গুরুত্ব নেই, আবার আছেও

কার্র্টুন : শিশির
কার্র্টুন : শিশির

নিয়তি অলক্ষ্যে কী খেলাই যে খেলে! নইলে ‘বাংলাওয়াশ’-এর নায়কই কেন পাকেচক্রে আবার সেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টস করতে নামবেন!
‘বাংলাওয়াশ’ বললে মনে এখন প্রশ্ন জাগে, কোনটির কথা হচ্ছে। এখানে প্রথমটির। কী কাকতালীয় দেখুন, প্রায় সাড়ে চার বছর আগের ওই ৪-০ আরও বেশি করে মনে করিয়ে দিতে এখানেও মাশরাফি বিন মুর্তজা আর সাকিব আল হাসান!
মনে আছে তো ২০১০ সালের সেই অক্টোবর? ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে ১ ওভার করেই অ্যাংকেলের চোটে ছিটকে পড়লেন অধিনায়ক মাশরাফি। বাকিটুকু ইতিহাস। সাকিবকে অধিনায়কত্ব করতে হলো। বলতে গেলে ব্যাটে-বলে একাই নিউজিল্যান্ডকে ধ্বংস করে দিলেন।
এখানে মাশরাফির বদলে অধিনায়কের নাম সাকিব হয়ে যাওয়ার কারণ যত না অসুস্থতা বা চোট, তার চেয়ে বেশি নিষিদ্ধ হওয়ার চোখরাঙানি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আপাতগুরুত্বহীন ম্যাচটিতে ওভার রেটে পিছিয়ে পড়লে তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা পেতে হতো। গুনে গুনে ঠিক তিন ম্যাচই! যার মানে কোয়ার্টার ফাইনাল তো বটেই, সেমিফাইনাল ও ফাইনালেও মাশরাফি দর্শক হয়ে যেতেন!
কথাটা শুনে মাশরাফি খুব হাসলেন, ‘মজা করছেন, না? বলা যায় না কিন্তু!’ মজাটা বাংলাদেশ দলেও হচ্ছে। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিশ্বকাপ হয়ে যাচ্ছে ‘এক ম্যাচের খেলা’। মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হচ্ছে, নির্দিষ্ট দিনে ভালো খেললে তো যেকোনো কিছুই সম্ভব। সাকিব আল হাসান যেমন নিউজিল্যান্ড এই বিশ্বকাপের সেরা দল কি না প্রশ্ন করায় বললেন, ‘সেরা দল বলে এখানে কিচ্ছু নেই। ওয়ানডেতে যে যেদিন ভালো খেলবে, সে-ই জিতবে।’
দলের ছন্দটা ঠিক রাখতে মাশরাফিকে খেলানোর ঝুঁকি নেওয়া হবে কি না, এ নিয়ে একটু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। ম্যাচ রেফারির নাম জানার পর সিদ্ধান্ত নিতে আর এক মুহূর্তও লাগেনি। স্টুয়ার্ট ব্রডের বাবা সাবেক ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যান ক্রিস ব্রড যে উপমহাদেশের দলগুলোকে খুব ‘নেকনজরে’ দেখেন, এটা মোটামুটি সবারই জানা। তার ওপর আবার কোয়ার্টার ফাইনালে সম্ভাব্য প্রতিপক্ষের নাম ভারত। এর পরও কোনো দল অধিনায়ককে হারানোর ঝুঁকি নিলে বুঝতে হবে হয় ওই দলের বুদ্ধিশুদ্ধি নেই অথবা বর্তমান ক্রিকেট-বিশ্বের হালহকিকত সম্পর্কে তাঁরা নেহাতই অজ্ঞ।
প্রায় সাড়ে তিন বছর পর হঠাৎ আবার অধিনায়কত্ব পেয়ে একটু হকচকিত সাকিব কাল রাতে দাবি করলেন, ম্যাচ নিয়ে চিন্তাটা এখনো গুছিয়ে নিতে পারেননি। যাঁর সঙ্গে আজ টস করতে নামবেন বা এরই মধ্যে টস করে ফেলেছেন, সেই ব্রেন্ডন ম্যাককালাম চিন্তার বড় একটা অংশজুড়ে থাকার কথা। এই বিশ্বকাপে শুরুতে নিজের ব্যাটে যেমন, তেমনই অধিনায়কত্ব দিয়েও ঝড় তুলছেন। আজকের ম্যাচের দুই অধিনায়কের আবার বেজায় বন্ধুত্ব। আইপিএলে নাইট রাইডার্সে একসঙ্গে খেলার সূত্রে সেই বন্ধুত্বের ভিত্তি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। সংবাদ সম্মেলনে ম্যাককালাম শুধু ক্রিকেটার সাকিবেরই প্রশংসা করলেন না, জীবন সম্পর্কে মানুষ সাকিবের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মুগ্ধতার কথাও জানিয়ে দিলেন। ‘সাকিব ম্যাজিক’-এর সঙ্গে সম্যক পরিচয় আছে বলে পরদিনের ম্যাচটি যদি সাকিবের দিন হয়, তা হলে কিছু করার নেই বলেও অবলীলায় ঘোষণা করলেন।
ম্যাককালামের সঙ্গে হয়তো একটু বেশি খাতির, তবে আইপিএলের কল্যাণে নিউজিল্যান্ড দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ের সঙ্গেই সাকিবের ভালো বন্ধুত্ব আছে। ড্যানিয়েল ভেট্টোরির সঙ্গে বন্ধুত্বের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও। দুজনই বাঁহাতি স্পিনার। চোটের কারণে মাঝখানে এত দিন বাইরে থাকার পরও ফিরে এসে ভেট্টোরির বোলিং দেখে সাকিব মুগ্ধ, ‘খুব ভালো বোলিং করছে। তার পরও এই বিশ্বকাপের পরই নাকি ছেড়ে দেবে শুনলাম!’ প্রসঙ্গ বিশ্বকাপের পরই ছেড়ে দেওয়া হলে কুমার সাঙ্গাকারা না এসে পারেনই না। পর পর চার ম্যাচে সেঞ্চুরির ইতিহাস গড়া শ্রীলঙ্কান বাঁহাতি সম্পর্কে একসঙ্গে সাকিবের দুটি ভবিষ্যদ্বাণী, ‘দেখবেন, ও পরের ম্যাচেও সেঞ্চুরি করবে। আর মনে হয় না, বিশ্বকাপের পর ছেড়ে দিতে পারবে।’

টিম হোটেল নভোটেলের উল্টো দিকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাকিবের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছে, তখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। কাল সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হ্যামিল্টনে বৃষ্টিরই রাজত্ব। সাকিবকে বউ নিয়ে ঘুরতে দেখে দুপুরে ম্যাককালাম বলেছেন, ‘কালও বৃষ্টি হলেই ভালো। পরিবারকে সময় দেওয়া যাবে।’ ম্যাচটা এমনই যে, বৃষ্টি নিয়ে কোনো দলেরই কোনো দুশ্চিন্তা নেই। খেলা না হলেও গ্রুপের শীর্ষস্থান নিশ্চিত নিউজিল্যান্ডের, হেরে গেলেও। বাংলাদেশের এই ম্যাচ জিতে কোয়ার্টার ফাইনাল প্রতিপক্ষ বদলে নেওয়ার একটা সুযোগ আছে। তবে সেটি নিয়ে কাউকেই খুব একটা ভাবিত মনে হলো না। বরং কে না কে সামনে পড়ে অনিশ্চয়তার চেয়ে চেনা প্রতিপক্ষ ভারতকেই যেন পছন্দ সবার।
টিম হোটেলের উল্টো দিকেই একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেস্টে বেশির ভাগ ক্রিকেটারের খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে। মুখের স্বাদ বদলাতে সাকিব সস্ত্রীক ডিনার করলেন পাশের একটা থাই রেস্টুরেস্টে। ফেরার পথে ওই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে একটু ঢুঁ মেরে গেলেন। পরদিনও বৃষ্টি আছে কি নেই, সতীর্থদের এই কৌতূহলের জবাবে আইফোনে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের পূর্বাভাস জানিয়ে দিলেন তাঁদের।
মাশরাফির বদলে দলে একজন ব্যাটসম্যান বাড়ানো হয়েছে। নাসির হোসেন আজ খেলছেন। হ্যামিল্টনের উইকেটের সোজাসুজি ছোট বাউন্ডারির কারণে আরাফাত সানির চেয়ে এখানে তাইজুলই বেশি কার্যকর হবেন ভেবে আরেকটি পরিবর্তনের কথাও ভেবে রাখা হয়েছে। সেটি চূড়ান্ত হয়নি আবহাওয়ার কারণে। আজ আর বৃষ্টি না হলেও কাভারে ঢাকা উইকেটে আর্দ্রতা তো থাকতেই পারে। সেটি বেশি আছে মনে হলে শফিউল ঢুকে যাবেন একাদশে।
ম্যাচটির গুরুত্ব নেই, আবার আছেও। ম্যাককালাম যতই উড়িয়ে দিতে চান, ৭-০-এর জ্বালা মেটাতে তাঁর দল নখদন্ত বের করেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। বাংলাদেশের হারানোর কিছু নেই, তবে কোয়ার্টার ফাইনালে নামার আগে আত্মবিশ্বাসে আরেকটু জ্বালানি ভরে নেওয়ার সুযোগ এই ম্যাচ।
দেখা যাক, কী হয়!