হেরেই বিদায় বাংলাদেশের

এমিলি (বাঁয়ে), মামুনুলদের অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছে পুরো গল্পটা। শুরুতে এগিয়ে গিয়েও পাকিস্তানের কাছে পরাজয়, গ্রুপ পর্বেই বিদায়। বিস্মরণযোগ্য এক সাফ গেল বাংলাদেশের  শামসুল হক
এমিলি (বাঁয়ে), মামুনুলদের অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছে পুরো গল্পটা। শুরুতে এগিয়ে গিয়েও পাকিস্তানের কাছে পরাজয়, গ্রুপ পর্বেই বিদায়। বিস্মরণযোগ্য এক সাফ গেল বাংলাদেশের শামসুল হক

ডাগ-আউট ও প্রেসবক্স থেকে সমানে চিৎকার উঠছে, ‘আর একটা গোল চাই। একটা গোল হলেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত!’ ওই একটা গোলের হাহাকার তো ভেসে বেড়ালই, উল্টো যোগ করা সময়ের প্রথম মিনিটে আবারও বাংলাদেশের জালে বল। পাকিস্তান ২-১ গোলে জয় তুলে যখন শেষ চারে পৌঁছানোর উৎসব করার প্রতীক্ষায়, দশরথ স্টেডিয়াম থেকে তখনই খবর এল ভারত নেপালের বিপক্ষে ২-১ করে ফেলেছে। যার অর্থ, শেষ পর্যন্ত ‘ডেথ গ্রুপ’ থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন নেপালের সঙ্গী হয়ে ভারত উঠল সেমিফাইনালে। গোলগড় সমান, কিন্তু ভারতের কাছে পরাজয়েই কপাল পুড়েছে পাকিস্তানের। নেপাল সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ আসল সময়েই অদৃশ্য এক দেয়ালে গেল আটকে! তিন ম্যাচে দুই হার, এক ড্র। টানা দ্বিতীয় সাফ টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্ব থেকেই পাততাড়ি গোটাতে হলো লাল-সবুজের দলকে। নেপাল আর্মড ফোর্সেস মাঠে কালকের পড়ন্ত বিকেলটা ছটফট করছিল উত্তেজনায়। দশরথ থেকে ফোন আসছে এই প্রেসবক্সে। এখান থেকে ফোন যাচ্ছে দশরথের প্রেসবক্সে। কোন ম্যাচের কী খবর, বাংলাদেশ-ভারত সংশ্লিষ্টরা খোঁজ নিচ্ছিলেন মিনিটে মিনিটে। ভারত-নেপাল ম্যাচ ড্র হলে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে হারালেও সেমিতে যেতে পারবে না—এই যখন সমীকরণ, বাংলাদেশের প্রথম কাজটা ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে জয় তুলে নেওয়া। তারপর বিদায় নিতে হলে বলার কিছু থাকত না। জয়ের লক্ষ্যে শুরুতেই ঝাঁপিয়ে প্রথম দুই মিনিটেই দুটি সুবর্ণ সুযোগ এল। একটি নষ্ট করলেন জাহিদ, অন্যটি ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক এমিলি। এমিলি তো তিন মিটার সামনে থেকেও নিশানা খুঁজে পাননি। শুরুতে গোল পেলে উজ্জীবিত বাংলাদেশের সামনে পাকিস্তান কি পাত্তা পেত?

কিন্তু সেটি হয়নি, মিনিট পনেরো পর পাকিস্তান খেলাটা ধরল। বাংলাদেশকে কয়েকবার পরীক্ষাও দিতে হলো। তবে ২৯ মিনিটে ডিফেন্ডার রায়হানের থ্রো থেকে এমিলির ব্যাক হেড পাকিস্তানের জালে যেতেই আশার বেলুন ফুলে উঠল (১-০)। সেই বেলুন মিনিট ছয়েক পরই চুপসে গেছে আবারও রক্ষণের ভুলে। এটিও ‘সেট পিচ’ গোল। মজার ব্যাপার, তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের খাওয়া চারটি গোলের উৎস সেট পিচ। ৩৫ মিনিটে এলোমেলো বাংলাদেশের রক্ষণের ফাঁক গলে পাকিস্তান অধিনায়কের টোকায় বল জালে (১-১)। প্রথমার্ধে তুলনামূলক ভালো খেললেও দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশ ছিল অনেকটাই নিষপ্রভ। বল নিয়ে কেউ ঢুকতেই পারছিলেন না পাকিস্তানের রক্ষণসীমায়। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল ফুলহামের সাবেক ডিফেন্ডার জেশ রহমানের নেতৃত্ব পাকিস্তান রক্ষণ থাকল জমাট। শারীরিকভাবে মামুনুলদের চেয়ে পাকিস্তানিরা অনেক এগিয়ে। সেই শরীরী লড়াইয়ে বেশির ভাগ সময়ই বল জিতেছে পাকিস্তানিরা।

দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি মাঠের গা ঘেঁষেই নেপালের সেনাকর্মীদের বাসা থেকে উল্লাসধ্বনি। নেপাল গোল মিসের মহড়া দিয়ে অবশেষে খুঁজে পেয়েছে ভারতের জাল। খানিক বাদে আবারও উল্লাস। নেপাল ২-০! এই স্কোরলাইনই শেষ পর্যন্ত থাকলে বাংলাদেশের প্রয়োজন পড়ত আর একটি গোল।

ম্যাচের কয়েক মিনিট বাকি থাকতে উত্তেজনায় অধীর বাংলাদেশ ডাগ-আউট। নিয়মিত অধিনায়ক মামুনুলও বদলি হিসেবে নামলেন মাঠে। কিন্তু উজ্জীবিত পাকিস্তান বাংলাদেশকে শেষ দিকে আর সুযোগ না দিয়ে নিজেরা ঝাঁপাল গোলের জন্য। ডেনমার্কে খেলা স্ট্রাইকার হাসান বশির তো একবার প্রায় ২-১ করেই ফেলেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত ভারত ম্যাচের মতো শেষ কয়েক সেকেন্ডেই সর্বনাশ। জোরালো আক্রমণ ছিল না, নিজেদের রক্ষণত্রুটির খেসারত দিয়েই ওই গোল হজম। ক্লান্ত বাংলাদেশের রক্ষণকে নাচিয়ে খানিক আগেই নামা বদলি স্ট্রাইকার কলিমুল্লাহর গড়ানো শট জালে (২-১)।

পাকিস্তানিদের সে কী আনন্দ! পাকিস্তানের একমাত্র সাংবাদিক তো আনন্দের আতিশয্যে পেশাদারি ভুলে প্রেসবক্স থেকে ডাগ-আউটে দিলেন ভোঁ-দৌড়। কিন্তু খানিক বাদেই শুনলেন ভারত শেষ মিনিটে একটা গোল দিয়েছে। গোটা পাকিস্তান দলের সঙ্গে তিনিও তখন হতাশায় মুহ্যমান।

বাংলাদেশ দলে হতাশা থাকলেও ভারত ম্যাচের মতো বিষাদ ছড়ায়নি। ভারতের বিপক্ষে রেফারিকে দোষারোপ করে পার পাওয়া গেছে। কালকের হারের কোনো অজুহাত নেই। সবাই মানলেন, এটিই বাংলাদেশের ফুটবলের মান। কয়েকজন খেলোয়াড়কে তো এদিন মাঠেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। জাহিদ বাজে খেলেছেন। দম হারিয়েছেন মোবারক। বদলি স্ট্রাইকার ওয়াহেদ খেই হারিয়ে বলই ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেননি।

মাঝমাঠে জামাল ও ওমর ফারুক, রক্ষণে রায়হান, মিশুসহ অন্যরা হতাশার প্রতিমূর্তি হয়ে রইলেন মাঠে। কোচের দোষ কী? মাঠে তো খেলোয়াড়দেরই খেলতে হবে। সেখানেই অনেক খেলোয়াড়ই ডাহা ফেল। নেপাল ম্যাচে বাজে খেলার পর এর-ওর মুখে শোনা গেছে, ‘আরে, সামনে দলবদল থাকায় অনেকে পা বাঁচিয়ে খেলছে।’ কালকের ম্যাচ শেষে ওই সমালোচকেরা কথাটা আরও তীব্র ভাষায় বলার সুযোগ পেলেন।

ঘরোয়া ফুটবলে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক খেলার অভাব পিছিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের ফুটবলকে। এই সাফ টুর্নামেন্টে সেটিরই চূড়ান্ত প্রতিফলন। এটা না মেনে আর উপায় নেই।

বাংলাদেশ দল: মামুন খান, আরিফ, লিংকন, রায়হান, মিশু, জামাল, ওমর ফারুক (মামুনুল), জাহিদ (তকলিচ), মোবারক, সোহেল রানা (ওয়াহেদ), এমিলি।