'অননুমেয়' পাকিস্তানের পরীক্ষা ইংলিশ বীরত্বের সামনে

পাকিস্তানের সংজ্ঞা বদলে দিল ইংল্যান্ড। ছবি: এএফপি
পাকিস্তানের সংজ্ঞা বদলে দিল ইংল্যান্ড। ছবি: এএফপি

ক্রিকেটে পাকিস্তানকে সব সময়ই ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ দল বলা হয়। কখন যে এ দলটি কী করবে, কখন যে এ দলের কোন ক্রিকেটার বাজিমাত করবে, সেটা আগে থেকে বলে দেওয়া যায় না। কিন্তু কোনো দল যখন টেস্টের চার দিনের তিন দিনই প্রতিপক্ষের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে শেষ পর্যন্ত হেরে যায়, তখন সে দলকে কি বলা যায়?

পাকিস্তানের বিখ্যাত ক্রিকেট সাংবাদিক উসমান সামিউদ্দিন তাঁর দেশের ক্রিকেট দলের অনিশ্চিত ব্যাপারটি নিয়ে গর্বই করেছেন। একটা লেখায় তিনি লিখেছিলেন, যখন পাকিস্তান ক্রিকেট দল দারুণ কিছু ঘটার ব্যাপারটি অনুভব করতে পারে, তখনই তারা তেতে ফুঁড়ে ওঠে। ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিপক্ষের ওপর, চেপে ধরে আদায় করে নেয় কাঙ্ক্ষিত জয়।

সামিউদ্দিন তাঁর সেই লেখায় ওয়াকার ইউনিসের মন্তব্যও দিয়েছিলেন এ ব্যাপারে। ওয়াকার বলেছিলেন, ‘ম্যাচে ভালো কিছু ঘটবে, এমনটা অনুভব করতে পারলেই নিজেদের মধ্যে আমরা সেটা নিয়ে কথা বলতাম। আমরা নিজেদের অনুপ্রাণিত করতাম এই বলে, “চলো, চেপে ধরি!”’

কিন্তু সেই অননুমেয় পাকিস্তানের ‘ট্যাগ’ আজহার আলীর বর্তমান দলটির সঙ্গে যায় কিনা, সেটা আলোচনা সাপেক্ষ। কারণ এই দলটা যে ‘অননুমেয়’ অন্য অর্থে। এরা যে জয়ের গন্ধ পেয়েও জয়টা হাত ফসকে ফেলে দেয়। ম্যানচেস্টারে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে কথাটার যথার্থতা প্রমাণিত। প্রথম ইনিংসে বড় লিড নিয়েও দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং ব্যর্থতা দলের। শক্তিশালী বোলিং দিয়ে সে ঘাটতি পূরণ করার পরে ম্যাচটাও পাকিস্তানের কাছ থেকে রীতিমতো ছিনিয়ে নিয়ে গেল ইংল্যান্ড।

উল্টো দিকে ইংল্যান্ডের এই জয়কে বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকা বলছে ‘অ-ইংলিশ’ চরিত্রের। সাংবাদিক অ্যান্ডি বুল তাঁর কলামে বলছেন, ইংলিশ ক্রিকেট দলেও অনিশ্চয়তার জাদু ভর করেছে। তবে সেটি পাকিস্তানের মতো এখনো অতটা বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই অনিশ্চয়তার জাদু দিয়েই ক্রিকেট মানচিত্রে অন্যরকম একটা জায়গা দখল করে ফেলেছে দলটি। গত বছর অ্যাশেজ সিরিজে হেডিংলি টেস্টের পর করোনা-পরবর্তী সময়ের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্ট—ইংলিশ ক্রিকেট দল এখন একটা জিনিস খুব ভালো বোঝে, যেকোনো পরিস্থিতিতে, চাপের মধ্যে থেকেও সেরা খেলাটা খেলতে জানেন তাদের ক্রিকেটাররা।

অ্যান্ডি বুল গার্ডিয়ানে এ ব্যাপারটিকে ‘অ-ইংলিশ ব্যাপার বলছেন কেন? বলছেন এ কারণে যে ২০১৫ সাল পর্যন্তও চাপের মুখে ভেঙে পড়াই যেন ছিল ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের চরিত্র। কিন্তু ২০১৬ সালের পর থেকে নিজেদের চরিত্র নিজেরাই পাল্টে ফেলেছে তারা। ওয়ানডে ক্রিকেটই যে আগের অবস্থাটা বদলাতে সাহায্য করেছে, সেটাই বলতে চেয়েছেন তিনি। ওয়ানডেতে চরিত্র বদলে বিশ্বজয় করেছে তারা। ৩৫০-৪০০ রানের লক্ষ্যমাত্রা ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা অনায়াসেই পেরিয়ে গেছেন নিজেদের ভয়ডরহীন ব্যাটিংয়ে। ওয়ানডের সেই বিশ্বাসটাই এখন বড় সংস্করণে প্রবাহিত—‘যেকোনো কিছুই সম্ভব’ ইংলিশ ক্রিকেটারদের দিয়ে। গত বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হেডিংলি টেস্ট কিংবা এ বছরের ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্ট সেটিরই উদাহরণ। নয়তো পাকিস্তানের বিপক্ষে ২৭৭ রান তাড়া করার ব্যাপারটি এমন সহজেই হয়ে গেল কীভাবে! ১১৭ রানে প্রথম ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলা; জো রুট, বেন স্টোকসদের দ্রুত ফিরে যাওয়ার পরেও ইংল্যান্ড জয়ী জস বাটলার আর অলরাউন্ডার চরিত্র ভুলে যেতে বসা ক্রিস ওকসের বীরত্বে। বাটলার নিজের বাবাকে হাসপাতালে রেখে ইংল্যান্ডকে ম্যাচ জিতিয়েছেন, ওকস জাগিয়ে তুলেছেন নিজের ব্যাটিং-সত্তা। এগুলো তো ইংলিশ ক্রিকেটের নব যুগের বার্তা। পাকিস্তানের চিরায়ত অনিশ্চয়তার জাদু এখন বদলে গেছে ইংল্যান্ডের বীরত্বের হুংকারে। ভবিষ্যতে ইংল্যান্ডে যেখানেই, যে প্রতিপক্ষের বিপক্ষেই খেলুক, মনে হবে কিছুই অসম্ভব নয় তাদের জন্য।

ইংল্যান্ডের জন্য এই জয় যখন শুভবার্তা। পাকিস্তানের জন্য এটি অশনিসংকেত। ওল্ড ট্রাফোর্ডে জিতে যেখানে সিরিজের বাকি সময়টার জন্য বড় ধরনের জ্বালানি মজুত করে ফেলার কথা তাদের, সেখানে এখন চলছে আত্মসমালোচনা। অধিনায়ক আজহার আলীই মূলত চাপটা বেশি অনুভব করছেন। এমনিতেই গত নভেম্বরে টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে স্থায়ী হওয়ার পর থেকে তাঁর ব্যাটে খরা। তারওপর প্রথম টেস্টে ব্যর্থতার দায়ভারটা তাঁর ঘাড়েই চাপাতে চাইছেন বেশির ভাগ সাবেক ক্রিকেটাররা। ওয়াসিম আকরাম তো বলেই দিয়েছেন, আজহারের কৌশলগত ভুলেই ম্যানচেস্টারে হেরেছে পাকিস্তান। ম্যাচটির শেষ অংশ বিশ্লেষণ করলেই ওয়াসিম আকরামের কথার সত্যতা খুঁজে নেওয়া সম্ভব। ১১৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ড যখন ধুঁকছে, তখন আজহার আলীর দল লাগামটা হালকা করে দিয়েছে। শাহীন শাহ আফ্রিদি, নাসিম শাহ—এই দুই ফাস্ট বোলারের মাত্র ২৮.১ ওভার বোলিং করা, ইয়াসির শাহকে দেরি করে বোলিং আক্রমণে ফেরানো—এগুলোই আজহারের ব্যর্থতা। পাকিস্তানি সাংবাদিক সামিউদ্দিনের যে উদাহরণটি দিয়ে লেখাটি শুরু হয়েছিল, সেটিতেই আবার ফিরতে হচ্ছে—পাকিস্তান ক্রিকেটের অননুমেয়তার জাদু বদলে গিয়ে এখন দেখা দিয়েছেন নতুন ধরনের অননুমেয়তা। সেটা হলো, প্রতিপক্ষকে চেপে ধরার পরেও বোঝা যাবে না ম্যাচটা সত্যি সত্যিই শেষ অবধি পাকিস্তান জিতবে কিনা!

ক্রিকেটে গৌরবোজ্জ্বল অনিশ্চয়তার সংজ্ঞাটা কী দারুণভাবেই না বদলে দিয়েছে ইংলিশরা!