নেইমারদের আসল প্রতিপক্ষ ধূসর চুলো এক ফুটবল-মস্তিষ্ক

আতালান্তা লড়বে পিএসজির সঙ্গে। ছবি : আতালান্তা টুইটার
আতালান্তা লড়বে পিএসজির সঙ্গে। ছবি : আতালান্তা টুইটার

পিঁপড়ের দলের মতো সংঘবদ্ধ হয়ে শহর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক মিলিটারি ট্রাক। লাইন ধরে।

ট্রাকে নেই কোনো সৈন্য-সামন্ত বা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সম্ভার। তবে যারা শহরটার পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন না, হুট করে দেখলে মনে করবেন, ইতালিতে যুদ্ধ লেগেছে বুঝি!

যুদ্ধ? হ্যাঁ। তা তো অবশ্যই। তবে এ যুদ্ধ মানুষের সঙ্গে মানুষের নয়। আধুনিক সমরাস্ত্রের হুংকার শোনা যায়নি এ যুদ্ধে। এ যুদ্ধ নিঃশব্দে জানিয়ে দিয়ে গেছে মানুষের অসহায়ত্বের কথা। জানিয়েছে, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সভ্যতার উত্তরণের দিক দিয়ে মানুষ যোজন যোজন এগিয়ে গেলেও দিন শেষে তারা অজেয় নয়। ছোট্ট একটা ভাইরাস এখনো চাইলে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে সৃষ্টির সেরা জীবকে।

ইতালিতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল আতালান্তার বার্গামো শহর। বলা হচ্ছে, এই অঞ্চলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ছয় হাজারেরও বেশি মানুষ। অবস্থা এমন হয়েছিল, শহরে সৎকার করার জায়গা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সাহায্য নেওয়া হয়েছিল মিলিটারি ট্রাকের। আধুনিক যুদ্ধের প্রশিক্ষণ পাওয়া মিলিটারিরা শহর থেকে বাড়তি মৃতদেহ বহন করে বাইরে সৎকারের ব্যবস্থা করছিলেন।

শুধু তাই নয়। একের পর এক প্রিয়জনের মৃত্যুর কান্নায় ভারী হয়ে ওঠা বার্গামোর আকাশে জমা হয় দোষারোপের কালো মেঘ। বলা হয়, ১৯ ফেব্রুয়ারিতে মিলানে ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে আতালান্তার ওই ম্যাচটা না হলে হয়তো করোনা আক্রান্তের সংখ্যা আরও কমত। ইঙ্গিতটা পরিষ্কার, ইতালি ও স্পেনে ভাইরাস ছড়ানোর পেছনে দায়ী এই আতালান্তা।

হ্যাঁ, জিয়ানপিয়েরো গাসপেরিনির সেই আতালান্তা, যারা নেইমার-এমবাপ্পেদের পিএসজি আর চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালের মাঝে এখন একমাত্র বাধা।

কিছুদিন আগেও প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ক্ষণ গুনতে থাকা শহরবাসীর মুখে এক চিলতে হাসি ফোটানোই এই আতালান্তা দলের মূল লক্ষ্য। আর এই লক্ষ্যে সর্বগ্রাসী সেই ভাইরাস কি একটু হলেও আতালান্তার সুবিধা করে দিল?

করোনাভাইরাসের কারণে পরিবর্তন এসেছে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফরম্যাটে। নকআউট পর্বে গত ১৬ বছর ধরে দুই লেগের প্রতিযোগিতা হয়ে আসছে, এবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে এই প্রতিযোগিতা চলবে এক লেগে। খেলোয়াড় ও কোচদের শক্তিমত্তা, কৌশলের লড়াই, মানসিক দৃঢ়তা—সবকিছুর শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হবে নিরপেক্ষ মাঠে, নব্বই মিনিটের মধ্যে, ১৮০ মিনিটে নয়। আর এখানেই সুবিধা পেতে পারে আতালান্তা।

এর আগে চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট পর্বের ফরম্যাট যখন পরিবর্তিত হয়েছিল, তথাকথিত বড় দলগুলো হুট করে সে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি। ২০০৩-০৪ মৌসুমের সেমিফাইনালে সেবার উঠেছিল চেলসি, দেপোর্তিভো লা করুনিয়া, পোর্তো ও মোনাকোর মতো দলগুলো। ফাইনালে মোনাকোকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল পোর্তো, যে ফাইনাল এখনো চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসের অন্যতম অপ্রত্যাশিত ফাইনাল হিসেবে বিবেচিত। ১৬ বছর পর নকআউট রাউন্ডের ফরম্যাটে পরিবর্তন আসায় আতালান্তা তাই আশাবাদী।

কিন্তু শুধু ফরম্যাটের পরিবর্তনের জন্যই আতালান্তা অঘটন ঘটিয়ে দেবে, চ্যাম্পিয়নস লিগে অর্জন করবে বড় কিছু—এমন কিছু বললে তাদের শক্তিমত্তা, কৌশল ও ফুটবলশৈলীর প্রতি অবজ্ঞাই করা হবে। গত তিন বছর ধরে তারা এমনই অসাধারণ মানের ফুটবল খেলছে!

আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ৬২ বছরের ধূসর চুলো এক ফুটবল-মস্তিষ্কের। নাম তাঁর জিয়ানপিয়েরো গাসপেরিনি। গাসপেরিনি নামটা শুনলেই নিয়মিত ফুটবল অনুসরণকারীদের মাথায় সবার আগে একটা তথ্যই আসে। ইন্টার মিলানের কোচ হয়ে মাত্র তিন মাস টিকেছিলেন এই ভদ্রলোক। ২০১১ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। সেবার তাঁর অধীনে পাঁচ ম্যাচ খেলা ইন্টার হেরেছিল চারটিতে, কোনোরকমে ড্র করেছিল বাকিটায়। রবার্তো মানচিনি, হোসে মরিনহোর অধীনে সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করা ইন্টার মরিনহোর বিদায়ের পর হন্য হয়ে তখন এমন একজন ম্যানেজার খুঁজছে, যে ইন্টারকে নিয়মিত অমন সাফল্য এনে দিতে পারে। রাফায়েল বেনিতেজ, লিওনার্দো—কেউ সফল হননি। সফল হয়ে ওঠা হয়নি গাসপেরিনিরও। তিন মাস পর তাঁর বিদায়টা হয়েছিল নীরবে-নিভৃতে। সে গাসপেরিনিই এখন আতালান্তার মতো ক্লাবের হয়ে সোনা ফলাচ্ছেন। ১১২ বছর আগে প্রতিষ্ঠা পাওয়া, নিজেদের ইতিহাসে লিগ-চ্যাম্পিয়নস লিগ তো দূর, মাত্র একটা ইতালিয়ান কাপ জেতা দলটা এই গাসপেরিনির অধীনেই এখন স্বপ্ন দেখছে নেইমারদের হারানোর।

জিয়ানপিয়েরো গাসপেরিনি। ছবি: আতালান্তা টুইটার
জিয়ানপিয়েরো গাসপেরিনি। ছবি: আতালান্তা টুইটার

গাসপেরিনির গোটা ক্যারিয়ারটাই এমন। ইন্টার ছাড়া কখনো তেমন ‘বড়’ ক্লাবে কোচিং করার সুযোগ পাননি। বারবার ছোট ক্লাবের দায়িত্ব নিয়ে অভিনব কৌশলে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। গাসপেরিনির ফুটবল-প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হয়েছেন খোদ হোসে মরিনহোর মতো ম্যানেজার। ২০০৮-০৯ মৌসুমে জেনোয়ার দায়িত্বে থাকা গাসপেরিনি গোলশূন্য ড্রয়ে আটকে দিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন ইন্টারকে। গুণমুগ্ধ মরিনহো এটাও বলেছিলেন, ইতালিতে তাঁকে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা এই গাসপেরিনিই দিয়েছেন, ‘গাসপেরিনি সব সময় আমার কাজ অনেক কঠিন করে দেয়। আমি যখনই কৌশলে পরিবর্তন আনি, কোনো না কোনোভাবে সে ম্যাচের মধ্যেই তাঁর একটা সমাধান বের করে ফেলে। আমার দেখা সবচেয়ে আনন্দদায়ী গোলশূন্য ড্রয়ের ম্যাচ ছিল এটা।’

এক যুগ পর আবারও আরেকটা তথাকথিত ‘ছোট’ ক্লাবের দায়িত্ব নিয়ে গাসপেরিনি দেখাচ্ছেন তাঁর কেরামতি।

কিন্তু আতালান্তায় এমনকি আছে যা অন্য সব দলের চেয়ে তাদের আলাদা করছে? তারকা খেলোয়াড়দের ছড়াছড়ি? বিশ্বসেরা খেলোয়াড়দের সামর্থ্য? মালিকের অনিঃশেষ অর্থবিত্ত?

না, কোনোটাই নয়। তিনটি বিষয় আতালান্তাকে অনন্য করে তুলেছে। প্রথমত, কোচের তুলনামূলক জটিল কৌশল। দ্বিতীয়ত, খেলোয়াড়দের অনন্যসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারার প্রবণতা। তৃতীয়ত, কোচের পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাযথ খেলোয়াড় খুঁজে বের করা, এমন খেলোয়াড় যে একই সঙ্গে কোচের কৌশল মাঠে বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা রাখে, এবং যার জন্য তথাকথিত বড় ক্লাবগুলো টাকার থলি নিয়ে ঘুরছে না। এই তিন বিষয় আতালান্তাকে করে তুলেছে অনন্য।

প্রথমে কোচের কৌশলের দিকে আসা যাক। ইউরোপে খেলা অন্যান্য যেকোনো দলের চেয়ে আতালান্তার কৌশল অনেক জটিল। কোচ জিয়ানপিয়েরো গাসপেরিনি ইতালিয়ান হলেও কৌশল-বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে মনেপ্রাণে ডাচ। নব্বই দশকের শুরুর দিকে গাসপেরিনি যখন আস্তে আস্তে কোচিংয়ে নাম লেখাচ্ছেন, তখন বিশ্বের সবচেয়ে সফল দল ছিল এসি মিলান। আরিগো সাচ্চির দলকে ইতালিয়ান দলগুলো অন্ধের মতো অনুসরণ করত। ৪-৪-২ ছকের জয়জয়কার ছিল ইতালিতে। গাসপেরিনির আগ্রহ বরং সাচ্চি নয় ছিল একই সময়ে হল্যান্ডে রাজত্ব করা লুই ফন গালের আয়াক্সের দিকে। মাঠের প্রত্যেক খেলোয়াড় সব ভূমিকায় পারদর্শী, বল দখলের খেলায় অনন্য—ক্রুইফের দর্শনের সঙ্গে ফন গালের কার্যকারিতা মন জয় করে নেয় এ কোচের। সে দর্শনের বহিঃপ্রকাশ এখনো চলছে। গাসপেরিনির কৌশল বাস্তবায়ন করার জন্য সেরকম বুদ্ধিমান খেলোয়াড় থাকা বাঞ্ছনীয়, যে বুদ্ধিমান খেলোয়াড়ের সন্ধান আতালান্তার স্কাউট বিভাগ বেশ সাফল্যের সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে করে যাচ্ছে। 

আতালান্তার মূল ছক; ৩-৪-১-২। ছবি: সংগৃহীত
আতালান্তার মূল ছক; ৩-৪-১-২। ছবি: সংগৃহীত

মূলত, আতালান্তার ছক ৩-৪-১-২, ম্যাচের মধ্যে যে মাঝে মাঝেই ৩-৪-৩ হয়ে যায়। কোচের মূল একাদশ হল—পিয়েরলুইজি গোলিনি ; রাফায়েল তোলয়, হোসে লুইস পালোমিনো, বেরাত জিমসিতি ; হান্স হাটেবোর, মার্টেন ডে রুন, রেমো ফ্রয়লার, রবিন গসেনস ; আলেহান্দ্রো পাপু গোমেজ ; দুভান জাপাতা, জোসিপ ইলিচিচ। মূল একাদশের কেউ চোট বা অন্যান্য কারণে না খেলতে পারলে সুযোগ পান মাত্তিয়া কালদারা, বসকো সুতালো (যেকোনো সেন্টারব্যাকের পরিবর্তে) ; টিমোথি কাস্তানিয়ে (যেকোনো উইংব্যাকের পরিবর্তে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই হাটেবোরের বিকল্প হিসেবে খেলানো হয় তাঁকে) ; মারিও পাসালিচ (যেকোনো সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের পরিবর্তে বা মিডফিল্ডে বাড়তি কাউকে প্রয়োজন হলে আক্রমণভাগের একজনকে বসিয়ে এঁকে খেলানো হয়) ; লুইস মুরিয়েল (মূল স্ট্রাইকার দুভান জাপাতার বিকল্প) ; রুসলান মালিনভস্কি (আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার বা উইঙ্গারের বিকল্প)।

আতালান্তার খেলোয়াড়দের সবচেয়ে বড় গুণের কথা একটু আগেই বলা হয়েছে, সেটা হল তাঁদের বুদ্ধিমত্তা। মাঠের মধ্যে কখন কোথায় গিয়ে থাকতে হবে, সে সিদ্ধান্ত তাঁরা বেশ চমৎকারভাবে নিতে পারেন। আরেকটা গুণ হল, প্রত্যেক খেলোয়াড়ই একাধিক ভূমিকায় পারদর্শী। সেন্টারব্যাকদের কথাই ধরুন। ব্রাজিলের রাফায়েল তোলয়, আলবেনিয়ার বেরাত জিমসিতি, আর্জেন্টিনার হোসে লুইস পালোমিনো, ইতালির মাত্তিয়া কালদারা ; প্রত্যেকেই বল পায়ে অত্যন্ত পারদর্শী। ম্যাচের মধ্যে প্রায় সময় এদের আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারের মতো ওপরে উঠে যেতে দেখা যায়, বিশেষ করে তোলয়কে। আধুনিক অন্য যেকোনো দলের মতো আতালান্তাও নিচ থেকে আক্রমণ গড়তে চায়, ফলে সেন্টারব্যাকদের অনেক দক্ষ হতে হয় বল পায়ে। ওদিকে মিডফিল্ডার মার্টেন ডে রুন কে অনেক সময়ে দেখা যায় একদম নিচে গিয়ে ছদ্ম-সেন্টারব্যাকের ভূমিকা নিতে। রবিন গসেনস, হান্স হাটেবোর কিংবা টিমোথি কাস্তানিয়ে উইংব্যাক হলেও আতালান্তার কাছে বলের দখল থাকলে তাঁরা হয়ে যান পুরোদস্তুর উইঙ্গার! ওদিকে ম্যাচের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে সহকারী স্ট্রাইকার বা উইঙ্গারের ভূমিকায় থাকা জোসিপ ইলিচিচ কিংবা আলেহান্দ্রো পাপু গোমেজ মাঝেমধ্যেই মাঝমাঠে চলে আসেন, নেন মিডফিল্ডারের ভূমিকা।

কিন্তু এ ভূমিকার পরিবর্তনগুলো কখন হয়?

আতালান্তা ৩-৪-৩ কিংবা ৩-৪-২-১ ছকে খেললেও দলের আক্রমণ পরিকল্পনা নির্ভর করে আর্জেন্টিনার দুর্দান্ত আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার আলেহান্দ্রো পাপু গোমেজের ওপর। ডিয়েগো ম্যারাডোনা, হুয়ান রোমান রিকেলমের মতো এই আলেহান্দ্রো পাপু গোমেজও আদর্শ ‘নাম্বার টেন’ বা আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারের ভূমিকায় খেলে গেছেন বছরের পর বছর। তবে ম্যারাডোনা আর রিকেলমেদের একটা সুবিধা ছিল সব সময় আক্রমণ গড়ে তোলার দিকে নজর থাকত তাঁদের। প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করে বল কেড়ে নেওয়ার দিকে তাদের অত মনোযোগ না দিলেও চলত। গোমেজের আবার সেই সুবিধা নেই। গোটা দলের এগারো খেলোয়াড়ের মধ্যে শুধু একজন খেলোয়াড়কে কোচ গাসপেরিনি লাইসেন্স দিয়েছেন যেভাবে খুশি ঘুরে বেড়িয়ে আক্রমণ সাজানোর। বল পায়ে থাকলে দুর্দান্তভাবে আক্রমণ সাজান, না থাকলে নিজ দায়িত্বে যেদিকে বল আছে সেদিকে প্রেস করে বল কেড়ে নেন।

গোমেজ আর গোলরক্ষক ছাড়া দলের আরেকজন খেলোয়াড় ; মোট দুজন আতালান্তার মাঝখানটা সামলে রাখেন মূলত সব সময়। তিনি তিন সেন্টারব্যাকের মাঝে খেলেন। যে ভূমিকায় মূলত আর্জেন্টিনার হোসে লুইস পালোমিনোকে দেখা যায়। পালোমিনো না থাকলে ইতালির সেন্টারব্যাক মাত্তিয়া কালদারা এই ভূমিকা পালন করেন।

বাকিদের মূল উদ্দেশ্য থাকে মাঠের দুপাশ, অর্থাৎ উইংয়ের জায়গাগুলো দিয়ে আক্রমণ করা। আধুনিক ফুটবলে সবাই যেখানে ম্যাচ জয়ের মূল নিয়ামক হিসেবে মিডফিল্ডের লড়াইয়ে জয় পেতে চায়, সেখানে গাসপেরিনি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি চান, মাঝমাঠের চেয়ে উইং অঞ্চল দিয়েই আতালান্তা বেশি আক্রমণ গড়ে তুলুক। এই আক্রমণটাও আতালান্তা সাজায় সুকৌশলে। আধুনিক ফুটবলে ফুলব্যাকদের ওপরে উঠে আক্রমণে সাহায্য করা, সেন্টারব্যাকদের বল পায়ে স্বচ্ছন্দ হওয়া, প্রত্যেক খেলোয়াড় যেন মাঠে যেকোনো সময়ে পাস দেওয়ার জন্য ন্যূনতম দুজনকে আশপাশে পায়, সেটা নিশ্চিত করতে মাঠের মধ্যে ছোট ছোট খেলোয়াড়দের ত্রিভুজ সৃষ্টি করা—এগুলো নিয়মিত দেখা যায়। গাসপেরিনি এই কৌশলের উন্নতি ঘটিয়েছেন খেলোয়াড়দের ত্রিভুজের জায়গায় রম্বস গঠন করার মাধ্যমে। ত্রিভুজ গঠন না করে দুটি ত্রিভুজকে একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে কল্পিত রম্বস বানিয়ে আক্রমণ সাজান তিনি। মাঠে এমন রম্বস হয় দুটি। দুই রম্বস গঠনে দায়িত্ব নেয় মাঠের আট খেলোয়াড়, গোমেজ থাকেন ‘ফ্রি’ ভূমিকায়, ওদিকে মাঝের সেন্টারব্যাক আর গোলরক্ষক সহ মোট এগারোজন, এই তো! 

দুইদিকের দুই রম্বস গঠন। ছবি: সংগৃহীত
দুইদিকের দুই রম্বস গঠন। ছবি: সংগৃহীত

এবার আসা যাক রম্বস গঠনকারী আট খেলোয়াড়ের ব্যাপারে।

মাঠে দুটো রম্বস গঠন করা হয় আক্রমণের সময়, আগেই বলেছি—ডানদিকের রম্বস ও বামদিকের রম্বস। ডানদিকের রম্বস গঠনে দায়িত্ব নেন মাঠের ডানদিকের খেলোয়াড়গুলো। এদের মধ্যে রয়েছেন তিন সেন্টারব্যাকের ডান দিকেরজন—অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেখানে ব্রাজিলের সেন্টারব্যাক রাফায়েল তোলয় থাকেন। আছেন রাইট উইংব্যাক হান্স হাটেবোর। আছেন দুই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের ডান দিকেরজন ডাচ তারকা মার্টেন ডে রুন ও আক্রমণভাগের ডানদিকে থাকা তারকা জোসিপ ইলিচিচ।

এই চারজনের মধ্যে নিয়ত অবস্থানের পরিবর্তন হয়। বলের দখল আতালান্তার কাছে থাকলে রাইট উইংব্যাক হান্স হাটেবোর একদম আক্রমণভাগে চলে যান রাইট উইঙ্গার হিসেবে। রাইট উইংয়ে থাকা ইলিচিচ একটু নেমে এসে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে অবস্থান নেন, সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে থাকা মার্টেন ডে রুন নিচে নেমে গিয়ে ছদ্ম-সেন্টারব্যাকের ভূমিকা নেন, ওদিকে ডান সেন্টারব্যাকে থাকা রাফায়েল তোলয় ওপরে উঠে গিয়ে হয় রাইট উইংব্যাক হাটেবোরের ফেলে রাখা জায়গায় চলে যান, অথবা ওপরে উঠে ইলিচিচেরও সামনে চলে যান।

একই কাজ করেন বামদিকে থাকা চারজন— বামদিকের সেন্টারব্যাক বেরাত জিমসিতি, লেফট উইংব্যাক রবিন গসেনস, লেফট সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার রেমো ফ্রয়লার ও দুভান জাপাতা/আলেহান্দ্রো গোমেজ। নিয়মিত অবস্থানের পরিবর্তন ঘটিয়ে বল সামনে নিয়ে যান। স্বল্পতম সময়ের ব্যবধানে নিজেদের মধ্যে ছোট-ছোট কম্বিনেশনের মাধ্যমে আক্রমণ করে আতালান্তা।

বিজ্ঞ পাঠকের মনে এখন প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, তিনজন সেন্টারব্যাকের মধ্যে দুজনই (মাঝের সেন্টারব্যাক পালোমিনো/কালদারা ছাড়া) যদি সুযোগ বুঝে ওপরে ওঠেন, তাহলে রক্ষণভাগের নিরাপত্তা সব সময় নিশ্চিত থাকে কি করে?

এখানেই রয়েছে খেলোয়াড়দের ভূমিকার মধ্যে পার্থক্য। রম্বস গঠন করলেও দুই দিকের দুই সেন্টারব্যাকের মধ্যে ডানদিকের তোলয়ের তুলনায় বামদিকের জিমসিতি কম আক্রমণে ওঠেন। ওদিকে দুই মিডফিল্ডারের মধ্যে বামদিকের ফ্রয়লারের ওপরে উঠে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। আক্রমণভাগে সঠিক পাস পাঠানোর দিক দিয়েও ডানদিকের ডে রুনের চেয়ে বামদিকের ফ্রয়লার বেশি কার্যকরী। উইংব্যাক হিসেবে আবার বামদিকের রবিন গসেনসের চেয়ে ডানদিকের হান্স হাটেবোর রক্ষণকাজে অপেক্ষাকৃত বেশি পটু। গসেনস উইংব্যাক হলেও ছদ্ম-উইঙ্গারের ভূমিকা যেমন নিতে পারেন, অনেক সময় ভেতরের দিকে চলে এসে আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার গোমেজ-ইলিচিচ বা স্ট্রাইকার দুভান জাপাতার সঙ্গেও জুটি বেঁধে আক্রমণ করতে পারেন। ফুলব্যাক হিসেবে এ মৌসুমে যেখানে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে গসেনসের গোল দশটি, বাকি দুজন (হাটেবোর-কাস্তানিয়ে) করেছেন দুটি করে। বোঝাই যাচ্ছে, গসেনস কতটা আক্রমণাত্মক! ওদিকে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে মাঠের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখে রাখার কাজটা ডানদিকের উইংব্যাক হাটেবোরই ভালো পারেন। ফলে হিসেব করে দেখুন, দুই দিকের তিনজনের মধ্যে অন্তত একজন বা দুজন রক্ষণকাজটা ভালোই পারেন (বামদিকে জিমসিতি ও ডানদিকে ডে রুন-হাটেবোর)। ফলে রক্ষণভাগে সব সময় থাকা পালোমিনো হয় জিমসিতি, না হয় ডে রুন-হাটেবোরের মধ্যে একজন-দুজনকে কোনো না কোনোভাবে পেয়েই যান। 

আক্রমণভাগের দুই প্রধান অস্ত্র, ইলিচিচ ও গোমেজ। ছবি: আতালান্তা টুইটার
আক্রমণভাগের দুই প্রধান অস্ত্র, ইলিচিচ ও গোমেজ। ছবি: আতালান্তা টুইটার

তবে এটাও সত্যি কথা, এভাবে আক্রমণ ক্ষুরধার হলেও, রক্ষণে সমস্যা থেকেই যায়। গাসপেরিনির কোনোকালেই রক্ষণভাগ অটুট রাখার দিকে মনোযোগ ছিল না, এখনো নেই। ২০০৭-০৮ মৌসুমে গাসপেরিনির জেনোয়া দুর্দান্ত আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলেও মৌসুম শেষ করেছিল দেওয়া গোলের চেয়ে আটটা গোল বেশি খেয়ে। এবারও তাই। লিগে তৃতীয় হওয়া আতালান্তা শীর্ষ চার দলের মধ্যে গোল খেয়েছে সবচেয়ে বেশি (৪৮)। নবম স্থানে থাকা ফিওরেন্টিনাও তাদের সমান গোল হজম করেছে।

কিন্তু যাদের আক্রমণ এত ভালো, রক্ষণ একটু দুর্বল হলেও, সমস্যা কোথায়? লিগের ৩৮ ম্যাচে ৯৮ গোল করেছে তারা, এত বেশি আর কেউ করেনি গোল, চ্যাম্পিয়ন জুভেন্টাসও নয়। আক্রমণভাগের মূল তিন খেলোয়াড় গোমেজ, জাপাতা আর ইলিচিচ সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে গোল করেছেন চার ডজন, এমনকি আক্রমণভাগের বিকল্প খেলোয়াড় মুরিয়েল আর মালিনভস্কিও করেছেন ২৮ গোল! দুই উইংব্যাক হাটেবোর, গসেনস ও তাদের বিকল্প কাস্তানিয়ে মিলে গোল করেছেন ১৪টি।

আতালান্তার আক্রমণের আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক হল, আক্রমণের শেষে যিনি প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে এসে গোল করে যাবেন, তাঁকে আড়ালে রাখার জন্য আক্রমণভাগের অন্যান্য খেলোয়াড়েরা প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের বিভ্রান্ত করা ও জায়গা সৃষ্টি করার জন্য দৌড়াতে থাকেন। প্রতিপক্ষের ছন্নছাড়া অবস্থার সুযোগ নিয়ে বক্সে তখন অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা খেলোয়াড়টা এসে গোল করে যান।

বল যখন আতালান্তার পায়ে থাকে না, তখন তাদের ৩-৪-৩ ছক পরিবর্তিত হয়ে ৫-৪-১ হয়ে যায়। মাঠের নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলকে ফোকাস করে রক্ষণ না করে ‘ম্যান-মার্কিং’ বা একেকজন প্রতিপক্ষের পেছনে আতালান্তার একেকজন গিয়ে প্রেস করা শুরু দেন। দুই সহকারী স্ট্রাইকার প্রেস করেন প্রতিপক্ষের দুই ফুলব্যাককে, আতালান্তার দুই উইংব্যাক প্রেস করেন প্রতিপক্ষের দুই উইঙ্গারকে। এভাবে প্রেস করার ফলে অনেক সময় ছোট ছোট পাসে আক্রমণ গড়তে ব্যর্থ হওয়া প্রতিপক্ষ লম্বা পাসে খেলতে চায়, চায় মাঝখান দিয়ে খেলতে। আর সেখানেই হয় বিপত্তি। বলের দ্রুত দখল নিয়ে আতালান্তা তখন প্রতি আক্রমণে উঠে পড়ে, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গোলে রূপান্তরিত হয়। 

রক্ষণের সময়ে আতালান্তার ছক ৫-৪-১। ছবি: সংগৃহীত
রক্ষণের সময়ে আতালান্তার ছক ৫-৪-১। ছবি: সংগৃহীত

এবার আসা যাক গাসপেরিনির দলের স্ট্রাইকারের ব্যাপারে। গাসপেরিনি এমন একজন স্ট্রাইকার চান, যে দলের দুই সহকারী স্ট্রাইকার/উইঙ্গার (গোমেজ ও ইলিচিচ) এর ওপর থেকে চাপ কমাতে পারেন, তাদের কাছ থেকে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার টেনে নিতে পারেন, ওই দুজনের জন্য জায়গা সৃষ্টি করতে পারেন, প্রেস করতে পারেন, শক্তিশালী ও গতিশীল হওয়ার সুবাদে গায়ের জোর খাটিয়ে এক-দুজন ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করে গোল করতে পারেন। এই কাজের জন্য গত কয়েক মৌসুম ধরে আন্দ্রেয়া কর্নেলিয়াস, আন্দ্রেয়া পেতানিয়া, আলবার্তো পালোশচির মতো স্ট্রাইকারকে খেলালেও বিশেষ সুবিধা পাননি কোচ। এবার একই সঙ্গে দুজন স্ট্রাইকার পেয়ে গেছেন অমন—দুভান জাপাতা ও লুইস মুরিয়েল।

মূল একাদশে জাপাতাই খেলেন, বিকল্প হিসেবে মুরিয়েলও কম যান না। এই বৈশিষ্ট্যটা শুধু স্ট্রাইকার নয়, একাদশের অন্যান্য অধিকাংশ পজিশনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ফলে মূল একাদশ থেকে কাউকে বসিয়ে বেঞ্চ থেকে কাউকে খেলালেও আতালান্তার খেলার মানের তেমন ঘাটতি হয় না। ঘাটতি হয় তখনই, যখন দুই সহকারী স্ট্রাইকার গোমেজ-ইলিচিচ কিংবা লেফট উইংব্যাক রবিন গসেনস না খেলেন। প্রতিপক্ষ ভেদে গাসপেরিনি যদি দেখেন যে মিডফিল্ডে অতিরিক্ত একজন দরকার, কিংবা কোনো কারণে ইলিচিচ যদি না খেলেন, তাহলে দেখা যায় হয় মালিনভস্কি নয় পাসালিচ খেলছেন। দুজন অসাধারণ মিডফিল্ডার হলেও ইলিচিচের মতো রক্ষণভাগের জায়গা বের করে আনার ক্ষমতা বা ড্রিবলিং করার ক্ষমতা বাকি দুজনের নেই। ওদিকে লেফট উইংব্যাকের জায়গায় বেলজিয়ান টিমোথি কাস্তানিয়ে খেললে বামদিক থেকে আক্রমণের মাত্রাটা একটু কমে যায়, কারণ গসেনসের মতো কাস্তানিয়ে বাঁ পায়ের খেলোয়াড় না হওয়ায় তাঁর আক্রমণে উঠতে বেশ কষ্ট হয়। 

জাপাতা বা মুরিয়েল, যেই মূল স্ট্রাইকার থাকুন না কেন, আতালান্তার খেলার মানে পরিবর্তন আসে না। ছবি: আতালান্তা টুইটার
জাপাতা বা মুরিয়েল, যেই মূল স্ট্রাইকার থাকুন না কেন, আতালান্তার খেলার মানে পরিবর্তন আসে না। ছবি: আতালান্তা টুইটার

আজ পিএসজির বিপক্ষে ইলিচিচ খেলবেন না, মোটামুটি নিশ্চিত। পাসালিচ বা মালিনভস্কি যদি কোনোভাবে ইলিচিচের মতো জাদু দেখাতে পারেন, তাহলে নেইমারদের কপালে ভাঁজ বাড়বে বৈ কমবে না। দেখা যাক, দুর্দান্ত এই কৌশলের লড়াইয়ে আজ রাতে কে জেতে!