তিন মাসেই অন্য সাব্বির

সাব্বির রহমান
সাব্বির রহমান

‘মাস তিনেক আগেও তো জানতেন না বিশ্বকাপে খেলবেন...’, মুঠোফোনে এটুকু বলার পরই থামিয়ে দিলেন সাব্বির রহমান, ‘দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমি আরেকটু আগে থেকে বলি...।’
তিন মাস নয়, সাব্বির শুরু করলেন তারও দু-এক মাস পেছনে গিয়ে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে গত নভেম্বর-ডিসেম্বরের হোম সিরিজ থেকেই যে একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে জীবনের রং! কাল রাজশাহী থেকে বলছিলেন, ‘বিশ্বকাপ কেন, আমি তো এটাও জানতাম না যে জিম্বাবুয়ে সিরিজে খেলব। সেখানে ভালো খেলে বিশ্বকাপের দলে সুযোগ পাব। পাঁচ-ছয় মাস আগেও আমার চিন্তায় জাতীয় দল, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছিল না।’ তবে জীবনের মোড়টা যে বিশ্বকাপই ঘুরিয়ে দিয়েছে, মানছেন সেটাও, ‘এটা ঠিক, গত তিন মাসেই জীবনটা বেশি বদলে গেছে।’
জাতীয় দলের অন্য ক্রিকেটারদের মতো সাব্বিরকেও এই উপলব্ধি দিয়েছে বিশ্বকাপ। সুদূর অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের গ্যালারিতে লাল-সবুজের ঢেউ প্রাণে জাগিয়েছে দেশাত্মবোধের স্পন্দন। বড় মঞ্চে ভালো খেলা আত্মবিশ্বাসও বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক। এনে দিয়েছে খ্যাতি। সাব্বিরের কাছে এসবই ‘নতুন অভিজ্ঞতা’।
এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন দেশে এসেও। ২২ মার্চ দেশে ফিরে ওই রাতেই বিমানবন্দর থেকে রওনা হন রাজশাহীর উদ্দেশে। নাটোর পর্যন্ত সঙ্গী সতীর্থ তাইজুল ইসলাম। বাহন কিনা অ্যাম্বুলেন্স! অবরোধের মধ্যে যেন নাশকতার শিকার না হতে হয় সে জন্যই ওই ‘ছদ্মবেশ’।
তাইজুলকে নাটোরে ছেড়ে ভোর চারটার দিকে রাজশাহীর বালিয়াপুকুর এলাকার বাড়িতে পৌঁছায় সাব্বিরের অ্যাম্বুলেন্স। চমক অপেক্ষা করছিল সেখানে। পরিবারের সদস্যরা তো ছিলেনই, ভিড় লেগে ছিল পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদেরও। ‘বিশ্বকাপ-নায়ক’কে বরণ করে নিতে ভোররাত পর্যন্ত সবাই অপেক্ষায়।
সেই থেকে জীবনটা যেন কাটছে ঘোরের মধ্যে। সাব্বিরই বলছিলেন, ‘যেখানেই যাচ্ছি, সবাই জেঁকে ধরছে। অনেক দূর থেকেও ছোট ছোট বাচ্চারা বাসায় চলে আসছে আমার সঙ্গে দেখা করতে, অটোগ্রাফ নিতে। তাদের ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।’ এ তো গেল অপরিচিত ভক্তদের কথা। নানা রকম দাবি মেটাতে হচ্ছে কাছের মানুষদেরও, ‘সবাই খুবই খুশি। আমি যা-ই খেলেছি, বাংলাদেশ দল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে, এটাই তাদের কাছে বড়। সেলিব্রেট করতে বন্ধুদের খাওয়াতেও হচ্ছে।’
উল্টো দিক থেকে পাচ্ছেন সাব্বিরও। পরশু রাজশাহীর জিরো পয়েন্টে যেমন সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশার উদ্যোগে হয়ে গেল বিশাল সংবর্ধনা। সাব্বির জানালেন, ‘১০-১২ হাজারের মতো লোক হয়েছিল। বড় বড় মানুষ ছিলেন। সবাই খুব ভালো ভালো কথা বললেন। জীবনে প্রথম সংবর্ধনা পেলাম।’ প্রথম, তবে শেষ নয়। দু-চার দিনের মধ্যে রাজশাহীতে নাকি তাঁর আরও কয়েকটা সংবর্ধনা হবে।
দেশে ফিরে যে শুধু অটোগ্রাফ দিচ্ছেন আর সংবর্ধনা নিচ্ছেন, তা নয়। সাব্বির এর মধ্যে খেলে ফেলেছেন একটি ম্যাচও! গত মঙ্গলবার রাজশাহী ক্রিকেট লিগের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ ছিল টাউন ক্লাব আর প্রভাতী সংঘের মধ্যে। অনেকের অনুরোধে এই ম্যাচে টাউন ক্লাবের হয়ে খেলেন সাব্বির, ধরে রাখেন বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা। ব্যাট হাতে অপরাজিত ১৩৩ রান, শিরোপা জিতেছে সাব্বিরের দলই।
ওই ম্যাচের আগে সাব্বির সংবর্ধনা পান টাউন ক্লাবের পক্ষ থেকেও। তবে তাঁর কাছে এসব সংবর্ধনার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বাবা মোস্তাফিজুর রহমানের তৃপ্তি। বাবার আশা ছিল ক্রিকেটার ছেলেকে একদিন বিশ্বকাপে খেলতে দেখবেন। ‘আব্বুর ইচ্ছাটা পূরণ হয়েছে। বিশ্বকাপে আমার যেটুকুই অর্জন সেটা আমি তাঁকেই উৎসর্গ করেছি’—ছেলের কণ্ঠে আবেগ।
তা বাড়ি ফেরার পর কী কথা হলো বাপ-ছেলেতে? আশ্চর্য, বিশ্বকাপে পরিস্থিতির দাবি মেটাতে যে সাব্বিরের ব্যাট পরিণত হতো ধারালো তলোয়ারে, সহজ-সরল এই প্রশ্নে সেই সাব্বিরই কিনা কুঁকড়ে গেলেন! কেন? সাব্বিরের মুখ থেকেই শুনুন, ‘আব্বুকে আমি খুব ভয় পাই। ওনার সঙ্গে ওভাবে কথা বলি না। আব্বু যে আমার খেলা দেখে খুশি হয়েছেন সেটা আম্মার কাছে শুনেছি। বিশ্বকাপে আমরা ম্যাচ জেতার পর অনেকেই নাকি আব্বুর কাছ থেকে এটা-ওটা উপহার নিয়ে গেছে।’
জীবনের কত গল্পই বদলায়, বদলায় না ঘরের কোণের একান্ত গল্পগুলো। বিশ্বকাপ সাব্বিরের জীবনের রং বদলে দিলেও বাবার সঙ্গে তাঁর যুগল ছবিটা আছে আগের মতোই।