ব্রাজিল বাঁচল, বাঁচল বিশ্বকাপও

টাইব্রেকারে দু–দুটি সেভ। কাল মিনেইরো স্টেডিয়ামে শুধু ব্রাজিলকেই বাঁচাননি জুলিও সিজার (বাঁয়ে), রং হারানো থেকে বিশ্বকাপকেও বাঁচিয়েছেন। ব্রাজিলকে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠানোর নায়ককে অভিনন্দন জানাতে সতীর্থরা ছুটে এলেন লাইন ধরেই l এএফপি
টাইব্রেকারে দু–দুটি সেভ। কাল মিনেইরো স্টেডিয়ামে শুধু ব্রাজিলকেই বাঁচাননি জুলিও সিজার (বাঁয়ে), রং হারানো থেকে বিশ্বকাপকেও বাঁচিয়েছেন। ব্রাজিলকে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠানোর নায়ককে অভিনন্দন জানাতে সতীর্থরা ছুটে এলেন লাইন ধরেই l এএফপি

টাইব্রেকার শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। তখনো মাঠের মাঝখানে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে নেইমার ও ডেভিড সিলভা। সিলভার বাঁ হাতের একটি আঙুল উঁচিয়ে রাখা। কী বোঝাচ্ছিলেন তিনি—একটি ফাঁড়া গেল?
নিষ্ঠুর-ক্ষমাহীন বিশ্বকাপের নকআউট পর্ব উত্তেজনা-রোমাঞ্চ-স্নায়ুর ওপর অত্যাচার—সবই। প্রথম ম্যাচেই যে তা সবকিছু নিয়ে এমন ঝাঁপিয়ে পড়বে, কে জানত! যেকোনো ম্যাচই টাইব্রেকারে গড়ালে মাঠের বাতাসে আগুনের ফুলকি খেলা করে। কাল মিনেইরো স্টেডিয়াম ছাড়িয়ে তা পুরো বিশ্বকাপেই ব্যাপ্ত। এই টাইব্রেকার যে আর দশটা টাইব্রেকারের মতো নয়। এখানে সুতোর ওপর ঝুলছিল এই বিশ্বকাপের রং বদলে যাওয়া। স্বাগতিক ব্রাজিলের বিশ্বকাপ দ্বিতীয় রাউন্ডেই শেষ হয়ে গেলে এই বিশ্বকাপ কি আর আগের মতো থাকত নাকি!
এই ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে বছর খানেক ধরে অসহনীয় চাপের কথা বলতে গিয়ে প্রায় কেঁদে ফেলেছিলেন থিয়াগো সিলভা। কাল ১২০ মিনিটে ১-১ ম্যাচে টাইব্রেকারে জেতার পরও ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়েরা কাঁদলেন। গঞ্জালো হারার শটটি পোস্টে লাগতেই মাঠে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন ব্রাজিলের অনেক খেলোয়াড়। সুউচ্চ মিডিয়া ট্রিবিউনে বসেও কান্নায় শরীরের কেঁপে ওঠাটা বোঝা যাচ্ছিল পরিষ্কার।
ব্রাজিলিয়ানরা কেউ কাঁদছেন। কেউ হাসছেন। চিলির জন্য থাকল শুধুই কান্না। সেটি মাঠ ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল গ্যালারিতেও। ম্যাচ শেষে গ্যালারির ব্রাজিলিয়ান অংশটা খুব দ্রুতই খালি হয়ে গেল। হলুদ সরষেখেতের জায়গায় জায়গায় লাল ছোপ বানিয়ে রাখা চিলিয়ানরা তখনো বিমূঢ় বসে। টেলিভিশনে ক্লোজআপে দেখা গেল, অনেকেই কাঁদছেন।
চিলির ব্রাজিলিয়ান-দুঃখটা অনেক পুরোনো। বড় টুর্নামেন্টের নকআউট পর্বে সব সময় ব্রাজিলই তাদের নকআউট করেছে। এবার চিলি এসেছিল বদলের গান গাইতে গাইতে। তা ইতিহাস তো প্রায় বদলে দিয়েছিলই তারা। নির্ধারিত সময়ের মতো অতিরিক্ত সময়েও সমানে-সমান তো বটেই, কখনো কখনো চিলিকেই বরং বেশি ধারালো মনে হলো। স্কলারি তো আর এমনিতেই চিলিকে নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলেন না।
অতিরিক্ত সময়ের শেষ দিকে পিনিলার শটটি বারে না লাগলে তো মারাকানাজোর পাশে একটা ‘মিনেইরোজো’-ও লেখা হয়ে যায় ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসে। উৎসবমুখর ব্রাজিলের চেহারাটা বদলে গিয়ে তখন কেমন হতো অনুমান করার চেষ্টা করছি। ব্রাজিলের ম্যাচের দিন পুরো দেশটা যেন বদলে যায়, সেটিই তো আর হতো না।
বিশ্বকাপ শুরুর আগে আন্দোলন-বিক্ষোভ কত কিছুতে টালমাটাল ব্রাজিল। খেলা শুরু হতে না-হতেই ভোজবাজির

মতো সব উধাও। ‘কোপা দেল মুন্দো’ পুরো জাতিকে যেন বিভোর করে রেখেছে। সকালে হোটেলের নাশতার টেবিলে শুধুই হলুদ জার্সি। রাস্তায়ও তা-ই। কাল মাঠে আসার সময় নতুন একটা ব্যাপার চোখে পড়ল, রাস্তার মোড়ে মোড়ে হলুদ জার্সি গায়ে মাসকট। হেলছে, দুলছে, নানা অঙ্গভঙ্গি করছে। ভেতরে তো মানুষ। স্থানীয় বারে বড় পর্দায় খেলা দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে লেখা হয়েছে, ব্রাজিলের প্রতিটি গোলের জন্য একটি বিয়ার ফ্রি। নিচে হেক্সা যে আসছেই, সেই ঘোষণা।
সব আয়োজনই মিথ্যা হয়ে যেতে যেতে আবার যেভাবে পুনর্জীবন পেল, তাতে ব্রাজিলিয়ানদের কারও হার্ট অ্যাটাকের খবর আসাটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু মনে হচ্ছে না। এর আগে ব্রাজিলের তিনটি ম্যাচেই গ্যালারিতে ব্রাজিলের একাধিপত্য। কাল সংখ্যায় কম হলেও চিলিও ভালোমতোই থাকল। ম্যাচের আগুনে মেজাজটা ফুটবলে উঠছিল শুরুর আগেই। চিলির জাতীয় সংগীতের সময়ই ‘বুওওওওওও’ আওয়াজে কানে তালা লাগার উপক্রম। ম্যাচেও পাল্টাপাল্টি চলল। তবে যতই সময় গড়াল, ম্রিয়মাণ হতে থাকল ব্রাজিলের চিৎকার। অতিরিক্ত সময়ের খেলা শুরুর আগে তো চিলিয়ানদের গর্জন ছাড়া আর কিছু শোনাই গেল না। ব্রাজিলিয়ানরা যে তখন বিস্ময়ে-আশঙ্কায় বিমূঢ়। দ্বিতীয় রাউন্ডেই স্নায়ুর ওপর এই অত্যাচার।
ক্যামেরুনের বিপক্ষে ম্যাচেই ব্রাজিলের ডিফেন্সের ফাঁকফোকর চোখে পড়ছিল। স্কলারি অবশ্য এ নিয়ে প্রশ্ন শুনে উল্টো প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ডিফেন্সকে। অথচ কালও ব্রাজিল গোলটি খেল ডিফেন্সের ছেলেমানুিষ ভুলে। নিজেদের থ্রো ইন থেকে কেউ এভাবে প্রতিপক্ষের পায়ে বল সাজিয়ে দেয়! সেটিও আবার আলেক্সিস সানচেজের পায়ে।
কী খেলাটাই না খেললেন এই উইঙ্গার! মাঠে নামার আগে টানেলে ব্রাজিল দলে তাঁর দুই বার্সা সতীর্থ নেইমার ও দানি আলভেজকে জড়িয়ে ধরেছেন। গল্পগুজবও করেছেন কিছুক্ষণ। খেলা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য নেইমার বনাম সানচেজ। এই দ্বৈরথে কাল বোধ হয় সানচেজই জয়ী। শুধু চিলির সমতাসূচক গোলটিই করেননি, পুরো মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। নেইমার যেখানে আগের তিন ম্যাচের তুলনায় অনেকটাই ম্লান।
বুট বদলিয়েও যাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। নেমেছিলেন শুধু তাঁর জন্যই নাইকির বানানো শখের সোনালি বুট পরে। বিরতির পর ফিরে গেলেন লাল বুটে। অতিরিক্ত সময়ে গোলের ভালো একটা সুযোগ পেয়েও পারলেন না। এই ম্যাচের আগে রেফারিং নিয়ে চিলির শঙ্কায় তুমুল বিতর্কের জন্ম হয়েছে। ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশন ব্যতিক্রমী রকম ঝাঁজালো প্রতিক্রিয়া জানিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছে, ব্রাজিলের এক শ বছরের জয়ের ইতিহাস, ব্রাজিলের জিততে রেফারি লাগে না ইত্যাদি। ম্যাচে অবশ্য রেফারিং নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়ে থাকলে সেটি চিলির পক্ষেই গেল। গোল করে হাল্ক হলুদ কার্ড দেখেছেন হ্যান্ডবল করায়। হয়তো হ্যান্ডবলই হয়েছে, কিন্তু এ নিয়ে তর্ক চলবেই। হ্যান্ডবল হলেও সেটি ইচ্ছাকৃত নয় বলে হলুদ কার্ড নিয়ে তো অবশ্যই।
ব্রাজিলের গোলটি যে ডেভিড লুইজকে দেওয়া হলো, সেটি নিয়েও তো বিতর্ক। ফিফার টেকনিক্যাল কমিটি না সিদ্ধান্ত বদলে সেটি গনজালো হারাকে দিয়ে দেয়। লুইজের ছোঁয়া লেগেছে কি লাগেনি, বল তো জালে গেল হারার বাড়ানো পায়ে লেগেই। সেই হারার পায়েই শেষ হলো ম্যাচ!
চিলির মন খারাপ হওয়ারই কথা। কিন্তু বিশ্বকাপ তো বাঁচল!