোনালদোবিহীন প্রথম মৌসুমে খাবি খেয়েছে রিয়াল। মার্চের মধ্যে সব প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়েছে। ক্লাবের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে রক্ষণ ও আক্রমণের যুগপৎ রেকর্ড গড়েছে। ক্লাবের সমর্থকদের আনন্দ দেওয়ার সব আশা এক ১৯ বছরের কিশোরের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওদিকে রোনালদো জুভেন্টাসে গিয়ে জিতেছেন শিরোপা, হয়েছেন লিগের সেরা খেলোয়াড়। প্রায় অসম্ভব মনে হওয়া পরিস্থিতিতেও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে দলকে তুলে নিয়েছেন পরের ধাপে। আয়াক্সের কাছে হেরে বাদ পড়ার পরও মনে হয়েছিল, রোনালদোর সিদ্ধান্ত হয়তো ভুল নয়। রোনালদো ১-০ রিয়াল!

এ মৌসুমে গল্পটা কিছু বদলেছে। একদিকে মেসির বার্সেলোনাকে টপকে লিগ জিতেছে রিয়াল। ওদিকে প্রথম দিকে খোড়ানো জুভেন্টাসও পেয়েছে টানা নবম সিরি ‘আ’ ট্রফি। রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়েরা সদর্পে বলতে পেরেছেন, রোনালদোকে ছাড়াও লিগ জেতা সম্ভব। ওদিকে জুভেন্টাসের হয়ে প্রায় একাই গোল করার দায়িত্ব নেওয়া রোনালদোকে টপকে মৌসুম সেরা খেলোয়াড় বনেছেন পাওলো দিবালা। অর্থাৎ দলের মূল খেলোয়াড় রোনালদো, এ কথা বলার উপায় নেই! রোনালদো ১-১ রিয়াল!

কিন্তু রিয়াল ও রোনালদোর মূল পরিচয় তো চ্যাম্পিয়নস লিগ। অন্য ক্লাবগুলো যেখানে এ শিরোপা পাওয়ার আশায় কত কিছুই না করে, সেখানে এ ট্রফি যেন সেধে রিয়ালের কাছে ধরা দেয়। অন্য ফুটবলাররা যেখানে লিগে গোল বন্যার পর চ্যাম্পিয়নস লিগে গোলের রাস্তা ভুলে যান, সেখানে ইউরোপ সেরার প্রতিযোগিতায় ক্ষুধা বেড়ে যায় রোনালদোর। আধুনিক চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউটে টানা দুই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করার মতো ঘটনা তো তাঁর সুবাদেই দেখা গেছে। তাই রোনালদো ও রিয়ালের বিচ্ছেদে প্রকৃত বিজয়ীর নাম জানার জন্য চ্যাম্পিয়নস লিগের দিকেই তাকাতে হচ্ছিল।

কাল একই সময়ে দুই ম্যাচ হয়ে যাওয়াতে সেটা জানাও হয়ে গেল। নিজের মাঠে দুটি গোল করেছেন রোনালদো, নিজের শত চেষ্টার পরও দলকে কোয়ার্টারে নিতে পারেননি। ওদিকে ভারানের দুই ভুলে হারলেও দলীয়ভাবেই বাজে খেলেছে রিয়াল। কিন্তু দুই মাঠের দুই পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছিল দুজন দুজনের অভাব কতটা টের পাচ্ছে। একদিকে রিয়ালের কাল দরকার ছিল প্রকৃত এক গোলশিকারির। সে সঙ্গে রামোসের অনুপস্থিতিতে ধরা পড়েছে একজন প্রকৃত নেতার অভাব। দলের প্রয়োজনে ঠিক যেভাবে সতীর্থদের চাঙা করতেন রোনালদো। যার ওপর ভর করে চ্যাম্পিয়নস লিগের ধাপগুলো এত দিন অনায়াসে পেরিয়েছে তারা। রক্ষণ অটুট রেখে লিগ জেতা সম্ভব হলেও চ্যাম্পিয়নস লিগের জন্য আক্রমণ আর মানসিক আগ্রাসন শেষ কথা।

মাঠে যোগ্য সঙ্গী পাচ্ছেন না রোনালদো। ছবি: এএফপি
মাঠে যোগ্য সঙ্গী পাচ্ছেন না রোনালদো। ছবি: এএফপি

ওদিকে কাল দিবালার অনুপস্থিতিতে সঙ্গীহীন হয়ে পড়া রোনালদো বুঝেছেন রিয়াল স্কোয়াডের মূল্য। রিয়ালের জার্সিতে নিজের বাজে দিনেও সতীর্থদের ওপর ভরসা রাখতে পারতেন। ক্রুস, মদরিচ কিংবা বেনজেমার ওপর আস্থা রাখতে পারতেন পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাওয়ার। কিন্তু কাল নিজের সর্বস্ব নিংড়ে দিয়েও দেখলেন সতীর্থরা তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে ব্যর্থ। হিগুয়েনকে থালায় সাজিয়ে দেওয়া খাবারের মতো ক্রস দিয়েছেন, সেটা গোলের ধারে কাছে যায়নি। বেনতাঙ্কুর গোলপোস্ট ফাঁকা পেয়েও বল জালে পাঠাতে পারেননি। অন্তত ইউরোপের মঞ্চে দাপট দেখানোর মতো ক্রুস-মদরিচ ধাঁচের সৃষ্টিশীলতা নেই জুভেন্টাসের মাঝমাঠে। নেই রামোসের মতো অধিনায়ক। পাশে নেই বেনজেমার মতো কোনো নিঃস্বার্থ আক্রমণ–সঙ্গী। ফলাফল একদিকে মাঠে নেতৃত্বের অভাব আর গোলের জন্য হাহাকার করে বিদায় নিল রিয়াল, ওদিকে যোগ্য সঙ্গীর জন্য হাপিত্যেশ নিয়ে ফিরতে হলো রোনালদোকে।

লিগে যাই হোক না কেন, ইউরোপ সেরা প্রতিযোগিতাতে রিয়াল-রোনালদো জুটিটা ছিল অদ্বিতীয়, যার বর্ণনায় বলা যায় ‘ম্যাচ মেড ইন হেভেন’। যেদিন আর কেউ পারছেন না সেদিন রোনালদো জ্বলে উঠছেন। যেদিন রোনালদো গোলের রাস্তা খুঁজে পান না, সেদিন বেল-বেনজেমা-রামোসরা দলকে বিপদমুক্ত করেছেন। কিন্তু অহমের লড়াই সে জুটিটা ভেঙে দিয়েছে দুবছর আগে। আর দুই মৌসুমে সবাই নিশ্চিত হতে পেরেছে এই দলবদলে ক্ষতি তিন পক্ষেরই হয়েছে। রিয়াল হারিয়েছে তাদের ‘ফিয়ার ফ্যাক্টর’, রোনালদো হারিয়েছেন ভরসার কেন্দ্র, আর জুভেন্টাস ক্লাবের আর্থিক চেহারা রুগ্‌ণ বানিয়ে পেয়েছে মূল্যবান এক শিক্ষা, ‘শুধু এক রোনালদোই চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতাতে পারেন না।’

দুই বছর পর জানা গেল, রোনালদো ১-০ রিয়াল বা রিয়াল ১-০ রোনালদো নয়। বরং দুই পক্ষই আত্মঘাতী গোল দিয়ে বসে আছে। এই খেলায় হেরেছে দুপক্ষই! সাধারন ফুটবলপ্রেমীরাও কি হারেনি? রিয়াল–রোনালদো; কে জানে এমন জুটি কবে আর কোথায় আবার দেখতে পাবে তারা!