'বিদ্যুৎ চাচা'র ফুটবল পাঠশালা

সাতসকালেই শিষ্যদের নিয়ে অনুশীলনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মোসলেহ উদ্দিন। নারায়ণগঞ্জ জিমখানা মাঠ থেকে সম্প্রতি তোলা ছবি l পাপ্পু ভট্টাচার্য্য
সাতসকালেই শিষ্যদের নিয়ে অনুশীলনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মোসলেহ উদ্দিন। নারায়ণগঞ্জ জিমখানা মাঠ থেকে সম্প্রতি তোলা ছবি l পাপ্পু ভট্টাচার্য্য

বাবা শখ করে নাম রেখেছিলেন মোসলেহ উদ্দিন খন্দকার। কিন্তু সময়ের স্রোতে নামটা হারিয়েই গেছে। নারায়ণগঞ্জ শহরের সবার কাছে তাঁর একটাই পরিচয়, ‘বিদ্যুৎ চাচা’। বয়স ষাট পেরিয়েছে। মুখে খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি। এই বয়সেও কাকডাকা ভোরে উঠে একগাদা ফুটবলার নিয়ে শুরু করে দেন অনুশীলন।
নয় বছর ধরে নারায়ণগঞ্জে ফুটবল লিগ নেই। এমন খরায়ও নিয়মিত ফুটবলার তৈরি করে চলেছেন মোসলেহ উদ্দিন। শিষ্যদের কেউ না কেউ সব সময়ই খেলছে জাতীয় দলে। সদ্য শেষ হওয়া মহিলা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে পাকিস্তানে খেলে এসেছেন তাঁরই হাতে গড়া আয়েশা, সুরভি, বিথি। আয়েশা গত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে ছিলেন বাংলাদেশ দলের গোলকিপার। নিজের মেয়ে মাকসুদাও খেলেছেন জাতীয় দলে।
ওয়ালী ফয়সাল, আবদুল্লাহ পারভেজ, আজমল হোসেন (বিদ্যুৎ), মন্টু সাহা, খোকন দাসদের গুরু তিনি। সর্বশেষ বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজের জাতীয় দলে খেলা ইউসুফ সিফাতও ‘বিদ্যুৎ চাচা’র আবিষ্কার।
নিজে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে যায় মাত্র ১১ বছর বয়সে। আন্তস্কুলে খেলতে গিয়ে পায়ে চোট পান। একই বছরে মাকে হারান। পুলিশ কর্মকর্তা বাবা বাইজুদ্দিন চাকরির ব্যস্ততায় ছেলেকে সময় দিতে পারেননি। তাই তো আর ফুটবলারই হওয়া হলো না মোসলেহ উদ্দিনের।

.
.


কিন্তু সেই আক্ষেপ ঘোচানোর জন্য বেছে নিলেন ফুটবলার তৈরির কাজ। কোচিংয়ের ফিফা লাইসেন্স করেননি। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী মোসলেহ উদ্দিনের হাত ধরে উঠে এসেছে অনেক ফুটবলার।
শহরের চারদিকে ছড়ানো মাদকের নীল থাবা। কিশোর-যুবকেরা পা বাড়াচ্ছে অন্ধকারে। মোসলেহ উদ্দিনের বিশ্বাস, শুধু খেলাধুলাই পারে এসব থেকে তাদের দূরে রাখতে। তাই তো নিজের ফুটবল ক্লাবকে কোচিং সেন্টারে রূপ দেন। বঙ্গবীর সংসদ কোচিং সেন্টার নামে জিমখানা মাঠে নিয়মিত অনুশীলন করান ছেলেমেয়েদের। কিন্তু তিল তিল করে গড়ে তোলা ক্লাবটিও অন্যরা দখলে নিতে বসেছে। স্থানীয় ছিঁচকে সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে রাঘববোয়ালদের নজর মাঠটির দিকে।
এত প্রতিবন্ধকতা, তার পরও প্রিয় ছাত্রদের ভালোবাসাই তাঁর পথচলার অনুপ্রেরণা। এই তো গত মাসের ঘটনা। জাতীয় দলের খেলা শেষ করেই ওস্তাদের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন ইউসুফ সিফাত। হাতে তিনটি দেশি মুরগি। এতটুকু ভালোবাসায় আবেগি হয়ে পড়েছিলেন মোসলেহ উদ্দিন, ‘ছোট থেকে ও আমার কাছে ফুটবল শিখছে। ও জানে দেশি মুরগি খেতে ভালোবাসি। তাই মুরগি কিনে এনেছে। দেখে চোখে পানি এসে গেল।’
মোসলেহ উদ্দিনের ফুটবল পাঠশালায় কোনো ভর্তি ফি নেই। মাসিক চাঁদাও নেই। তাহলে কীভাবে চলে? মোসলেহ উদ্দিনই ভেঙে বললেন সেই রহস্য, ‘আমার ফুটবলারদের অনেকে লন্ডনে, সিঙ্গাপুরে, ফ্রান্সে থাকে। ওদের অনেকে স্পন্সর করে। আবার স্থানীয় যারা জাতীয় দলে ও বড় ক্লাবে খেলে, ওরাও সাহযোগিতা করে।’ অথচ একটা সময় কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। দুঃখের সঙ্গে বলছিলেন, ‘বাচ্চার দুধ কেনার টাকা দিয়ে বল কিনে ছেলেদের অনুশীলন করিয়েছি।’
নারায়ণগঞ্জ একসময় দুই হাত ভরে ফুটবলার উপহার দিয়েছে। আশরাফউদ্দিন চুন্নু, সম্রাট হোসেন এমিলি, প্রয়াত মোনেম মুন্না, মোহাম্মদ সালাউদ্দিন থেকে শুরু করে মোহাম্মদ সুজন, ওয়ালী ফয়সাল, মিঠুন চৌধুরীদের উঠে আসা নারায়ণগঞ্জ থেকেই। এঁদেরই পথ ধরে জাতীয় দলে খেলতে চায় মোসলেহ উদ্দিনের এই সময়ের নবীন শিষ্যরা। তাই তো কাকডাকা ভোরে অন্যদের ঘুম ভাঙার আগেই ওরা চলে আসেন মাঠে। শুরু হয় তাঁর ফুটবলার তৈরির নীরব সাধনা।