বিতর্কে ঠাসা এক বিশ্বকাপ, আর্জেন্টিনার প্রথম শিরোপা

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক ড্যানিয়েল প্যাসারেলা
বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক ড্যানিয়েল প্যাসারেলা

১৬ বছর পর বিশ্বকাপ আবারও ফিরল লাতিন আমেরিকায়। তবে ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপকে প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই ঘিরে রইল বিতর্ক, সন্দেহ আর অঘটন। সামরিক শাসনে সন্ত্রস্ত আর্জেন্টিনার কাঁধে বিশ্বকাপ আয়োজনের ভার তুলে দেওয়ায় ফিফাকেও কম সমালোচনা সহ্য করতে হয়নি সেবার। মানবাধিকার আর আইনের শাসনের অনুপস্থিতি আর্জেন্টিনার সেই বিশ্বকাপকে পরিচিতি দিয়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত আয়োজন হিসেবে।

আর্জেন্টিনার রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে পৃথিবীর অনেক দেশই সেবার বিশ্বকাপ বয়কটের চিন্তাভাবনা শুরু করেছিল। কিন্তু সামরিক জান্তার তরফ থেকে পরিচালিত সার্থক কূটনৈতিক তত্পরতা অবশ্য দেশগুলোকে সেই ভাবনা থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছিল।

বিশ্বকাপ বয়কটের ভাবনাটা উঠেছিল আগেরবারের রানার্সআপ হল্যান্ডের মাধ্যমে। যদিও হল্যান্ড শেষ অবধি বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল। তবে সেবার হল্যান্ড জাতীয় দলের কমলা রঙের জার্সি গায়ে বিশ্বকাপ মাতাতে আর্জেন্টিনায় যাননি কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ। বিশ্বকাপের আগে তাঁর ওপর সংঘটিত একটি ব্যর্থ অপহরণ প্রচেষ্টার পর স্ত্রীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্রুইফ আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপ খেলতে যাননি। তিনি স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন কোনো অবস্থাতেই তিনি দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশে যাবেন না। আর্জেন্টিনার মতো দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশেই তখন সামরিক শাসন চলছে আর খুন-গুম সেই দেশগুলোয় সে সময় নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা।

আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানি দলে সেবার ছিলেন না ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। ক্রুইফ-বেকেনবাওয়ারবিহীন বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাই ছিল পরিষ্কার ফেবারিট। সিজার লুই মেনোত্তির তত্ত্বাবধানে আর্জেন্টিনার সেই দলে ছিলেন মারিও কেম্পেসের মতো স্ট্রাইকার। কেম্পেসের গোল করার ক্ষমতা তখন বিশ্ব-স্বীকৃত।

ড্যানিয়েল প্যাসারেলার অধিনায়কত্বে আর্জেন্টিনার ওই দলটিতে কেম্পেস ছাড়াও ছিলেন মিডফিল্ডার ওসভালদো আরদিলেস, স্ট্রাইকার লিওপোলদো লুকে এবং গোলরক্ষক উবালদো ফিলোল। এঁরা সবাই ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল এবং সেই সময়ের সেরা তারকা। এত তারকার ভিড়ে মেনোত্তি সেবার ‘বয়স কম’ অজুহাতে দলে নেননি আর্জেন্টািইন ফুটবলের তখনকার ‘উঠতি’ সেনসেশন ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে।

আটাত্তরের ফরম্যাট ছিল চুয়াত্তরের মতোই। প্রথমে ১৬টি দলকে চারটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছিল। এরপর পয়েন্ট ও গোল গড়ের ভিত্তিতে প্রতিটি গ্রুপ থেকে দুটি করে দল পরের রাউন্ডের জন্য যোগ্যতা অর্জন করে। দ্বিতীয় রাউন্ডের আটটি দলকে ভাগ করে দেওয়া হয় দুই গ্রুপ। শিরোপার লড়াইয়ে মুখোমুখি হয় দুই গ্রুপের শীর্ষ দুই দল।

 পুরো বিশ্বকাপেই আর্জেন্টিনা দলের ওপর ছিল দেশটির সামরিক জান্তার প্রভাব। আর্জেন্টিনার সাফল্যকে সেবার নিজেদের সাফল্য হিসেবে প্রচারণ করার জন্য মরিয়া ছিল সামরিক সরকার। এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ফাইনালে ওঠা নিয়ে আছে বিস্তর বিতর্ক। দ্বিতীয় রাউন্ডে নিজেদের গ্রুপ পোল্যান্ডের বিপক্ষে ২-০ গোলে জিতলেও ব্রাজিলের সঙ্গে তারা ম্যাচ শেষ করে গোলশূন্যভাবে। ফাইনালে যেতে হলে পেরুকে তাদের হারাতে হতো ৪ গোলের ব্যবধানে। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা পেরুকে চার গোলে হারানোর স্বপ্ন বোধ হয় কখনোই দেখেননি কেম্পেস, প্যাসারেলারা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই পেরুই আর্জেন্টিনার কাছে হেরে যায় ৬-০ গোলে। বিশ্বকাপই শুধু নয়, ফুটবলের ইতিহাসেই এটি এক অমীমাংসিত ‘রহস্য’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এ ব্যাপারে এখনো অনেক কিছুই সন্দেহ করা হয়, যার কোনোটিই আসলে কখনোই প্রমাণ করা যায়নি।

অপর গ্রুপ থেকে ফাইনালে ওঠে হল্যান্ড। ইতালি, পশ্চিম জার্মানি ও অস্ট্রিয়াকে টপকে। ইতালির বিপক্ষে আত্মঘাতী গোলে প্রথমে পিছিয়ে পড়লেও দুর্দান্ত খেলেই ম্যাচটি ২-১ গোলে জিতে নেয় হল্যান্ড। পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে তাদের খেলাটি শেষ হয় অমীমাংসায়। অস্ট্রিয়াকে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি ডাচদের।

ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে বুয়েনস এইরেসের প্রতিকূল পরিবেশে মাঠে নামে হল্যান্ড। লক্ষ্য ছিল চুয়াত্তরের অতৃপ্তিকে ঢেকে দেওয়া। সে লক্ষ্যে ফাইনালে হল্যান্ডের শুরুটাও ছিল দারুণ। প্রথমে এক গোলে তারা এগিয়েও গিয়েছিল। কিন্তু ঝাঁকড়া চুলের মারিও কেম্পেস তাঁর গোল করার ক্ষমতার অপূর্ব প্রদর্শন ঘটিয়ে ডাচদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন ম্যাচ। আর্জেন্টিনা জয়ী হয় ৩-১ গোলে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব আনন্দে উদ্বেল করে সামরিক শাসন-কবলিত আর্জেন্টিনাকে।

এই বিশ্বকাপেই প্রথমবারের মতো ‘অফিসিয়াল বল’ ব্যবহূত হয়। বিশ্বখ্যাত ক্রীড়া সামগ্রী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাসের প্রস্তুতকৃত ‘ট্যাংগো’ বল বিপ্লব সৃষ্টি করে দুনিয়ায়। আটাত্তরের ব্যবহূত ট্যাংগো এখনো ফুটবল ইতিহাসে ব্যবহূত অন্যতম সেরা বল হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বকাপের পরেও এর পরের দুই দশক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ম্যাচে ব্যবহূত হয় অ্যাডিডাসের এই ট্যাংগো বল।