সেরাদের সেরা হয়ে ফিরুক মুশফিক

আবদুর রাজ্জাক
আবদুর রাজ্জাক

তিনি দলে নেই, তবে দলের সঙ্গেই আছেন। যে দলের অপরিহার্য অংশ হয়ে ছিলেন এত দিন, সেই সম্পর্ক তো এখনই শেষ হওয়ার নয়! জাতীয় দল আর ঘরোয়া ক্রিকেট মিলিয়ে বিশ্বকাপ দলের সবাইকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলের ১৫ ক্রিকেটারকে নিয়ে আবদুর রাজ্জাকের ধারাবাহিক লেখা
বয়সে মুশফিক আমার চেয়ে বেশ ছোট। তবে দুজনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শুরু কাছাকাছি সময়েই। আমার দুই বছর পর ওর ওয়ানডে অভিষেক। তবে ওর টেস্ট অভিষেক আবার আমার বছর খানেক আগেই। আমাদের শুরু ও এগিয়ে চলা তাই বলা যায় প্রায় একসঙ্গেই। ছোটখাটো একটা ছেলে, ‘বেবি ফেস’ ছিল। হাসলেও মনে হতো একটা পিচ্চি। ছোটখাটো গড়নের। কিন্তু ক্রিকেটার হিসেবে বিশাল। আমি বলব এ মুহূর্তে দেশের এক নম্বর ব্যাটসম্যান। আর দলের সেরা ব্যাটসম্যান যদি হয় কিপার, দলের জন্য সে অমূল্য সম্পদ।

শুরুর দিকে জায়গা পাকা করতে বেশ লড়তে হয়েছে ওকে। পাইলট (খালেদ মাসুদ) ভাই তখনো খেলছিলেন। ২০০৭ বিশ্বকাপ দিয়েই সম্ভবত পাকাপাকিভাবে জায়গাটা নিজের করে নিল। ওই বিশ্বকাপের দলে ওকে রাখা নিয়েও তখন অনেক আলোচনা হয়েছিল। এটাই ওকে আরও জেদি করে তুলেছিল ভালো করতে। পাইলট ভাইয়ের চেয়ে ভালো বা যোগ্য কি না, এসব নয়। ওর ভাবনা ছিল নিজেকে প্রমাণ করার। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচেই তো দারুণ পরিণত এক ইনিংস খেলে দলকে জেতাল ভারতের বিপক্ষে। এরপর আর জায়গা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি।
এই দুটি ব্যাপার ওর মধ্যে আগে থেকেই ছিল—জেদ ও পরিণতিবোধ। ১৬ বছর বয়সে লর্ডসে টেস্ট অভিষেক হলো, সেটার পেছনে বড় কারণ ছিল ব্যাটিং টেকনিক ও পরিণতিবোধ। আর অসম্ভব জেদি ছেলে, চরিত্রের এই দিকটিকে কাজে লাগায় ইতিবাচকভাবে। কোনো কিছু করবে বলে ঠিক করলে সেটা না করা পর্যন্ত হাল ছাড়ে না। সে জন্যই আজকের পর্যায়ে আসতে পেরেছে।

মুশফিকুর রহিম, অঙ্কন: মাসুক হেলাল
মুশফিকুর রহিম, অঙ্কন: মাসুক হেলাল

মুশফিকের ক্যারিয়ার আমার মনে হয়, যেকোনো কারও জন্যই হতে পারে আদর্শ। সম্ভাবনাময় এক ক্রিকেটার থেকে আস্তে আস্তে অধিনায়ক, দলের বড় ভরসা হয়ে ওঠা। ধাপে ধাপে এগিয়েছে ও, প্রতিটি পর্যায় পার হয়েছে এক এক করে। এবং খুব ভালোভাবে। প্রতিটি ধাপ ছিল দারুণ সাজানো-গোছানো। যেন লিখিত চিত্রনাট্য, এটার পর ওটা হবে, তারপর ওটা...। ভাববেন না ভাগ্যের জোরে পেয়ে গেছে। বরং ভাগ্য গড়ে নিয়েছে নিজের মতো করে। পরিশ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে। তামিম ও মুমিনুলের ক্ষেত্রে যেটা বলেছি, একেকটা নির্দিষ্ট শট নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে, লক্ষ্য ঠিক করে এগোয়, মুশফিকও সেটি করে। সবচেয়ে বেশি। কাউকে ছোট না করেই বলছি, দলের সবচেয়ে পরিশ্রমী ক্রিকেটার মুশফিক। কিপার-ব্যাটসম্যান বলে এমনিতেও বেশি প্র্যাকটিস করতে হয় ওকে। তবে শুধু ব্যাটিং নিয়েও যেকোনো কারও চেয়ে বেশি কষ্ট করে। সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে অনেকেই জানেন, মুশফিক কখনোই ঐচ্ছিক অনুশীলন মিস করে না। আর এমনিতেও দলের সঙ্গে অনুশীলনেও কখনো দেখবেন না এক মুহূর্ত বসে আছে। দলের বাইরে নিজের মতো করে খাটে তো বটেই, সৎভাবে পরিশ্রম করে। নিজেকে ফাঁকি দেয় না।
সেটার পুরস্কারও পেয়েছে, পাচ্ছে। প্রতিভা আর টেকনিক মুশফিকের সহজাত। কিন্তু শুরুর দিকে অত বেশি শট ছিল না হাতে। আর এখন দেখুন, আমি তো বলব, মুশি এখন দেশের সবচেয়ে হার্ড হিটিং ব্যাটসম্যান। ওর এই উন্নতিটা সবচেয়ে লক্ষণীয় ও বিস্ময়কর। লম্বা ইনিংস তো খেলতে পারেই, প্রয়োজনে ঝড় তুলতে পারে যেকোনো সময়। নিজের জোনে বল পেলে গ্যালারিতে পাঠিয়ে দেয়। অনেক জোর ওর হাতে। কিপিংয়েও আগের চেয়ে উন্নতি করেছে।
পরিণতিবোধের কথা বলেছি। মজার ব্যাপার হলো, ওর চরিত্রের একটা বিপরীত দিকও আছে। প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ। নিজের বা দলের কোনো কিছু ঠিকঠাক না হলেই গম্ভীর, মনমরা হয়ে যায়। চোখে পানি চলে আসে। টপাটপ পানি পড়তেও দেখেছি। মনে হচ্ছে, গত কিছুদিনে অবশ্য নিজেকে সামলাতে শিখেছে।
সবকিছু ঠিকঠাক গেলে এই বিশ্বকাপে ওরই অধিনায়ক থাকার কথা ছিল। স্বপ্নও দেখেছিল নিশ্চয়ই। তবে ওকে খুব ভালো করে চিনি বলেই জানি, এটা নিয়ে ওর মনে কোনো খেদ থাকবে না। দল-অন্তঃপ্রাণ ছেলে, নিজেকে উজাড় করে দিয়েই খেলবে। উইকেটের পেছন থেকে অধিনায়ক মাশরাফিকে যতটা সম্ভব সহায়তা করবে। আনুষ্ঠানিকভাবে নেতা না হলেও সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে নেতৃত্বে ভূমিকা রাখবে। সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, মুশফিক বলে গেছে বিশ্বকাপে দারুণ কিছু করতে চায়। সেই সামর্থ্য ওর ভালোমতোই আছে। সেরা ব্যাটসম্যান যেহেতু, দল ও গোটা দেশও তাকিয়ে থাকবে। তবে আমি বলব, এসব নিয়ে যেন খুব বেশি না ভাবে। নিজের মতো স্বাভাবিক খেলে। খুব বেশি সামনে না তাকিয়ে প্রতিটি ম্যাচ আর পরিস্থিতি বুঝে খেলে।
এখনই মুশফিক বিশ্বের সেরা কিপার-ব্যাটসম্যানদের একজন। বিশ্বকাপ থেকে ফিরুক সেরাদের সেরা হয়ে!