ক্রিকেটের সোনার ডিম পাড়া হাঁস

এমনই অদ্ভুত বেশভূষা নিয়েই মাঠে নেমেছিল নিউজিল্যান্ড
এমনই অদ্ভুত বেশভূষা নিয়েই মাঠে নেমেছিল নিউজিল্যান্ড

গল্পটা সত্যি না মিথ্যা, কে জানে।
জার্মানিতে তখন ক্ষমতায় প্রবল প্রতাপশালী এডলফ হিটলার। শখ করে হিটলার একবার ক্রিকেট খেলা দেখতে গেলেন। খেলা চলছে তো চলছেই। দুই দিন গেল, তিন দিন গেল, চার দিন, খেলা আর শেষ হয় না। অধৈর্য হয়ে হিটলার জানতে চাইলেন, ‘এই খেলা কবে শেষ হবে?’ তাঁকে জানানো হলো, ‘খেলা আরও চলবে?’ ক্ষিপ্ত হিটলার বললেন, ‘এই একটা খেলা শেষ হতে যত সময় লাগছে, সেই সময়ে তো আমি তিনটা দেশ জয় করে ফেলতে পারতাম।’ এর পরই নাকি জার্মানিতে নিষিদ্ধ করা হয় ক্রিকেট।

ক্রিকেট নিয়ে মার্কিনদের দৃষ্টিভঙ্গিরও একটা গল্প আছে। মার্কিনরা ক্রিকেট নিয়ে অবাক হয়ে ভাবে, ‘এটা এমন একটা খেলা, যেটা পাঁচ দিন ধরে চলার পরও নাকি ফলাফল হয় না। ম্যাচ হয়ে যায় ড্র!’
ক্রিকেটে একসময় শুধু টেস্ট ম্যাচই ছিল। শুধু তা-ই নয়, ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত টেস্ট হতো ‘টাইমলেস’। অর্থাত্ তাতে সময় বা দিনের কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না, এখন যেমন টেস্ট হয় পাঁচ দিনের। ১৯৩৯ সালের শেষ টাইমলেস টেস্টটাও খেলা হয়েছিল দ-শ দিন! হিটলার বিরক্ত তো হবেনই।

১৮৭৭ সালে শুরু হয়েছিল টেস্ট ক্রিকেট। প্রায় এক শ বছর পরে এসে ১৯৭১ সালে শুরু হয় ৫০ ওভারের ওয়ানডে ক্রিকেট। তারও ৩২ বছর পর যাত্রা শুরু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের। ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম আন্তর্জাতিক সংস্করণ চালুর পেছনের কারণটায় ভূমিকা রেখেছিল ক্রিকেট সম্পর্কে ওই ‘হিটলারীয় দৃষ্টিভঙ্গি’ই।

২০০২ সালে শেষ হয় ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ওয়ানডে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ। এই টুর্নামেন্টের জায়গায় ইংলিশ অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) এমন একটা টুর্নামেন্ট খুঁজছিল, যেটা আর্থিকভাবে হবে লাভজনক। যে টুর্নামেন্টে মাঠে আসবে প্রচুর দর্শক। খেলাটা হবে বিনোদনে ভরপুর। কারণ সে সময় মাঠে এবং টিভিতে—দুই জায়গাতেই ক্রিকেট দর্শকের সংখ্যা কমে যাচ্ছিল আশঙ্কাজনকভাবে। আর ক্রিকেটের বাণিজ্যলক্ষ্মী এর দর্শকেরাই।

২০০১ সাল থেকেই নতুন কিছু করার চিন্তাভাবনা শুরু করে ইসিবি। সে সময় ইসিবির বিপণন ব্যবস্থাপক ছিলেন স্টুয়ার্ট রবার্টসন। দুই লাখ পাউন্ড খরচ করে রবার্টসন আর তাঁর দল একটা গবেষণা চালাল—ক্রিকেট মাঠে কোন দর্শকেরা আসে, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কারা আসে না, কেন আসে না।

উত্তর মিলে গেল। আধুনিক ব্যস্ত সময়ে লম্বা দৈর্ঘ্যের খেলা ক্রিকেট এখন আর দর্শকদের সেভাবে টানছে না। ইংল্যান্ডে টেস্টের তবুও কিছু সুনির্দিষ্ট অনুরাগী দর্শক আছেন। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম খেলাটার ওপর থেকে আগ্রহ হারাচ্ছে। ৫০ ওভারের ওয়ানডেও হতে সময় লেগে যায় সাত থেকে আট ঘণ্টা। যেখানে একটা ফুটবল ম্যাচে এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিনোদন পাওয়া সম্ভব মাত্র ৯০ মিনিটে।

তাহলে সমাধান? এসে গেল ২০ ওভারের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। রবার্টসনরা স্লোগানও ঠিক করে ফেললেন, ‘এই ক্রিকেট দৈর্ঘ্যে অর্ধেক, কিন্তু বিনোদনের দিক দিয়ে দ্বিগুণ’। কারণ এই ক্রিকেট মারকাটারি খেলা। ধরো তক্তা মারো পেরেক। ক্রিকেটের কুলীন রোমান্টিক শুদ্ধতাবাদীরা হইহই করে উঠলেন। বলে কী, ক্রিকেট কি শুধু চার-ছক্কার খেলা? শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা তো ২০ ওভারের এ খেলাটিকে বললেন দুই মিনিটের ম্যাগি নুডলস। তাতে পেট ভরলেও মন কি ভরে?

কিন্তু না, সংশয়বাদীদের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে দিয়ে যাত্রা শুরু করল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। ২০০৩ সালের ১৩ জুন ইংল্যান্ডের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট টি-টোয়েন্টি কাপের প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হলো হ্যাম্পশায়ার ও সাসেক্স। মজার ব্যাপার হলো, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট চালু হবে কি না—ইসিবির বোর্ড পরিচালকদের এমন ভোটাভুটিতে সাসেক্স কিন্তু ভোট দিয়েছিল বিপক্ষেই!

মাত্র ১০ বছর হয়েছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বয়স। কিন্তু হু হু করে বেড়েছে এর জনপ্রিয়তা। এরই মধ্যে কতটাই ঘটন-অঘটনের জন্ম দিয়ে বসে আছে। ২০০৭ সালে চালু হলো ভারতের বিদ্রোহী ক্রিকেট লিগ আইসিএল। ২০০৮ সালে এক টি-টোয়েন্টি ম্যাচেই দুই কোটি ডলারের প্রাইজমানির ঘোষণা দিয়ে চমকে দিলেন মার্কিন ধনকুবের অ্যালেন স্ট্যানফোর্ড।

২০০৮ সালেই চালু হলো ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)। আইসিএলের ধারণাই এক রকম চুরি করে ললিত মোদি নামের এক ধুরন্ধর ব্যবসায়ীর হাত ধরে চালু হলো এখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। যে টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো ক্রিকেটারদের নিলামে তোলার অভূতপূর্ব এক চল শুরু হলো। সেই নিলামে কোটি কোটি টাকায় বিক্রিও হলেন ক্রিকেটাররা।

টাকার অভাবে যে ক্রিকেট ধুঁকতে শুরু করেছিল, সেই ক্রিকেটে লগ্নি করতে শুরু করলেন ধনকুবেররা। দ্রুতই টি-টোয়েন্টি প্রমাণ হয়ে গেল সোনার ডিম পাড়া হাঁসে। টি-টোয়েন্টির সূত্র ধরেই ক্রিকেটে ঢুকে পড়ল চিয়ারলিডারদের নর্তন-কুর্দন। ‘জেন্টলম্যান গেম’ ক্রিকেট হয়ে উঠল গ্ল্যামারে ভরপুর। ক্রিকেটে আরও ভালো করে জেঁকে বসল জুয়াড়িরাও! বাজিকরেরা আবারও মেলে ধরল থাবা। স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারির আগুনে পুড়ল বাংলাদেশের বিপিএল, গত বছর তোলপাড় হলো ভারতের আইপিএল নিয়েও।

সেই ধাক্কা সামলে নিয়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আসলে এগিয়ে চলেছে। এখনো খেলাটি মূলত ঘরোয়া ক্রিকেট-ভিত্তিক হলেও আন্তর্জাতিকভাবেও টি-টোয়েন্টি বেশ সফল। আইসিসির ধরাবাঁধা নিয়মের কারণে অবশ্য খুব বেশি করে ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় না জাতীয় দলগুলো। ২০০৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে মুখোমুখি হলো নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া। প্রথম ম্যাচেই ৯৮ রান করে ফেলেছিলেন রিকি পন্টিং।

ম্যাচটিতে নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা নব্বই দশকের বেশভূষা পরে নেমেছিলেন মাঠে। একেকজনের চুলের স্টাইলও ছিল অদ্ভুত। টি-টোয়েন্টি তখন এমন ‘ফান ক্রিকেট’ই ছিল। কিন্তু দ্রুতই সেটা ফান থেকে হয়ে যায় সিরিয়াস ক্রিকেট। ২০০৭ সালে শুরু হয়ে গেল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।

প্রথম আসরেই উত্তেজনাপূর্ণ ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে শিরোপা জিতল ভারত। দুই বছরের মাথায় আরেকটি বিশ্বকাপ। এবার শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলো পাকিস্তান। কিন্তু চ্যাম্পিয়নের মুকুট এক বছরের বেশি থাকল না তাদের মাথায়। ২০১০ বিশ্বকাপে ক্রিকেটের ‘আবিষ্কর্তা’ ইংল্যান্ড প্রথমবারের মতো পেল কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফির স্বাদ। ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ক্যারিবীয় পতাকা ওড়াল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ফাইনাল জেতার পর ক্রিস গেইলদের সেই গ্যাংনাম নাচ নিশ্চয়ই এখনো মনে আছে সবার। এবার বাংলাদেশে নাচবে কে?